ঢাকা, ২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

কোনো প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে না

স্টাফ রিপোর্টার
১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও নির্বাচন কমিশনের মতো জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে না বলে মন্তব্য করেছেন বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান। গতকাল ‘ফিফটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ: ইকোনমি, পলিটিকস, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি এমন মন্তব্য করেন। 

রেহমান সোবহান বলেন, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। সবাই কি একই বিচার পাচ্ছে? পুলিশ সবাইকে একই সেবা দিচ্ছে? সবাই ব্যাংক ঋণ পাচ্ছে? আসলে নির্বাচন কমিশন ও দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না। তিনি বলেন, নতুন একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী রাজনীতিতে আসছে। কিন্তু আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে এখানে ভালো নির্বাচন হতো। যে পদ্ধতি পাকিস্তান ও নেপাল গ্রহণ করেছিল। দুই দলের রাজনীতির ভারসাম্য রক্ষা হয়েছিল।

অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির বাইরে আরও কিছু বিষয় দেশের উন্নয়নে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। সেটা হলো, মানুষের ব্যক্তিত্বের বিপ্লব, মানুষের মধ্যে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকা বা লড়াই করার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, সেটা। এই প্রবণতার কারণে দেশের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে দেশের উন্নয়নের জগতে বড় একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে সেটা হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক দূরদৃষ্টি থেকে বর্জনকামী দূরদৃষ্টি। সেজন্য ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক এজেন্ডা রাজনৈতিক এজেন্ডায় রূপান্তরিত হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান বলেন, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ নিয়ে এ রকম আরেকটি বই করা হয়েছিল। তখন ধারণা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে ভালো জায়গায় যাবে। তখন অর্থনীতি নিয়ে অতটা উচ্চাশা ছিল না। এখন রাজনীতি নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে, বরং অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে। তিনি আরও বলেন, পরিবর্তনের যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি মন্দ দিকও আছে। সেটা হলো, পরিবর্তনের জন্য মূল্য দিতে হয়।

বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাত বিষয়ক সাবেক প্রধান সৈয়দ আখতার মাহমুদ অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের শস্য উৎপাদন বেড়েছে, উন্নতি হয়েছে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার, এসেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। এগুলোর সম্মিলিত ফল হচ্ছে উন্নয়ন। সৈয়দ আখতার মাহমুদ আরও বলেন, দেশের উদ্যোক্তা ও বাজার, নীতিনির্ধারণ ও গবেষণা, আলোচনা ও সংলাপের পৃথক পৃথক জগৎ গড়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে সমন্বয় ছিল বলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। সরকার যে সবকিছু করে দিয়েছে তা নয়, বরং উদ্যোক্তারাও অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু এখন এই সমন্বয় বিনষ্ট হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। আগে এই বিষয় যেভাবে কাজ করতো, এখন সেভাবে করছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বইটির আরেকজন লেখক সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান দ্বৈত উত্তরণের প্রসঙ্গে বলেন, দেশের যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে, এই উত্তরণ তারই প্রতিফলন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে এবং ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ মধ্যম আয় বা ঋণের ফাঁদে পড়ে কিনা। শ্রমঘন শিল্পের ওপর ভর করে এতদিন যে উন্নয়ন হয়েছে, সেখান থেকে পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হবে। অর্থাৎ উচ্চ প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও রপ্তানিতে যেতে হবে। কিন্তু গত ১০ বছরে উচ্চ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি এক শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। যদিও ভিয়েতনাম এক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিকাশ হলেও উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে এটি আর সেভাবে কাজ করবে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিষয়ে এতদিন এক ধরনের রাজনৈতিক ঐক্যমত ছিল, অর্থাৎ এটা চলতে দিতে হবে। কিন্তু এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ কি এফডিআই-নির্ভর হবে, নাকি অর্থনৈতিক অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন করবে, তা নিয়ে ঐক্যমত নেই। সেলিম রায়হান আরও বলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেশে এক ধরনের স্থিতিশীলতা আছে। এই চক্র ভাঙতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, তা না হলে সংস্কার হবে না এবং সরকারের রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতাও বাড়বে না।

অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল হাসান বলেন, শিল্প খাতের শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকেরা অনেক কষ্ট করে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শিল্প শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমেছে, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মজুরি বাড়েনি। এ ছাড়া যারা বিদেশ থেকে আয় পাঠাচ্ছেন, তারা নানা ধরনের হয়রানি ও অধিকারহানির শিকার হচ্ছেন।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন আপাতত স্ববিরোধী বিষয় নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া কীভাবে উন্নয়ন হলো, সেটা আর এখন আলোচনার বিষয় নয়; বরং উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও কেন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হচ্ছে না, এখন সেটা বুঝতে হবে। জাহিদ হোসেন আরও বলেন, আমরা যেমন উঠতে পারি, তেমনি পিছলেও যেতে পারি।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বইটির বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় বলেন, বিরোধী দল না থাকায় সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ দলাদলি ও কোন্দল আরও বাড়বে। আইন ও শালিস কেন্দ্রের হিসাবে ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সংঘাত ঘটেছে ২ হাজার ৭১০টি, যার মধ্যে শাসক দল আওয়ামী লীগের ২৩৯ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ২০০ জনই নিহত হন অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। বর্তমান সরকারের প্রভাবশালীরা পেশিশক্তি প্রয়োগ করছেন ভেতরের প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে। এমনকি রাষ্ট্রের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও সংঘাতে নেমেছেন। রাষ্ট্রেই একমাত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন না, বরং  প্রভাবশালীদের বল প্রয়োগের অনুমতিও তারা দিচ্ছেন। মতিউর রহমান আরও বলেন, সকল শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধী দলকে সরকারি দল কোণঠাসা করতে সক্ষম হয়েছে। বিএনপি’র তথ্যানুসারে, গত বছরগুলোতে তাদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৫৫ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। শাসক দল বর্তমানে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। রাজনৈতিক দল আজ ভবিষ্যতের পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়ে গেছে, বরং উল্টো পথে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে।
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2022
All rights reserved www.mzamin.com