প্রথম পাতা
ক্যাপ্টেন-ক্রুদের বর্ণনায় জিম্মিদশার ৩৩ দিন
জালাল রুমি, চট্টগ্রাম থেকে
১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার১২ই মার্চ দুপুর সাড়ে ১২টায় আমরা ডাকাতদের কবলে পড়ি। এরপর প্রথম ৩ দিন আমরা চরম আতঙ্কে ছিলাম। বেঁচে বাড়ি ফেরার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। মা, একমাত্র বাচ্চা, স্ত্রীসহ আপনজনদের কথা মনে পড়ছিল খুব। এই দস্যুদের ভয়ঙ্কর অঙ্গভঙ্গি ও অস্ত্রশস্ত্র দেখে মৃত্যুর শঙ্কায় ছিলাম সবসময়। ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হতে থাকে। দস্যুরাও একটু নমনীয় হয়। এরমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ার দিকেও চোখ রাখছিলাম। সবশেষে ৩৩ দিনের মাথায় ১৪ই এপ্রিল মধ্যরাতে আমরা মুক্তি পাই। আল্লাহর কাছে শোকরিয়া পাশাপাশি আমাদের কোম্পানির কাছে কৃতজ্ঞতা। এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছি। জাহাজে আর না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যে ট্রমার মধ্যে আমরা ছিলাম, সেখান থেকে বের হতে হয়তো আমাদের সময় লাগবে অনেকদিন।
বুধবার বিকালে মানবজমিনের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে একান্ত আলাপে এমনটা বলেছেন সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে আটক বাংলাদেশ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিক নূর উদ্দিন।
নূর উদ্দিন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আমিন শরীফের পুত্র।এক সন্তানের জনক এই নূর আব্দুল্লাহ’র জাহাজের স্টুয়ার্ট হিসেবে দায়িত্বপালন করছিলেন। নূর উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, সেদিন প্রথমে ৪ জন সশস্ত্র জলদস্যু আমাদের জাহাজে উঠে। তারা উঠেই প্রথমে সেকেন্ড অফিসারকে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে জিম্মি করে। এসময় ক্যাপ্টেন স্যারের নির্দেশে বাকি নাবিকরা জাহাজের সিটাডেলে আশ্রয় নিয়েছিল। দস্যুরা একের পর এক ওপেন ফায়ার করছিল ও চেঁচামেচি করছিল। এসময় তারা চিৎকার করে ক্যাপ্টেন স্যারকে সামনে আসতে বলছিল। পরে সেকেন্ড অফিসারকে বাঁচাতে ক্যাপ্টেন স্যার হাত উঁচিয়ে সামনে আসেন।এরপর তাদের কথামতো ক্যাপ্টেন স্যার বাকি নাবিকদেরকেও সামনে আসতে বলেন। এরপর একে একে সবাই ডেকে আসেন। এরমধ্যে আরও দুইটি বোট থেকে ৮ জন দস্যু জাহাজে উঠে। তারা নাবিকদের হাঁটু গেড়ে নিচে বসার নির্দেশ দেয়। এভাবে শুরু হয় আমাদের দুর্বিষহ বন্দি জীবন।
তিনি বলেন, আমাদের জাহাজে কোনো গানম্যান ছিল না। আসলে গানম্যান থাকলেও এদের সঙ্গে পেরে উঠার কথা ছিল না। দস্যুদের সবার কাছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল। আর তারা দেখতেও ভয়ঙ্কর। এরপরও আমাদের জাহাজের মাস্টার চেষ্টা করেছিলেন বাঁচতে। দস্যুরা যখন ফিশিং বোট থেকে আমাদের জাহাজটিকে আটকানোর চেষ্টা করছিল, তখন মাস্টার স্পিড বাড়িয়ে দেন। ডানে-বাঁয়ে গিয়ে জলদস্যুর স্পিডবোটটি ডুবানোর চেষ্টা করেন। ঢেউও তোলা হয়, যাতে স্পিডবোট উল্টে যায়। কিন্তু এরপরও স্পিডবোট থেকে এক জলদস্যু জাহাজে উঠে যায়। তার পরপরই ৩ জন উঠে। এর একটু পর আরও ৮ জন উঠে।
তিনি বলেন, এই দস্যুরা প্রথমে আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছিল। সেকেন্ড অফিসারকে সামান্য মারধরও করেছিল। পরে আমরা মুসলিম পরিচয় দেয়ার পর একটু নমনীয় হয়। তবে নিজেরা কোনো নামাজ পড়তো বা রোজা রাখতো না।যদিও তারা আমাদের নামাজ রোজা রাখাতে কোনো সমস্যা করেনি। রোজাও রাখতে দিয়েছিল।
