প্রথম পাতা

ডলার সংকট দাম বাড়ছে

এম এম মাসুদ

২৫ জানুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ৯:৪৩ অপরাহ্ন

বেশ কয়েক মাস ধরে দেশের বাজারে মার্কিন ডলারের দাম অস্থিতিশীল। বর্তমানে ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম হচ্ছে। ফলে হু হু করে বেড়েই চলেছে ডলারের দাম। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে টাকার বিপরীতে শক্তিশালী অবস্থায় মার্কিন এই মুদ্রাটি। গতকাল সোমবারও আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৮৬ টাকা করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে এর দাম ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করেছে। আগে ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। ওদিকে গ্রাহকদের ডলার বিক্রির ক্ষেত্রেও দাম বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। নগদ ডলার এখন সর্বোচ্চ ৯০ টাকা ৯৫ পয়সা দরে বিক্রি হচ্ছে। আগে ছিল ৯০ টাকা ৫০ পয়সা। আমদানির জন্য ডলার বিক্রি করছে ৮৬ থেকে ৮৬ টাকা ৯৫ পয়সা দরে। এদিকে ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ৯১ থেকে ৯৫ টাকায় কেনাবেচা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সোমবার ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য ছিল ৮৬ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সামপ্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় মুদ্রার বড় অবমূল্যায়ন এটি।
জানা গেছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এরপর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়। নভেম্বরে ডলারের দাম এসে দাঁড়ায় ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়। এরপর দেড় মাস একই অবস্থানে থাকলেও বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ টাকায়, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ মূল্য। ২০২১ সালের ১০ই জানুয়ারি ডলারের বিপরীতে আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। এক বছরের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ১ টাকা ২০ পয়সা।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, একদিকে দেশে প্রবাসীদের পাঠানো আয় কমছে। অন্যদিকে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। আমদানি খরচের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে করোনার টিকা। ফলে তিন মাস ধরে বাড়ছে টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম। অর্থাৎ দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে বাংলাদেশি টাকা। এ ছাড়া করোনার কারণে আমদানির অনেক এলসি’র অর্থ পরিশোধ বকেয়া ছিল। এখন সেগুলো পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ কারণে বাজারের ডলারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু রেমিট্যান্সে সেভাবে ডলারের জোগান বাড়েনি। এতে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত সপ্তাহে প্রতি ডলার বিক্রি করেছে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা দরে। এখন তা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ তৈরি করতে ডলারের দাম বাড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাচ্ছে তারাও নিজস্ব উদ্যোগে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করুক।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম বাড়ানোর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও এর দাম বাড়িয়েছে। নগদ ডলার এখন বিভিন্ন ব্যাংকে সর্বোচ্চ ৯০ টাকা ৯৫ পয়সা দরে বিক্রি হচ্ছে। আগে ছিল ৯০ টাকা ৫০ পয়সা। তবে কোনো কোনো ব্যাংক এর কমেও নগদ ডলার বিক্রি করছে। এ ছাড়া করোনার পর বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের চলাচল বেড়েছে। এ কারণে নগদ ডলারের চাহিদাও বেড়েছে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে প্রবাসীরা নগদ ডলার নিয়ে আসছেন কম। এ কারণে নগদ ডলারের সংকট প্রকট হয়েছে।
অন্যদিকে করোনার কারণে গত প্রায় দুই বছর আমদানির দেনা পরিশোধ স্থগিত ছিল। এখন সেগুলো পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোতে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। ফলে দামও বেড়েছে। এদিকে রপ্তানির সব আয় এখনো দেশে আসছে না। একই সঙ্গে গত ছয় মাস ধরে রেমিট্যান্স কমছে। গড়ে প্রায় ২১ শতাংশ কমেছে। ওদিকে আমদানি বেড়েছে। এসব মিলে ডলারের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম। ফলে দাম হু হু করে বাড়ছে। এদিকে কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ৯৫ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে।
সাধারণত ডলারের দাম বাড়লে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও রপ্তানিকারকরা লাভবান হন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমদানিকারক ও সাধারণ মানুষ। কারণ ডলারের দাম বাড়লে পণ্যের মূল্যও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এরই মধ্যে আমদানি করা অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, টাকার অবমূল্যায়ন হলে রপ্তানিকারকেরা সুবিধা পান। কিন্তু আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতিতে চাপ পড়ার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন কৃত্রিমভাবে ডলার কেনাবেচা করে পরিস্থিতি ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা করা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমদানি হঠাৎ বেড়ে গেছে। অপর দিকে কমে গেছে প্রবাসী আয়। মানুষ বিদেশভ্রমণ শুরু করেছে। যেসব আমদানি বিল বকেয়া ছিল, তা এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। তবে সে তুলনায় জোগান মিলছে না। এতে দাম বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে যেসব ব্যাংক ডলার বিক্রি করত, তারাই এখন কেনার জন্য আসছে। তাদের সতর্ক করা হয়েছে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। তারা আরও বলছেন, যখন বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বেশি ছিল তখন ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ১০ই জানুয়ারি পর্যন্ত সব মিলিয়ে ২৫০ কোটি (২.৫ বিলিয়ন) ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর আগে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার কেনায় রেকর্ড গড়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সব মিলিয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনে। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫.১৫ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছরের আগে সেটিই ছিল সর্বোচ্চ ডলার কেনার রেকর্ড। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রাজধানীর বিভিন্ন মানি চেঞ্জার ঘুরে দেখা গেছে, খোলাবাজারে প্রতি ডলার ৯০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। মানি চেঞ্জারগুলো কাস্টমারদের কাছ থেকে কিনছে ৮৯ টাকা ৮০ পয়সায়। খোলাবাজারে গত আড়াই মাস ধরেই ৯০ টাকার ওপরে ডলার বিক্রি হচ্ছে। আড়াই মাস আগে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৯ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা। কানাডিয়ান ডলারও ওঠানামা করছে। এখন প্রতি কানাডিয়ান ডলার বিক্রি হচ্ছে ৭৩ টাকা। ২০ দিন আগে ছিল ৭০ টাকা। ২০ দিনেই তিন টাকার বেশি বেড়ে গেছে। দিরহাম ২৪ টাকা ৩০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে।
মতিঝিলের প্রিমিয়াম মানি এক্সচেঞ্জের ইনচার্জ অংসু হাওলাদার বলেন, এখন ডলারের বাজার অস্থিতিশীল। এ বাজার স্থিতিশীল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। কারণ দেশের বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ডলারের সরবরাহ কম। ব্যাংক তাদের চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না। খোলাবাজারেও চাহিদা অনুযায়ী ডলারের সংকট। তাই যত দিন চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না বাড়বে, ততদিন ডলারের দাম কমবে না।
অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম. মুস্তফা কামাল বলেছেন, চড়া বাজারে দাম ওঠানামা করলেও ডলারের দাম খুব বেশি বাড়ার সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) তিন হাজার ১১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৫৪ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ২৩ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময় ছিল এক হাজার ২৯৪ কোটি ডলার। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২৭০ কোটি ডলার। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য রপ্তানি করে আয় করেছে ২ হাজার ৪৭০ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৪৭ কোটি ডলার বা ২৮.৪১ শতাংশ বেশি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status