প্রথম পাতা

ইভিএম বিড়ম্বনা

নূরে আলম জিকু, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে

১৭ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ৯:৩২ অপরাহ্ন

উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এ বছর প্রথমবারের মতো প্রতিটি কেন্দ্রে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডিজিটাল এ পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ করা হলেও ছিল বিড়ম্বনা। এতে দিনভর ভোগান্তির শিকার হয়েছেন ভোটাররা। ইভিএম যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিপাকে পড়েছেন প্রিজাইডিং কর্মকর্তারাও। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবস্থান করেও ভোট দিতে পারেননি অনেকে। ভোটারদের অভিযোগ- ইভিএম ঠিকমতো কাজ না করায় ৪-৫ ঘণ্টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। কিছু কিছু কেন্দ্রের ভোটাররা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়েও ভোট দিতে পারেননি। এতে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে ফিরে গেছেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ৭টা। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ড সিদ্ধিরগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাহিরে ভোটার, প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের সমাগম। সড়কের ওপরে টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে ভোটারদেরকে স্লিপ দিচ্ছেন অনেকে। কেন্দ্রের গেট খুলে দিলেন পুলিশ। ভোটাররা কেন্দ্রে প্রবেশ করে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ততক্ষণে লাইনে দাঁড়িয়েছেন শতাধিক ভোটার। কেন্দ্রে ও কেন্দ্রের বাহিরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নেতাকর্মীরা। ভোটগ্রহণের ১৫ মিনিটের মাথায় ভোট দিয়েছেন ৪ জন। ভোট কক্ষে সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা ইভিএম নিয়ে বসে আছেন। ভোটারও আছেন। ভোটদানের ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন কাজ করছে ধীর গতিতে। আবার ভোটারদের হাতের ছাপ মিলছে না। এতে ভোটদান সম্পন্ন করতে পারছেন না তারা। প্রায় ৩০ মিনিট পর ইভিএম প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হলে কয়েকজন ভোট প্রদান করেন। এ কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছিলেন হারুন ও সাগর। লাইনের প্রথমে দাঁড়িয়েও ভোট দিতে পারেননি তারা। কথা হলে তারা বলেন, মেশিনের মাধ্যমে ভোট নিচ্ছে। হাতের আঙ্গুল (ছাপ) কাজ করে না। অনেক চেষ্টা করেছেন কর্মকর্তারা। কোনো লাভ হয়নি। ভোট না দিয়েই চলে যাচ্ছি। এর আগের বছরগুলোতে ভোট দিয়েছি, কোনো সমস্যা হয়নি। এবার মেশিনের কারণে আমাদের ভোট দেয়া হলো না। পানি উন্নয়ন বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মো. নাজিম উদ্দিন ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, অনেকের আঙ্গুলের রেখা কাজ করছে না। যারা এই সমস্যার কারণে ভোট দিতে পারছেন না, দুপুর ৩টার পর বিকল্প পদ্ধতিতে তারা ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন।
হাজী ফজলুল হক মডেল হাইস্কুলে ভোট দিতে আসেন গার্মেন্টকর্মী রোকসানা। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন। ইভিএম-এ ভোটগ্রহণ করছে। মেশিনের মাধ্যমে ভোট দিলে তো তাড়াতাড়ি হওয়ার কথা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রৌদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। লাইন থেকে ভোটার টানছে না। শুনেছি মেশিন স্লো হয়ে গেছে। ভেতরে যারা ঢুকছেন তারাও ভোট দিতে পারছেন না। বাসায় ছোট ছোট বাচ্ছাদেরকে রেখে এসেছি। আর কত সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় জানি না। আমার ভোট কি দিতে পারবো? জমিলা খাতুন। বয়স ৫০-এর কাছাকাছি। ভোট দিতে এসেছেন। লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে পারবেন কি-না এ নিয়ে শঙ্কিত তিনি। মানবজমিনকে তিনি বলেন, বাটনে টিপ দিলে কি ভোট হবে? আমার পছন্দের প্রার্থী কি ভোট পাবে। ২০ বছর ধরে ভোট দিয়ে আসছি একভাবে। এবার কি এক নতুন সিস্টেম চালু হয়েছে। এসব আগে দেখিনি। বুঝিও না। একই শঙ্কা শুকতারা বেগমের। তিনি বলেন, আগে অনেক ভোট দিয়েছি, এমনটা দেখিনি। ৩০ মিনিট ধরে একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু লাইন সামনে যাচ্ছে না। শুনেছি মেশিনে ভোট দিতে অনেক সময় লাগে। অনেকে ভোট না দিয়ে চলে গেছেন। আমি ভোট দিতে পারবো কি-না জানি না। