শেষের পাতা

অনিয়ন্ত্রিত বাজার দিশাহারা মানুষ

আলতাফ হোসাইন

২২ জানুয়ারি ২০২২, শনিবার, ৯:৪৫ অপরাহ্ন

বছর দু’য়েক ধরেই চরম অস্থিতিশীলতার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজার। প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম এখনো চড়া। যথাযথ তদারকির অভাবে আরও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে বাজার। বেড়েই চলেছে চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ অধিকাংশ পণ্যের দাম। তুলনামূলক দাম বেশি হওয়ায় চাহিদামতো খাদ্যপণ্য কিনতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। দফায় দফায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারছেন না তারা। জীবনযাপনের অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপে যেন চিঁড়েচ্যাপ্টা নিম্ন্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।
রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও কাওরান বাজারসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, পিয়াজসহ প্রায় সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। শীতের সবজির সরবারহ বেড়েছে। ফলে দাম নাগালের মধ্যে রয়েছে।
করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাক্কার ফলে দেশের অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গিয়েছিল। সেই প্রভাব এখন পর্যন্ত অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এ অবস্থায় নতুন করে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকলে আরও বিপাকে পড়বেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। তাছাড়া চাহিদার তুলনায় পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ কম থাকার কারণে দাম বাড়ছে। তবে ক্রেতাদের দাবি, অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেই পণ্যের দাম বাড়ছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর থেকে বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। পরিবহনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বাড়ছে বলে মনে করেন তারা।
কাওরান বাজারে চাল বিক্রেতারা জানান, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের চাল। ভরা মৌসুমেও ক্রেতার নাগালে ছিল না চালের দাম। বরং দফায় দফায় আরও বেড়েই চলেছে। চলতি আমন মৌসুমে নতুন ধান উঠলেও দাম কমেনি। উল্টো বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। এর জন্য চালকল মালিকদের কারসাজিকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সরকারের যথাযথ তদারকির অভাবে সিন্ডিকেটকারীদের দৌরাত্ম্য থামছে না।
কাওরান বাজারের চাল বিক্রেতাদের তথ্যমতে, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৪ টাকায়। আর নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬৬ থেকে ৭২ টাকা। আটাশ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়, পাইজাম (স্বর্ণা) ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা এবং পাইজাম (গুটি) ৪৩ থেকে ৪৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জনতা রাইস এজেন্সির আবু ওসমান বলেন, ভরা মৌসুমেও চালের দাম কমেনি। উল্টো দাম আরও বেড়েছে। কয়েকদিন আগে কেজিতে ১-২ টাকা কমলেও আবারও ৩-৪ টাকা করে বেড়ে গেছে। অনেকদিন ধরেই এভাবে চলছে। মিলমালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ায় এটা সবাই জানে। কিন্তু সরকারের মনিটরিং নেই। মালিকরা ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়। এখানে আমাদের মতো সাধারণ ব্যবসায়ীদের কিছু করার নেই।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, শুধু চাল নয়, দাম বেড়েছে ডাল, আটা, ময়দা, চিনিরও। বর্তমানে মানভেদে প্রতিকেজি দেশি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, গত সপ্তাহে যা ছিল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। এছাড়া মোটা দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা, ছোলা ৭০ থেকে ৭৫ টাকা, মুগের ডাল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা, বুটের ডাল ৮০ থেকে ৮৫ টাক। এক মাস আগেও ৭০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া খোলা চিনি এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৬ টাকায়। প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায়, যা মাসখানেক আগেও ছিল ৭৫ টাকা। এছাড়া বর্তমানে দুই কেজি আটার প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা এবং ময়দা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। অথচ এক মাস আগেও দুই কেজি আটার প্যাকেট ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং ময়দার প্যাকেট ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-এর (টিসিবি) হিসাবেই, গত এক মাসের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ১.৫৯ শতাংশ, আর এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৭.৫৬ শতাংশ। এক মাসে মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ৬.৮ শতাংশ এবং বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৪.৭৬ শতাংশ। এছাড়া মোটা চালের দাম এক মাসে বেড়েছে ২.১৫ শতাংশ আর এক বছরে বেড়েছে ৬.৭৪ শতাংশ। টিসিবি’র হিসাবে এক মাসের মধ্যেই দেশি মসুর ডালের দাম বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ আর এক বছরে বেড়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ। এক বছরে মোটা দানার মসুর ডালের দাম বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪৪ শতাংশ, আর এক মাসেই বেড়েছে ১১ শতাংশ। এক বছরে আটা ও ময়দার দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩৯ শতাংশ। টিসিবি’র তথ্যমতে গত এক বছরে প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ২৫.৭৬ শতাংশ এবং পাম অয়েলের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এক বছরে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
বর্তমান বাজারে প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ টাকা এবং পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা। এছাড়া পুষ্টি ব্র্যান্ডের পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৭২০ টাকা, বসুন্ধরা ব্র্যান্ডের ৭২০ টাকা, তীর ব্র্যান্ডের ৭৪০ টাকা এবং রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের ৭৫০ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, ডিলারদের কাছ থেকে বাড়তি দামে কিনে আনতে হয়, তাই তারাও নিরুপায় হয়ে বেশি দামে বিক্রি করেন। আগে এক ড্রাম তেলের দাম ছিল ৩০ হাজার ১০০ টাকা। এখন প্রতি ড্রাম কিনতে হয় ৩০ হাজার ৬০০ টাকায়।
ওদিকে শীতকালে সবজির বাজার অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। কিন্তু এবার শুরু থেকেই চড়া। ২ দিন ধরে বাজারে সবজির দাম স্থিতিশীল। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি নতুন আলু ৩০ থেকে ৪০ টাকা, কচুরমুখী ৪০ থেকে ৫০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, শিম ৪০ থেকে ৫০ টাকা, শালগম ৩০ থেকে ৪০ টাকা, মুলা ৩০ টাকা, করলা ৭০ থেকে ৯০ টাকা, গাজর ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, টমেটো ৩০ থেকে ৪০ টাকা, বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকা, পেঁপে ২০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, কাঁচামরিচ ৫০ টাকা, প্রতিপিস ফুলকপি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, বাঁধাকপি ৩০ থেকে ৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা, দেশি রসুন ৫০ টাকা, ভারতীয় রসুন ১২০ টাকা, দেশি আদা ৮০ টাকা, চীনা আদা ১১০ টাকা।
এদিকে বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম চড়া। বর্তমানে প্রতি কেজি বয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা, সোনালি জাতের মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৭০ টাকা, লেয়ার ২৩০ টাকা এবং কক ২৫০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় মুরগির দাম কিছুটা কমলেও এখনো ক্রেতাদের হাতের নাগালে আসেনি। কারণ রাজধানীর বাজারগুলোতে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয় ১১০ থেকে ১২০ টাকা, সোনালি জাতের মুরগি ২২০ থেকে ২৪০ টাকা এবং লেয়ার ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়।
দাম বাড়ার বিষয়ে বিক্রেতারা বলছেন, শীতকালে মুরগির উৎপাদন কিছুটা কম হয়। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় এখন দাম একটু বেশি। মুরগির পাশাপাশি দাম বেড়েছে ডিমেরও। ফলে যারা মাংসের পরিবর্তে ডিম কিনতেন তাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি হালি মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা এবং হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। এছাড়া গরুর মাংস সব সময়ই সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status