শেষের পাতা

গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের অর্থায়ন নিয়ে বিতর্ক

কাজী সোহাগ

২৩ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ৯:২৫ অপরাহ্ন

গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটি, সচিব ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু সমাধান বের করতে পারেননি। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ পরামর্শ দিয়েছেন সরকারের তহবিল থেকে টাকা নিতে। এজন্য ব্যয় হবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি তিনি অন্য উৎসের কথাও তুলে ধরেন। সংসদীয় কমিটি বলেছে, গ্যাস কোম্পানিগুলো বকেয়া বিল আদায় করে মিটার স্থাপন করতে পারে। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেন, গ্রাহকের জামানত হিসেবে যে টাকা রয়েছে তা দিয়েও মিটার স্থাপন করা যেতে পারে। পাশাপাশি সরকারি তহবিল থেকে টাকা নেয়া যেতে পারে। আবার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেও সহায়তা নেয়ার প্রসঙ্গ উঠেছে। সবমিলিয়ে মিটার স্থাপনের অর্থায়ন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা প্রকট আকার ধারন করেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২১তম বৈঠকের কার্যবিবরণীতে এ বিতর্কের কথা তুলে ধরা হয়েছে। পেট্রোবাংলার আওতাধীন ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির গ্রাহক সংখ্যা ৪২ লাখ ৩১ হাজার ২৩১। ২০০৭ সন থেকে শুরু করে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির আওতায় ২ লাখ ১৩ হাজার এবং কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির আওতায় চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় ৬০ হাজার প্রি-পেইড মিটারসহ মোট ২ লাখ ৭৩ হাজার প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে ৩ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ প্রি-পেইড মিটার স্থাপন কার্যক্রম চলমান আছে। সংসদীয় কমিটি জানিয়েছে, সব খাত থেকে চেষ্টা করলে ২০২৩ সালের মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ লাখের কাছাকাছি প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা সম্ভব হবে। মিটার স্থাপন নিয়ে এডিবি’র সঙ্গেও আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছে সংসদীয় কমিটি। এ প্রসঙ্গে বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এডিবি’র সঙ্গে আলোচনা এখনো শেষ হয়নি। আলোচনা শেষে কনসালটেন্ট নিয়োগসহ টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি ও মূল্যায়ন করতে প্রায় আড়াই বছর সময় প্রয়োজন হবে। এর আগে কনসালটেন্ট নিয়োগ শুরু হবে না। গত ৭ বছরে ৩ লাখ মিটার স্থাপন সম্ভব হয়েছে। সেক্ষেত্রে ২৭ লাখ মিটার লাগাতে কত সময় লাগবে তা সহজেই অনুমেয়। প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখে করে তিনি বলেন, যেহেতু প্রি-পেইড মিটার স্থাপন একটি লাভজনক প্রকল্প, তাই সরকারের তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে তা করা যেতে পারে। পায়রা প্রকল্পে ট্রান্সমিশন লাইনের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া হচ্ছে। উন্নয়ন সহযোগীদের টাকা নিয়ে ২৭ লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে যে সময় লাগবে ততদিনে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে এবং নতুন প্রযুক্তি আসতে পারে। পাশাপাশি প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন কোম্পানির আওতায় বিভিন্ন ভাগে মিটার লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি ফান্ডের জন্য এডিবি’র উপর পুরোপুরি নির্ভর না করে অন্য উৎস খোঁজার কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি জার্মানভিত্তিক সংস্থা কেএফডব্লিউ ছাড়াও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এশিয়ান ইনফ্রাসট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) প্রভৃতি উৎসের কথা বলেন। এরপরই সংসদীয় কমিটির সভাপতি ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, ২০২৩ সালের মধ্যে দৃশ্যমান পরিমাণের প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করতে হবে এবং প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে সঠিক টেকনোলজি বাছাই করতে হবে যাতে টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও গ্যাস সরবরাহ বজায় না থাকে। তিনি বলেন, যে মিটারের প্রযুক্তি কোনো রকেট সাইন্স না। বাংলাদেশে অনেক প্রতিভাধর লোক আছে। মিটারের জন্য বিদেশ থেকে যে প্রযুক্তি আনা হবে তা দেশেও তৈরি করা সম্ভব। তিনি সেই সক্ষমতার দিকে মনোনিবেশের জন্য বলেন। এতে মিটার স্থাপনের ব্যয়ও হ্রাস পাবে। অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান বলেন, গ্রাহকের জামানত হিসেবে ৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা আছে। এর মধ্যে তিতাসের নিজস্ব তহবিলের ২২৮০ কোটি টাকা থেকে তিতাসের ৩টি প্রকল্পের জন্য ১৫০০ কোটি টাকা বাদ দিয়ে যে অবশিষ্ট টাকা থাকে তা দিয়ে ২ লাখ মিটার স্থাপন সম্ভব। পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে ১ লাখ ২৮ হাজার প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের বিষয়টি ইতিমধ্যেই তাদের বোর্ডে অনুমোদিত হয়েছে। সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানিও তাদের নিজস্ব অর্থায়নে মিটার স্থাপন করতে সক্ষম হবে। কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি তাদের নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ৬ লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করতে পারবে। কিন্তু, তিতাসের গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখের বেশি। এ কারণে তাদের প্রি-পেইড মিটার স্থাপনই বড় সমস্যা। সেক্ষেত্রে মন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক হতে অর্থ চাওয়া যেতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। এ সময় মন্ত্রী বলেন, তিতাসের ৭ হাজার কোটি টাকা গ্যাস বিল বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে ৪,০০০ কোটি ব্যয় করলেই সকল মিটার স্থাপন সম্ভব। এ টাকায় অগ্রিম মিটার লাগানো সম্ভব হলে টাকাটা আগে জমা হতো। কিন্তু সেখানে বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ প্রেক্ষিতে সংসদীয় কমিটির সভাপতি বলেন, বকেয়া বিলের নিশ্চয় একটা তালিকা আছে যার মাধ্যমে জানা গেছে ৭ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। তিনি এ সকল বিল আদায়যোগ্য কি না এবং এগুলোর কোনো এগিং করা আছে কি না তা জানতে চান। জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এবিএম আবদুল ফাত্তাহ জানান, ওভাবে এগিং করা নেই। তবে যেগুলো বকেয়া আছে তার সবগুলোই কোর্টে মামলাধীন রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় গ্রুপের কাছে ৫০০ কোটি টাকার অধিক বকেয়া আদায়ের বিষয়ে আদালতের রায় পাওয়া গেছে। গ্রুপটি রায়ের বিপরীতে আপিল করলেও আশা করা যায় তা আদায় করা সম্ভব হবে। সরকারের কাছ থেকে কত টাকা পাওয়া যাবে সভাপতির এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান যে সরকারের কাছে ২ হাজার কোটি টাকা বকেয়া আছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতি বলেন, সরকারের কাছে প্রাপ্য ২ হাজার কোটি টাকা বকেয়া আদায় করলে তা মিটার স্থাপনে ব্যবহার করা যাবে। সেক্ষেত্রে জিওবি বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পৃথক ফান্ড প্রয়োজন হবে না। তিনি উক্ত টাকা আদায় করার জন্য বলেন। জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জানান যে, সরকারি সংস্থা থেকে বকেয়া আদায়ের বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকবৃন্দ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করছেন এবং সাড়াও পাচ্ছেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাছে ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বকেয়া আছে। ইতিমধ্যে কিছুটা পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি টাকা চলতি অর্থ বছরের মধ্যেই পরিশোধ করা হবে বলে চট্টগ্রামের মেয়র আশ্বস্ত করেছেন। বৈঠকের কার্যবিবরণী অনুযায়ী আলোচনায় অংশ নিয়ে বগুড়া-৩ আসনের এমপি নুরুল ইসলাম তালুকদার বকেয়া ৭ হাজার কোটি টাকা আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন প্রদান সাপেক্ষে কোনো এজেন্সি নিয়োগ করা যায় কি না সে বিষয়টি বিবেচনার জন্য বলেন। বকেয়া আদায়ে মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, মামলা করার আগে আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন। মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা পরিহারের জন্য একটি সময় বেঁধে দিয়ে আইনটি সংশোধন করা যেতে পারে। অন্যথায় মামলা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলমান থাকবে। প্রি-পেইড মিটারের বিষয়ে তিনি বলেন, এলাকাভিত্তিক সরকারিভাবেই প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ মিটার কিনতে চাইবে না। বৈঠকে মুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা) বলেন, তিতাস ও কর্ণফুলীর অবকাঠামো থাকায় তারা খুব দ্রুত মিটার স্থাপনে সক্ষম হবে। তবে পশ্চিমাঞ্চলসহ অন্যান্য কোম্পানির অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। পশ্চিমাঞ্চলের গ্রাহক জামানতের ৮০ কোটি টাকা ইতিমধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য ইনফ্রাসট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলেশন কোম্পানী (আইআইএফসি)কে  দেয়া হয়েছে। ২ মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়া হলে কাজ শুরু হবে। বৈঠকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম-সচিব (পরিকল্পনা) জানান, গ্রাহকদের জামানতের ৩৬৯৮ কোটি টাকার মধ্যে তিতাসের আছে ২২৮০ কোটি টাকা। এ টাকায় প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তিতাসের নিজস্ব অর্থায়নে জয়দেবপুর হতে ময়মনসিংহ, জয়দেবপুর হতে টাঙ্গাইল এবং টাঙ্গাইল হতে মানিকগঞ্জ হয়ে সাভার পর্যন্ত ৩টি প্রকল্পের জন্য ১৭০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে ২২৮০ কোটি টাকা থেকে ১৭০০ কোটি টাকা প্রকল্প ৩টিতে ব্যয় করলে যা অবশিষ্ট থাকে তার পরিমাণ অপ্রতুল হওয়ায় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে যেতে হয়েছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতি বলেন, মিটার স্থাপনের ক্ষেত্রে এখন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও ছয় মাস পর প্রযুক্তির আরও উন্নয়ন ঘটবে। সেক্ষেত্রে সেই প্রযুক্তির দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সরবরাহকারী পুরানো মিটার গছিয়ে দিলে পরবর্তীতে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। তখন মিটার প্রতিস্থাপন করার সুযোগ থাকবে না। তাই মিটারের মূল্য, গুণগত মান এবং প্রযুক্তির বিষয় বিবেচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি বলেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status