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ডে মহিলা ভোট কেন্দ্রে এভাবেই কথা বলেন ভোটাররা। প্রিজাইডিং অফিসার হাসান মোর্তজা মানবজমিনকে বলেন, বয়স্ক ভোটারদের নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। তারা এ বিষয়ে অভ্যস্ত না। তবে আমরা তাদেরকে শিখিয়ে দিচ্ছি। ভোট দিতে সাহায্যও করছি। যাদের আঙ্গুলের ছাপ মিলছে না তাদেরকে ভ্যাসলিন দিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। দুপুর ১২টা। সিদ্ধিরগঞ্জ উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ভোটারদের ভিড়। ভোটার উপস্থিতির কারণে পুরো রাস্তায় তিল পরিমাণ ঠাঁই নেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়। ৯টি দীর্ঘ লাইন। ভোটাররা দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন। কেউ কেউ চিৎকার করছেন। লাইন থেকে ভেতরে ভোটার ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। বিষয়টি জানার চেষ্টা করলে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, ইভিএম এর যান্ত্রিক ক্রটি দেখা দিয়েছে। ঠিকমতো কাজ করছে না। এজন্য ভোট নিতে সময় লাগছে। অনেক সময় আঙ্গুলের ছাপ মিলছে না। অন্যান্য সময়ের মতো দ্রুত ভোট নিতে না পারায় ভোটারদের ভিড় জমে গেছে। এখানে ইসির টেকনিশিয়ান আছেন, তারা বিষয়টি দেখছেন। এ সময় কয়েকজন ভোটার বলেন, ভোট দিতে এসে দুর্ভোগে পড়েছি। অন্য সময় ভোটার থাকে না। এবার ভোটার আছে। ভোট দিতে না পেরে সবাই চলে যাচ্ছেন। এত কষ্ট করে কি ভোট দেয়া যায়? নূর হোসেন নামের এক ভোটার বলেন, জরুরি কাজ রেখে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসলাম। ভোটার স্লিপ নিয়ে ২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটকক্ষে প্রবেশ করেছি। হাতের ছাপ মিলেছে। ছবিও দেখতে পাইছি। গোপন কক্ষে ভোট দিতে গিয়েছি। তবে এই ভোটের যন্ত্রের আমি কিছু বুঝিনি। পরে মেশিন স্পর্শ না করেই বের হয়ে আসছি। শুনেছি আমার মতো এমন অনেকের হয়েছে। মহিলারা তো বুঝে না বুঝে মেশিনে টিপ দিয়ে আসছে।  ইভিএমএর যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা। তারা বলছেন, প্রতিটি কেন্দ্রে একাধিক ইভিএম মেশিন দিয়েছে। তবে মেশিন স্লো হওয়ার কারণে সময় নষ্ট হয়েছে। এতে ভোগান্তি বেড়েছে ভোটারদের। এ নিয়ে কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রার্থীর চাপও সামাল দিতে হয়েছে। আমাদের কিছু করার নেই। এ জন্য লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে ভোট না দিয়ে ফিরে গেছেন বলে শুনেছি। এদিকে নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ভোটাররা বলছেন- প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যাপক টাকা ব্যয় করেছে। অথচ এই সময় তারা যদি ভোটারদেরকে ইভিএম সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতেন তাহলে ভোটকক্ষে ভোটারদের অসুবিধা হতো না। যারা ভোট দিতে এসেছেন তাদের অনেকেই প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেননি। তাদের ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়নি। ইভিএম সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় তারা উল্টাপাল্টা ভোট দিয়েছে। অনেকে প্রার্থীর প্রতীকের পাশের বাটনে চাপ প্রয়োগ করলেও পরবর্তীতে নীল বাটন কিংবা নিশ্চিতকরণ করেননি। এতে তাদের ভোট কাউন্ট হয়নি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ভোট কেন্দ্রেই এমন তথ্য মিলেছে। শিমরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কথা হয় ইভিএম টেকনিশিয়ান কেএম তসলিমের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, এই কেন্দ্রে ৭টি কক্ষে ৭টি ইভিএম মেশিনে ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন থেকে ১০টি মেশিন দেয়া হয়েছে। তবে এখানে ইভিএম নষ্ট হয়নি। কিছুটা স্লো গতিতে কাজ করছে। আঙ্গুলের ছাপ মেলাতে সময় লাগছে। এতেই লাইন দীর্ঘ হয়েছে। বিশেষ করে বয়স্ক ও নারীদের অনেকে এই পদ্ধতিতে ভোটদানে সমস্যায় পড়ছেন।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার ইভিএম বিড়ম্বনার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট হলেও ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নিয়ে কিছুটা বিড়ম্বনায় ছিল ভোটাররা। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়বে এই নির্বাচনে। ইভিএম বিড়ম্বনার কারণে কিছুটা কমেছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status