শেষের পাতা

আপত্তিকর ছবি ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল

শুভ্র দেব

২৪ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ৯:২৭ অপরাহ্ন

এক হাতে সিগারেট। অন্য হাতে পিস্তল। সামনে ওয়াকিটকি। পরনে ফরমাল পোশাক। চুলে ক্যাজুয়াল কাট। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। কথা বলেন বাংলা- ইংরেজির মিশেলে। লেখাপড়া করেন নামিদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। মানুষকে পরিচয় দেন সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে। আদতে তিনি একজন বড় মাপের প্রতারক। নাম ফুয়াদ আমিন ইশতিয়াক ওরফে সানী। সহযোগীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের সঙ্গে ব্ল্যাকমেইল করেন। ছেলেদের সঙ্গে চক্রের মেয়ে প্রতারকরা আর মেয়েদের সঙ্গে চক্রের ছেলে প্রতারকরা সখ্য গড়ে তুলে কৌশলে তাদের আস্তানায় নিয়ে আসেন। পরে সেখানে ভুক্তভোগীকে নির্যাতন করেন। মারধর করে টাকা, মোবাইলসহ মূল্যবান সবকিছু কেড়ে নিয়ে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও তোলা হয়। পরে সেই ছবি ও ভিডিও দিয়ে ভুক্তভোগীর সঙ্গে করা হয় ব্ল্যাকমেইলিং। আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে চক্রটি মানুষকে হেনস্তা ও ব্ল্যাকমেইল করে আসছিল। তাদের সর্বশেষ শিকার ছিল এক ট্রান্সজেন্ডার নারী। ওই নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে বাসায় নিয়ে মারধর, শ্লীলতাহানী, যৌন নির্যাতন ও টাকা আদায় করা হয়। পরে ওই ভুক্তভোগী থানায় মামলা করেন। ওই মামলার ভিত্তিতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) চক্রের মূল হোতাসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে।

র‌্যাব জানায়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র?্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র?্যাব-১ এবং র?্যাব-২ এর যৌথ অভিযানে শনিবার রাত থেকে গতকাল দুপুর ১টা পর্যন্ত রাজধানীর ফার্মগেট ও মহাখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঘটনার মূল হোতা ফুয়াদ আমিন ইশতিয়াক ওরফে সানি (২১), সহযোগী সাইমা শিকদার নিরা ওরফে আরজে নিরা (২৩) ও আব্দুল্লাহ আফিফ সাদমান ওরফে রিশুকে (১৯) গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে ট্রান্সজেন্ডার নারীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া আইফোন উদ্ধারসহ জব্দ করা হয় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত অবৈধ ওয়াকিটকি সেট, খেলনা পিস্তল, মোবাইল ও অন্যান্য সামগ্রী।

র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ আফিফ সাদমান ওরফে রিশুর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হয় ট্রান্সজেন্ডার নারী বিউটি ব্লগারের। তাদের দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিন কথাবার্তা হয়। সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ হয়। একপর্যায়ে গত ১০ই জানুয়ারি রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের রেস্টুরেন্টে তারা দেখা করেন। এরপর ওই নারীকে সারপ্রাইজ দেয়ার কথা বলে কৌশলে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গ্রেপ্তার ইশতিয়াকের ভাড়া বাসায় নিয়ে যান রিশু। সেখানে আগে থেকে উপস্থিত ছিলেন ইশতিয়াক ও নিরা। বাসায় যাওয়ার পর তারা ৩ জন মিলে ট্রান্সজেন্ডার নারীকে মারধর শুরু করেন। পরে তাকে শ্লীলতাহানি ও যৌন নিপীড়নও করেন। পাশাপাশি যৌন নিপীড়নের ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন। পরে ওই নারীর কাছে থাকা মোবাইল ফোন, স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যান। ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে তার কাছে এক লাখ টাকাও দাবি করে তারা। ভয়ভীতি ও কারও কাছে মুখ খুললে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। তারা নিজেদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবেও পরিচয় দেয়। পরে ওই নারীকে থানায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর রামপুরা এলাকায় তাকে নামিয়ে দিয়ে তারা চলে যায়।

