প্রথম পাতা

দুই লাশের পাশেই পড়েছিলাম

ফাহিমা আক্তার সুমি

২৪ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ৯:২৮ অপরাহ্ন

দুই পায়ের হাড় ভেঙে গুঁড়ো ইলিয়াস ভূঁইয়ার (৪০)। মাথায় আঘাতের যন্ত্রণা। অচল পা ও শরীরের ব্যথা নিয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) বিছানায় কাতরাচ্ছেন। কিন্তু কে করাবে তার চিকিৎসা? কীভাবে তার ছোট দুই সন্তানের খরচ জোগাবে? রাজধানীর গুলিস্তানে টোল প্লাজার সামনে মেঘলা পরিবহনের একটি বাসের চাপায় আহত হন ইলিয়াস। তিনি পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এই পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য কোনো সহায়তা ও সাড়া পাননি।

যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ইলিয়াস কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি সুস্থ হতে চাই। শরীরের এত যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছি না। আমার ছোট দু’টি সন্তান আছে। বাবা-মা অনেক আগে মারা গেছেন। আমার কোনো ভাইও নেই। আমার সন্তানদের কে দেখবে? অর্থ কষ্টে ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারছি না। পায়ের হাড় ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে। কোনো শক্তি পাই না। ঘাতক বাস আমার সব কেড়ে নিলো। আমি কি আর কোনোদিন হাঁটতে পারবো না। প্রধানমন্ত্রী কি আমার দিকে একটু সুনজর দেবেন না? বাস কর্তৃপক্ষও এখন পর্যন্ত কোনো খবর নেয়নি আমার।

ইলিয়াস বলেন, ৮ই জানুয়ারি আমি গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার গাজিপুর থেকে বিআরটিসি বাসে ঢাকায় এসে পৌঁছেছি। গুলিস্তানে নেমে রাস্তা পারাপারের সময় দেখলাম মেঘলা নামের গাড়িটি উল্টাপাল্টা চলছে। এই অবস্থা দেখে সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে আমিও দৌড় দিয়েছি। ওই অবস্থায় আমি দৌড়ে সরে যেতে পারিনি। বাসটি এসে আমাকে চাপা দিয়েছে। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন পড়ছে বাসের নিচে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গুলিস্তানের টোলপ্লাজার সামনে ঘটনাটি ঘটে। গাড়ির নিচে পড়ে মাথায় বাড়ি খেয়েছি। দুই পায়ের রানের ওপর দিয়ে গাড়ির চাকা উঠে রানের হাড়গুলো ভেঙে গেছে। এমন অবস্থা হয়েছে পা তুলে উঠানোর মতো শক্তি আমার নেই। ওই অবস্থায় তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় আমাকে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠায়। তিনি আরও বলেন, আমি যখন বাসের নিচে ছিলাম আমার পাশের দু’জনই ছিলেন মৃত। আমি গুরুতর আহত তিনজনকে বেরনোর জন্য হাত দিয়ে ধাক্কাও দিয়েছি। আমার ডাকে কোনো সাড়া দেইনি তারা। তখন আমার একটু সেন্স ছিল। পাশে থাকা সবাই বলেছিল আমি মারা গিয়েছি। এই কথা শুনে তখন আমি হাত দিয়ে তাদের ইশারা দেই বলি আমি বেঁচে আছি। তখন তিনজন মিলে আমাকে বাসের নিচে থেকে টেনে বের করে পাশে ফেলে রেখেছে। এরপর রাস্তায় ১৫-২০ মিনিটের মতো পড়ে ছিলাম। কেউ কাছে আসেনি। খাবার জন্য পানি চেয়েছি অনেক বার কেউ একটু পানিও দেয়নি। পাশে থাকা কেউ আমাকে ধরতে আসেনি। পুলিশ এসে আমাকে বলে আস্তে আস্তে উঠে বসার জন্য। তারা সিএনজিতে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। কিন্তু তখন সিএনজিতে বসার মতো অবস্থা আমার ছিল না। পরে রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় একজন ভ্যানচালক আমাকে চিনে ফেলেন। তিনি তখন হাসপাতালে নিয়ে যান।

যন্ত্রণায় কাতর ইলিয়াস ভূঁইয়া বলেন, ২০০৫ সালে বাবাকে হারাই। বাবা মারা যাওয়ার পর আমিই পরিবারের হাল ধরি। তখন চলে আসি ঢাকায়। এরপর নবাবপুরে একটি ইলেকট্রিকের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করি। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। আমার কোনো ভাই নেই। ২০১৭ সালে মাও মারা যান। ৮ তারিখ থেকে এই পর্যন্ত হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি। পঙ্গু হাসপাতালের নতুন বিল্ডিংয়ের ৭৩৪ নম্বর বেডে আছি। পায়ের জোড়া আর মিলবে কি-না জানি না। আমি আর কোনোদিন হাঁটতে পারবো না। বামপায়ের বাটি নেই। এখন বাটি কিনে লাগাতে হবে। দুই পায়ের একপায়েও বল পাওয়া যায় না। ঠিকমতো কিছু খেতেও পারি না। পরিবহনের কেউ এই পর্যন্ত আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আমার বন্ধুরা ও কোম্পানি থেকে কিছু সহযোগিতা করেছে। বাকি চিকিৎসা খরচ কীভাবে করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রতিদিন ২ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। আমার ছেলে ও স্ত্রী সব সময় পাশে থাকে। ছেলের বয়স ১২ বছর ও মেয়ের বয়স ৩ বছর। আমি পঙ্গু হয়ে থাকলে ওদের লেখাপড়ার খরচ কীভাবে চালাবো? আমি সুস্থ হতে চাই। আমি ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে চাই। আমি যদি সুস্থ হই আমার ছেলেমেয়েকে দেখতে পারবো। না হলে ওরা এতিম হয়ে যাবে। ওদের দেখার কেউ নেই। সন্তানদের ভবিষৎ অন্ধকার করতে চাই না। আমার কোনো ভাইও নেই শুধু চার বোন আছে। ওদেরকে কে দেখবে। ঢাকার শনিরআখড়ায় থাকি। সরকারের কাছে আমি চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা চাই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status