মত-মতান্তর
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
চারিদিকে ডিভোর্সের মাতম আমাদের কী শেখাচ্ছে
মাহবুব নাহিদ
১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবারচারিদিকে ডিভোর্স, এ যেন ডিভোর্সের মহামারি! ডিভোর্স আমাদের সমাজে এক মারাত্মক ব্যাধী হয়ে গেছে। যেদিকে তাকাই শুধু দিভোর্সের মাতম। ডিভোর্সের হার দিন দিন বেড়েই চলছে। মূলত শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে ডিভোর্সের হার বেশি। কিন্তু আমরা যাদেরকে সেলিব্রিটি হিসেবে দেখি তাদের নিয়েই বাঁধে মূল সমস্যা।
এই ডিভোর্স আমরা যখন দেখি আমাদের চোখে দেখা বড় কোনো সেলিব্রিটির ক্ষেত্রে তখন একটু অবাক হই বটে!
জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আমরা যে সকল সম্পর্কের সঙ্গে আবদ্ধ হই তার বাহিরে সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক হলো বিয়ের মাধ্যমে তৈরি হওয়া সম্পর্ক। বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন, এর দ্বারা একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আজীবনের জন্য আবদ্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একে অপরের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। এই সম্পর্কের বিচ্ছেদ কখনোই কাম্য নয়। বিচ্ছেদ কেউ ইচ্ছা করে করতেও চায় না। পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে করতে হয়, সেক্ষেত্রে যারই দোষ থাকুক তা ব্যাপার নয় পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যাপারটা সেলিব্রিটিদের মাঝেই বেশি হচ্ছে। আমাদের দেশেই কিছুদিন ধরে বেশ কয়েকটা সেলিব্রিটি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। এই সমস্ত লোকজন নিজেদের ক্যারিয়ার, পাবলিক ফোকাসের দিকে খেয়াল দিতে গিয়ে নিজের স্ত্রী/স্বামী কিংবা পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। বিশেষ কিছু সময় ব্যতীত দেখাই হয় কম, ব্যতিক্রম থাকতেই পারে কিন্তু সেটা সংখ্যায় বেশি নয়। নিজেদের মধ্যে ভাব-ভালোবাসার আদান প্রদান কিংবা একসঙ্গে সময় পার করা ব্যাপারটা তাদের হয়ে ওঠে না। তাই হয়তো শান্তির খোঁজে বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয়।
কথা হচ্ছে, এর দ্বারা আমরা কি শিখছি? সেলিব্রিটিদের তো আমরা হরহামেশাই অনুসরণ অনুকরণ করে থাকি। তারা যদি এই কাজ করে তাহলে আমরা কী বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে যাবো? যেই জুটিকে নিজেদের জীবনের জন্য আদর্শ জুটি মনে করা হয়, তারা যদি বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয় তাহলে আমরা উৎসাহী হতেই পারি। তবে আর একটা ব্যাপার হচ্ছে দিন দিন এইসব খবর দেখতে, পড়তে আমরা তো বিরক্তও হয়ে গিয়েছি।
