এক্সক্লুসিভ

এশিয়া ফাউন্ডেশন-ইআরএফ-র‌্যাপিডের আলোচনা সভায় বক্তারা

করোনা মোকাবিলায় প্রণোদনা প্যাকেজ ভূমিকা রেখেছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

২০২২-০১-৩০

 করোনার প্রভাব মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। তবে প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা বেশি পেয়েছে সংগঠিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। অনানুষ্ঠানিক খাতের যেসব জায়গায় এ সুবিধা দরকার ছিল তার অনেক ক্ষেত্রেই পৌঁছায়নি। এর অন্যতম কারণ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। ফলে সংকট মোকাবিলার উদ্যোগ কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে সংস্কার আনা দরকার।

শনিবার ‘কোভিড-১৯ প্রণোদনা প্যাকেজ: প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এমন মতামত দিয়েছেন। এশিয়া ফাউন্ডেশন, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও গবেষণা সংস্থা র‌্যাপিড যৌথভাবে অনলাইনে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। পরিকল্পনামন্ত্রীও বক্তাদের মতামতের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন।
২০২০ সালের ৮ই মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়। এর কয়েকদিন পরেই ২৫শে মার্চ সরকার রপ্তানি খাতের কর্মীদের বেতন দেয়ার জন্য মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল ঘোষণা করে। এরপর করোনার প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতের জন্য পর্যায়ক্রমে ২৮টি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব প্যাকেজে এক লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা জড়িত, যা দেশের জিডিপি’র প্রায় ৬ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ঘোষিত প্যাকেজের ৮৫ ভাগ মুদ্রাবাজার কেন্দ্রিক অর্থাৎ ব্যাংক ঋণনির্ভর। যদিও অর্থ বিভাগের দাবি ঘোষিত প্যাকেজে সরকারের বাজেট থেকে বরাদ্দ বাড়ছে। বর্তমানে ৭০ শতাংশ ব্যাংক ব্যবস্থা নির্ভর। এই প্যাকেজগুলো অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কতোটা ভূমিকা রেখেছে, সরকারের এই উদ্যোগের ভূমিকা আরও প্রসারিত করাতে কী করা যেতে পারে, যেসব প্রতিষ্ঠান এসব কার্যক্রমে সম্পৃক্ত তাদের ভূমিকা আরও কার্যকর করতে কী করা দরকার, কারা সুবিধা পেয়েছে, যারা পাননি তারা কেন পাননি বা তাদের জন্য কী করা যেতে পারে এসবই ছিল ওয়েবিনারের আলোচনার বিষয়। মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি দূর করতে সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, যেকোনো জরুরি বা সংকটময় পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রতিরোধ উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনার ক্ষেত্রে সরকার সেটাই করেছে। অবশ্যই ব্যাংক খাতের মাধ্যমে করা হয়েছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশও তাই করেছে। একথা সত্য সুবিধা কারা পাবে, তা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে প্রথমদিকে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকতে পারে। তবে পরে সেগুলো ঠিক করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী সঠিকভাবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে। সরকারের মূল লক্ষ্য সমস্যা সমাধান করা।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক। তিনি বলেন, সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজগুলো অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বের  শীর্ষ অর্থনীতির ৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ গত ডিসেম্বরে ২২তম অবস্থানে ছিল। চলতি জানুয়ারিতে যদিও তা কিছুটা অবনতি হয়ে ২৯তম হয়েছে। এই অবস্থানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সরকারের উদ্যোগগুলো কতোটা প্রভাবিত করছে। সেই বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রশংসিত হয়েছে। তবে প্রণোদনার সুবিধা বেশি পেয়েছে সংগঠিত গোষ্ঠী। বিশেষকরে রপ্তানি খাত। যাদের সরকারের নীতি- নির্ধারকদের কাছে সহজে পৌঁছানোর সুযোগ রয়েছে। তুলনামূলকভাবে অনানুষ্ঠানিক খাতের মাঝারি, ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান তা ঠিকভাবে পায়নি। পর্যটন খাতে প্রণোদনা পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়েছে। দুস্থদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এই নীতি সুবিধা কার প্রয়োজন সেটি চিহ্নিত করার কাজটিও ঠিকভাবে হয়নি। প্রণোদনা প্যাকেজগুলোতে গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ, ফার্ম ম্যাকানাইজেশনের মতো এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাকে করোনার প্রভাব মোকাবিলার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোটা কঠিন। অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তার প্রভাব খুবই ইতিবাচক। তিনি বলেন, এর অন্যতম কারণ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব। পাশাপাশি নীতি সুবিধা প্রণয়নে রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রভাব। তিনি বলেন, সরকারের সম্পদেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে সবাইকে সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে না। সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে তা হচ্ছে না। এ জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাকে গুরুত্ব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাবে না। যদি নীতি সুবিধা বণ্টনে বৈষম্য দূর করতে হয়, যার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার কাছে সুবিধা পৌঁছাতে হয় তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা মানে শুধু কিছু প্রশিক্ষণ নয়। কারিগরি দক্ষতা উন্নয়ন, নতুন জ্ঞান বা ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা এবং জনবল বাড়াতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য কাওসার আহমেদ বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। বর্তমানে যেসব সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি রয়েছে সেগুলো যথার্থভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা সরকারের লক্ষ্য।
অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার বলেন, সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সকলের জন্য পেনশন, কর্মস্থলে দুর্ঘটনার জন্য বীমা ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। প্রণোদনা প্যাকেজ প্রসঙ্গে বলেন, অনানুষ্ঠানিক খাতে যারা সুবিধা পায়নি বা সমস্যায় রয়েছে তাদেরকে সুবিধা দেয়ার কাজ চলছে। ইস্টার্ন ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের বড় অংশ ব্যাংক খাতের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি প্রশমনে একটি উদ্যোগ থাকা দরকার। নতুবা প্রাতিষ্ঠানিক যে আগ্রহ সেটা কমে যেতে পারে। ইউএনডিপি কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, শুধু সক্ষমতা বাড়ালে হবে না, প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। যাতে ছোট, অতি ছোটদের পাশে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, কার কি সুবিধা দরকার সেটি এসডিজি বিষয়ক লোকালাইজেশন কর্মসূচি থেকে সহজে বের হয়ে আসবে। ফলে এসডিজির তথ্যগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ- মহাব্যবস্থাপক নূরুল আলম বলেন, ঋণ ঝুঁকি মোকাবিলার ব্যবস্থা এখন জরুরি। অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন বলেন, ব্যাংকগুলো তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করছে। কিন্তু সেখানে যার প্রয়োজনীয়তা বেশি, সে সুবিধা পাচ্ছে কিনা সেটি নিশ্চিত হচ্ছে না। কারণ ব্যাংকগুলো কম ঝুঁকি বিবেচনা করেই গ্রাহক নির্বাচন করছে। যে প্রতিষ্ঠান ৩০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে আর যে প্রতিষ্ঠানের ৭০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানেরই আগে প্রণোদনা পাওয়া উচিত।
 কিন্তু ব্যাংক ৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্তকে গ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে।

এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সেরাজ বলেন, করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী খুবই কঠিন সময় যাচ্ছে। এখন এই মহামারি ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তার হচ্ছে। ফলে পুরো বিশ্বের আর্থ-সামাজিক খাতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নেই। তবে বাংলাদেশ সরকার করোনার প্রভাব মোকাবিলায় যেসব প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়েছে সেটা খুবই সময়োপযোগী ছিল। যে কারণে আর্থ-সামাজিক খাতে করোনার প্রভাব যতটা আশংকা করা হয়েছিল, ততটা প্রভাবিত হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও র‌্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক এম আবু ইউসূফ বলেন, সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর কারণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সহজ হয়েছে। তবে এই প্যাকেজগুলোকে আরও কার্যকর করা যেতো কিনা বা আগামীতে এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগকে কীভাবে আরও কার্যকর করা যায়, কীভাবে আরও সুনির্দিষ্টভাবে প্রাপ্যতা নির্ধারণ করা যায় সেসব নিয়ে এখন কাজ করা দরকার। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো দরকার।

ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভাটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status