নূর উদ্দিন বলেন, জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর দস্যুরা প্রথমে আমাদের কাছ থেকে মুঠোফোন কেড়ে নেন। তবে কয়েকজন নাবিকের কাছে অতিরিক্ত মোবাইল ছিল। তারা এগুলো লুকিয়ে রেখেছিল।কয়েকটি ল্যাপটপও লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এগুলো দিয়ে পরিবারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতাম।
নূর উদ্দিন বলেন, দস্যুদের দলে আহমেদ নামে একজন ছিল। উনার আচরণটা একটু ভালো ছিল। তিনি ইংরেজিও বলতে পারতেন। দলের সর্দার আমরা ঠিক জানতাম না। তবে তাকেই জাহাজে থাকা দলের সর্দার মনে হয়েছে। আমাদের ক্যাপ্টেন স্যার তাকে বিভিন্নভাবে কনভিন্সও করেছিল। ফলে ধীরে ধীরে পুরো গ্রুপটা আমাদের প্রতি একটু ভালো আচরণ করেছে। এক্ষেত্রে আমাদের ক্যাপটেন স্যারের ভূমিকা ছিল অসাধারণ।
তিনি বলেন, সোমালিয়ার ডেরায় জাহাজ নোঙর করার পর জাহাজের মাস্টার আব্দুর রশিদ দস্যুদের দলনেতা আহমেদের সঙ্গে কথা বলেন। তাকে অনুরোধ করেন, তার কিছু কাজ করা লাগে। সে জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় যাতে তাকে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়। দস্যুনেতা আহমেদ তাতে রাজি হয়। তারপর নাবিকেরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবিনে গিয়ে রেস্ট নিতে পারতেন।
নূর উদ্দিন বলেন, আগামী ২২শে এপ্রিল আমাদের জাহাজ আমিরাতে পৌঁছাবে। সেখানে পৌঁছার পর এটি জাহাজে থাকা কয়লা আনলোড করবে। এরপর জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে রওনা দিবে। এরমধ্যে ওই জাহাজে করেই ২১ জন নাবিক দেশে ফিরবেন। আমি আর সেকেন্ড অফিসার বিমানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এদিকে নুর উদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, এখানে (বাংলাদেশে) সবার ঈদ শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার। তবে তখন আমাদের বাসায় ঈদ ছিল না। আমার স্বামীকে নিয়ে পরিবারের সবাই এত চিন্তিত ছিলাম, বাসায় কোনো ঈদের আমেজ ছিল না। রোববার সকালে স্বামীর মুক্তির খবর শোনার পর আমাদের ঘরে ঈদ আসে। আমরা যে কতো খুশি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।’
জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার স্বামী ফিরে আসবেন। তবে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন সেটা চিন্তাও করিনি। কারণ সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে গেলে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসার নজির নেই। আল্লাহর কাছে এজন্য শোকরিয়া জানাচ্ছি। পাশাপাশি জাহাজের মালিকপক্ষ ও সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় বন্দি নাবিকরা এত কম সময়ে মুক্তি পেয়েছেন।’
এতবড় বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর নামে সদকা করা উচিৎ
Why two persons are coming back by air? They should come back altogether.
আলহামদুলিল্লাহ। মহান আল্লাহপাকের কাছে হাজারো শুকরিয়া।
যদি আল্লাহর উপর বিশ্বাস থাকে তবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন।
নিশ্চয়ই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সর্ব জ্ঞানের অধিকারী
আল্লাহর কাছে শোকর করুন পবিত্র কোরআন, নফল নামাজ আদায় করুন , যাকাত আদায় করুন ও মহান আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করে দরিদ্রের মাঝে বিতরণ করুন। সকল নাবিকের জন্য দোয়া করি।আমীন।