শেষের পাতা
নূর আলমের শিকলবন্দি জীবন
পঞ্চগড় প্রতিনিধি
১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবারএক সময় স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন ছিল নূর আলমের (৪৬)। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার অপরাধে ভারতে ৩ বছর কারাভোগের পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফিরে নিজ বাড়িতে ৭ বছর ধরে শিকলবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন নূর। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ও ৪ সন্তানের জনক নূর আলম শিকলবন্দি জীবনযাপনের জন্য পরিবারে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা। নূর পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার সর্দারপাড়া গ্রামের মৃত হকিকুল ইসলামের ছেলে। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরতে নূর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মহানন্দা নদীতে নুড়ি পাথর উত্তোলনের কাজ করতেন। কিন্তু তাদের হাসিখুশি সংসারে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো নেমে আসে অন্ধকার। একদিন পাথর উত্তোলনের সময় সীমান্ত অতিক্রম করার কারণে আটক হয় ভারতীয় বিএসএফ’র হাতে। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পারিবারিকভাবে জানা গেছে, বছর দশেক আগেও স্বাভাবিক জীবন ছিল নূর আলমের। সংসার জীবনে হয়েছেন ৩ মেয়ে ও ১ ছেলের বাবা বিএসএফ’র হাতে আটকের পর দীর্ঘ ৩ বছরের অধিক সময় পর দেশে ফিরে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। নূর স্থানীয়দের পাশাপাশি পরিবারের সদস্য ও স্ত্রীর ওপর হামলা করেন। চোখের আড়াল হলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তেন নূর। কোনো কারণ ছাড়াই স্থানীয়দের ওপর হামলা করতেন। এ অবস্থায় স্থানীয়দের সহায়তায় তাকে শিকলবন্দি করে রাখা হয়। নূর আলমের মা নূর নেহার বলেন, আমার একমাত্র ছেলে নূর ১০-১২ বছর আগে ভালো ছিল। নদীতে মা-ছেলে একসঙ্গে পাথর উত্তোলনের কাজ করতে গেলে ভারতের ওপাশে ভুল করে চলে যায়। এতে বিএসএফ তাকে আটক করে জেলে পাঠায়। ভারত থেকে বন্দি জীবন শেষে দেশে ফিরেই পাগল হয়ে যায় আমার আদরের ছেলে। এখন তাকে ঘরে শিকলবন্দি অবস্থায় রেখে আমরা নিরূপায় হয়ে মানুষের দ্বারে গিয়ে সাহায্য নিয়ে চলছি। যে বয়সে কাজ করে মাকে খাওয়াবে ছেলে, সে বয়সে ছেলেকে বন্দি রেখে কাজ করে খাওয়াতে হচ্ছে। নূর আলমের সন্তানরা জানায়, যখন থেকে বুঝ হয়েছে তখন থেকে বাবাকে পাগল অবস্থায় দেখছি। খুব কষ্ট হয় বাবার এমন দশা দেখে। অন্যদের মতো আমাদেরও ইচ্ছে করে বাবার সঙ্গে একটু ভালোভাবে থাকতে। স্থানীয় লোকজন জানায়, উদ্ভট ও খেপামি স্বভাবের কারণেই তাকে শিকলবন্দি রাখা হয়েছে। পরিবারটি সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলে নূর আলম আবারো সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে অনেকে মনে করছেন। স্থানীয় প্রতিবেশী উসমান গণি বলেন, নূর আমার ফুফাতো ভাই হয়। দীর্ঘ ৭ বছর থেকে এমন অবস্থায় খুব কষ্টে দিন কাটছে পরিবারটির। আয় রোজগারের লোক না থাকায় অনেক সময় অনাহারে তারা দিনরাত অতিবাহিত করে। আমরা স্থানীয়রা যতটুকু পারি তাদের সহায়তা করি। এলাকার নারগীস বেগম বলেন, নূর আলমের পরিবারের করুণ অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগে। নূরকে শিকল মুক্ত করলে স্থানীয়দের ওপর হামলা করে। টাকার অভাবে পরিবারটি চিকিৎসা করাতে পারেনি। যদি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় বা তার চিকিৎসার জন্য কেউ তার পরিবারটির পাশে দাঁড়ায় তাহলে নূর আলম আবারো সুস্থ হয়ে উঠবে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে রাব্বি বলেন, নূর আলমের ব্যাপারে অবগত হয়েছি। তার ভারসাম্যহীনতার অবস্থা এতটাই যে এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে বলে স্থানীয় ও জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তে পরিবারটি তাকে শিকলবন্দি রেখেছে। আমরা তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। যতটুকু সম্ভব দরিদ্র পরিবারটির পাশে থেকে চিকিৎসার সহায়তা করা হবে।