আসলে আগেকার দিনে স্ত্রীরা স্বামীদের অনেক ভক্তি করতো। গ্রামের মহিলারা স্বামীদের দেবতুল্য মনে করতো কিন্তু এখন সেই ধারা বদলে গেছে। তখনকার দিনে স্বামীদের কাছে বউরাও ছিল তাদের সম্পত্তি স্বরূপ। কিন্তু এখন বিয়ে হয়ে গেছে একটা ফ্যাশন। কে কার সঙ্গে বিয়ে করছে এটা এখন একটা বিরাট আলোচনার বিষয়। ছেলেরা বিয়ে করে মেয়ের শরীর কিংবা গায়ের রং আর মেয়েরা বিয়ে করে ছেলের সম্পত্তি আর টাকাকে। এই জিনিসগুলো আসলে খুব কৃত্রিম বিষয়। সুন্দরের কখনো শেষ হয় না। আমি চাইলেই সুন্দরের থেকেও উত্তম সুন্দর বের করে ফেলতে পারবো। যদি আমার ফ্যান্টাসিই হয়ে থাকে সৌন্দর্য তাহলে আমার বউয়ের চেয়ে সুন্দর মেয়ে চোখে পড়তে আমার সময় লাগবে না। মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। সম্পদই যদি খোঁজা হয় তাহলে সম্পদ সম্পত্তিওয়ালা মানুষের অভাব নেই। সম্পদের কোনো শেষ নেই। এই চাওয়ারও কোনো শেষ থাকে না। কিছু পুরুষ মানুষ আছে যারাও কিনা একটা নারীর জন্য নিজের অর্থ সম্পত্তি পরিবার পরিজন সব ভুলে যেতে পারে। সকল সম্পত্তি শেষ করে দিতেও প্রস্তুত থাকে অনেকে।
সেলিব্রিটিদের বিয়ে হয় অধিকাংশ নিজেদের মধ্যেই। বিয়েটা তাদের জন্য বড় শো অফের একটা ব্যাপার। কার বিয়েতে কতো মজা হলো। কোনো বর-বউ বিয়েতে ভালো নাচতে পারলো এটা বিশাল একটা ব্যাপার। বিয়ের মতো সামাজিক বন্ধনের একটা বিষয় হয়ে গেছে ব্যক্তিগত মার্কেটিং। সেলিব্রিটিদের ক্ষেত্রে যা হয়, তা হচ্ছে এখন একজনকে ভালো লাগে। কিছুদিন পর আরেকজনের সঙ্গে কাজ করতে করতে, তার সঙ্গে বেশি সময় দিতে দিতে, বেশি বেশি রোমান্টিক দৃশ্য করতে করতে ভালো লেগে যায়। ভালোলাগা একসময় পরিণত হয়ে যায় ভালোবাসায়। এই ভালোবাসা তখন কাল হয়ে দাঁড়ায় তার পরিবারের জন্য। পরিবারের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায় টানাপড়েন। আর একটা জিনিস খুব বেশি দেখা যায় যে, নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি হলেও বাহিরে তারা অনেক ভালো কিছু শো অফ করে। এতে তাদের মার্কেটিং বাড়ে। আসলে সবকিছুই এই মার্কেটিং শব্দটার কাছে পরাজিত হয়ে যায়। মার্কেটিং ছাড়া এখন দুনিয়া অচল হয়ে যায়। খারাপ সম্পর্কের ব্যাপারটা চেপে রেখে ভালো সম্পর্কের অভিনয় চালাতে চালাতে একসময় ঠিকই ডিভোর্স পর্যন্ত চলে আসে। তখন মানুষ হয়ে যায় অবাক। সবাই ভাবে যে এত ভালো সম্পর্ক! কালও দেখলাম একসঙ্গে ছবি দিয়েছে! কিন্তু ওটা তো তাদের নাটক ছিল! ওটা ছিল ব্যক্তিগত প্রচারণা। মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান, ভালোবাসা এখন কমে গেছে। কমে গেছে পরকালের ভয়। এসব কারণেই এখন সমাজে এই ধরনের ব্যাধি দেখা দিচ্ছে।
আসলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সম্মান এবং একে অপরের উপর বিশ্বাস। অনেক পুরুষ মনে করেন যে সম্মান শুধুমাত্র পুরুষরাই প্রাপ্য। কিন্তু বিষয়টা আসলে তা নয়। সম্মান নারী পুরুষ উভয়েরই প্রাপ্য।