র‌্যাব জানায়, ভুক্তভোগী নারী একজন প্রতিষ্ঠিত কর্মজীবী। তিনি নিজ যোগ্যতা, অধ্যবসায় ও কর্মদক্ষতায় উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি দেশের প্রচলিত আইন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা থেকে স্ব-উদ্যোগে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি ভাটারা থানায় মামলা করেন। মামলা নম্বর-৩৫। মূলত এই নারীর কাছ থেকে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়ার জন্য ফাঁদ তৈরি করে রিশু। প্রতারক ৩ জনকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায় নিয়েছে। এছাড়া তারা আরও জানিয়েছে, তারা একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য। ইশতিয়াক চক্রের মূল হোতা এবং আরজে নীরা ও সাদমান আফিফ ওরফে রিশু তার অন্যতম সহযোগী। তারা বিগত প্রায় দুই বছর ধরে বিভিন্ন কৌশলে জিম্মি, ব্ল্যাকমেইল ও প্রতারণা করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষদের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে আসছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন জনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে। পরে ভুক্তভোগীদের কৌশলে তাদের বাসায় নিয়ে মারধর করে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে হেনস্তা ও ব্ল্যাকমেইল করে। এসব অপকর্মের জন্য তাদের ভাড়া বাসা ব্যবহার করে। ওই বাসায়ই জোরপূর্বক আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করা হতো।

র‌্যাব জানিয়েছে, এই চক্রের ৩ জনই নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের পারিবারিক অবস্থানও অনেক ভালো। ৩ জনের অভিভাবকরা সরকারি উচ্চ পদস্থ চাকরি করেন। চক্রের মূল হোতা ইশতিয়াক ও আরজে নিরা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। তিন মাস আগে তারা এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে করেছেন। তারা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে একই এলাকায় বসবাস করে আসছে। তাদের চেনাজানা দীর্ঘদিনের। ইশতিয়াক, নিরা ও রিশু মিলেই চক্রটি পরিচালনা করতো। গ্রেপ্তারের পর তাদের মোবাইল থেকে শ’ শ’ নারী-পুরুষের আপত্তিকর ছবি-ভিডিও উদ্ধার করা হয়েছে। এমনকি তাদের নিজেদেরও অনেক আপত্তিকর ছবি-ভিডিও তাদের মোবাইলে ছিল। প্রতারণার জন্য তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁদ পেতে রাখতো। নিজেরাই ফেসবুকে নতুন নতুন বন্ধু তৈরি করতো। পরে মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কৌশলে চক্রের ছেলেরা সখ্যতা তৈরির কাজ করতো। আর মেয়েরা গড়ে তুলতো ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে সখ্যতা। যারাই তাদের সঙ্গে কথা বলতো তাদের সঙ্গে উচ্চাভিলাসী কথাবার্তা, চলাফেরা করতো। দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়া, দামি গাড়িতে ঘোরাঘুরি করতো। এতে করে ভুক্তভোগীরা তাদের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হতো। ডেটিং বা বাসায় যাওয়ার কথা বললে কেউ না করতো না।

র‌্যাবসূত্র আরও জানায়, সমাজের বিত্তশালীদের টার্গেট করতো চক্রটি। যারা তাদের চাহিদামতো টাকা দিতে পারবে। প্রভাব বিস্তার ও মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য প্রতারকরা নিজেদেরকে সেনা কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিয়ে আসছিল। বিশ্বাসের জন্য তারা চুলের কাটিং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো রাখতো। আর ওয়াকিটকি ও নকল পিস্তল নিয়ে ঘুরতো। তাদের সঙ্গে থাকা পিস্তল দেখে বুঝার উপায় নাই এটি খেলনা পিস্তল। এর আগেও প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলের শিকার অনেক মানুষ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ইশতিয়াকের বিরুদ্ধে আগে থেকেই দুটি মামলা ছিল। গ্রেপ্তার ৩ জনই প্রতারণার টাকায় দামি বাসায় থাকতো। বিলাসী জীবনযাপন করতো। ইয়াবা সেবনের পাশাপাশি বিদেশি ব্যান্ডের মদে ডুবে থাকতো। নিয়মিত ডিজে পার্টিতে অংশগ্রহণ করতো। চলাফেরা করতো বেপরোয়াভাবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status