প্রত্যেকটা মানুষেরই যার যার সম্মান থাকে। একজন যখন কোনো কথা বলছে বা কাজ করছে তখনই ভুল ধরিয়ে দেয়ার চিন্তা আমাদের মধ্যে সমস্যা ডেকে আনে। ভুল কিন্তু একাগ্রেও ধরিয়ে দেয়া যায়। সবার সামনে ভুল ধরতে গিয়ে দেখা যায় অন্যের মধ্যে অপমানবোধ হয়। অনেক সময় এমনটা হয় যে স্ত্রী একটা কাজ করেছে বা স্বামী একটা কাজ করেছে কিন্তু আমরা বিনা কারণে কেউ কাউকে প্রশংসা করতে চাই না। প্রশংসা করতে যে খুব একটা কষ্ট হয় তা কিন্তু না। কিন্তু সামান্য দুইটা সুন্দর কথা হয়তো মন জয় করতে পারে আপনার প্রিয়জনের।
মূল বিষয় হচ্ছে- দূরত্ব কীভাবে বাড়ে সেটা খুঁজে বের করা। রান্নাঘরে থালাবাটি একত্রে রাখলেও ঠোকাঠুকি হয়। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যে কিছুই হবে না তা ভাবা ঠিক নয়। সমস্যা হবে কিন্তু দ্রুত তা খতম করেও ফেলতে হবে। আমাদেরকে জানতে হবে আমাদের জীবনের গুরুত্ব কিসে। জীবনের প্রায়োরিটি জানতে হবে। আমরা আমাদের বাহ্যিক দুনিয়াকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমরা যশ খ্যাতি ব্যক্তিত্ব¡ থেকে শুরু করে নানান বিষয় নিয়ে মেতে থাকি। কিন্তু আমরা এটা ভাবি না যে দিনশেষে আমাদের পরিবার হচ্ছে আমাদের সম্পদ, আমাদের শেষ জীবনে কোনো কিছুই আমাদের থাকে না। শেষ মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন হয় একটা মানুষের, যে কিনা পাশে থাকবে, সকল বাধা বিপত্তিতেও সরে যাবে না। জীবনে যা অর্জন করেছি তার কোনোকিছুই তখন আসবে যাবে না, দিনশেষে আমরা সবাই একা।
আমাদের সম্পর্কগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ছাড় দেয়ার মানসিকতা। এই মানসিকতা ছাড়া কোনোভাবেই সম্পর্ক বেশি দূর আগাবে না। যখন একজন কোনো একটা বিষয় নিয়ে একটু চটে যাবে তখন অন্যজনের উচিত চুপ থাকা বা সবকিছু স্বীকার করে যাওয়া কিংবা মেনে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই ক্ষেত্রে আমি মনে করি, পুরুষদের উচিত বেশি সহনশীল হওয়ার চেষ্টা করা। আর বাস্তবতার উর্ধ্বে কিন্তু আমরা কেউ নই, এটা বুঝতে হবে। আমরা যখন প্রেম করি তখন অনেক কিছু ভাবি, তখন মনে করি ভালোবাসা দিয়ে পেট ভরে যাবে কিন্তু বাস্তবটা কঠিন। বাস্তবের পৃথিবীটা দেখতে হবে, বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। প্রেম এবং বিয়ের ক্ষেত্রে জীবনটা আলাদা সেটা মাথায় রাখতে হবে।
আমাদের দেশের মিডিয়ার লোকেদের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদ একটা উৎসবে পরিনত হয়েছে।
মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। চাহিদার পরিবর্তন হয়েছে। অনেক প্রবাসী আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি হয়ে বাড়িতে নান্দনিক বিল্ডিং করতেছে। কিন্তু দেশে যে থাকে তার ভিটেও নাই টিনের ঘর করার মত টাকাও নেই। ব্যাস, সে বাসা ভাড়া নিয়ে শহরমূখী হয়েছে। গ্রাম থেকে এভাবে অনেকে স্থানান্তরিত হয়েছে। তার দেখাদেখি বিল্ডিংওয়ালাও ছেলে-মেয়েকে “মানুষ” করতে শহরমূখী। বিয়ের পর পরই (গর্ভে সন্তান আসার আগেই ছেলে-মেয়েকে “মানুষ” করতে) শহর মুখী হতে চায় নববধু। মা-বাবা, ছোট ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ফেলে স্বামী যখন শহর মুখী হতে চায় না তখনই তালাকের ব্যাপার আসে। আবার অনেকে শাশুড়ী মায়ের নিকট আপন মা হতে অতি আদর পেয়ে শহরে বাসা নিয়ে নিজে বিদেশ চলে গেলে স্ত্রীর পরকীয়ায় সংসারের অবসান ঘটে। মূলত “উন্নয়ন” আমাদের সমাজ ধসে দিয়েছে।
দুই পক্ষই ফাঁকিবাজ।
মুক্তাদির রায়ান ভাই,আপনার কথা ১০০% টিক।
আসসালামু আলাইকুম লেখাটি খুবই চমৎকার হয়েছে উঠে এসেছে চিত্র আমাদের দৈনন্দিন জীবনের।
আমাদের দেশে এখন যে ধরনের ডিভোর্স হচ্ছে, তার বেশিরভাগ দিচ্ছে স্ত্রী তার স্বামীকে। এতে নতুন প্রজন্মের পুরুষরা বিবাহের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে দিন দিন.......আর সেইসব নারীদের ডিভোর্স করতে উৎসাহিত করছে তাদের পরিবারের লোকজন, সামান্য বিরোধ হলেই ডিভোর্স ?? মাঝে মাঝে অবাক লাগে, ডিভোর্স যদি দেবেন, তাহলে বিবাহ করলেন কেনো ?? সন্তান জন্ম দিলেন কেনো ?? ওই সন্তানের কি দোষ ?? ও কেনো ব্রোকেন সন্তান হয়ে জীবন অতিবাহিত করবে তার পিতা, মাতা থাকা সত্ত্বেও ?? মেয়েদের পরিবারের মধ্যে বোন, ভাই, ভাবী, খালা এরা উৎসাহিত করে, পরে ডিভোর্স হয়ে গেলে ওই মেয়ের বিপদ আপদে কেউ খবর রাখে না.......এই সহজ সত্যতা সেই সময় স্ত্রীর মাথায় থাকে না। সে নতুন স্বপ্নে বিভোর থাকে.......তাই আমাদের কন্যাদের পরিবারের উচিৎ কন্যা বিবাহের পর, সেই কন্যার ও তার স্বামীর সংসারে কোনো ধরনের ইন্টারফেয়ার না করা। স্বামী, স্ত্রী ঝগড়া হতেই পারে, আবার পরে ভালোবাসা হয়ে যায়, কিন্তু তার বোন বা দুলাভাই নাক গলালেই সেই স্ত্রী উৎসাহ পেয়ে স্বামীকে বেশী বেশী হেনস্থা করে। ওই দুলাভাই, বোন একবারও চিন্তা করে না, তাদের ও পরিবার আছে, সেখানে ভাঙ্গন ধরলে কে ঠেকাবে ?? তাই কন্যার সংসারে সুখ দেখতে চাইলে পিতা, মাতার কন্যাকে বিয়ের পর কোনো ধরনের আজাইরা আহ্লাদ না দেখানো। নতুন জায়গায় ওর মতো সংসারটা করতে দেওয়া.........কন্যাকে অবশ্যই সাপোর্ট দেবে, সেটা অন্যভাবে। সেটা আর্থিক হউক বা মানসিক, ধর্মীয় সেটা দেবে, কিন্তু কোনো ধরনের উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলা যাবে না, স্বামীর ও তার পরিবারের প্রতি ভালোবাসা কিভাবে বাড়ানো যায় সেই পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে, পরকালের ভয়, কুরআন হাদীসের কথা, নবী রাসূলদের সংসার জীবনের কথা শুনতে হবে। এতে কন্যার মাথায় বাজে চিন্তা আসবে না.........সব সময় ধর্মীয় অনুশাসনে থাকতে হবে। তাহলেই দেশ থেকে ডিভোর্সের সংখ্যা খুব দ্রুতই কমে যাবে........