মত-মতান্তর
মনিরা খাতুনের পেটে ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি এবং ফরিদপুর মেডিকেলে জীন-ভূতের আছর
যুক্তরাজ্য থেকে ডাঃ আলী জাহান
২২ ডিসেম্বর ২০২১, বুধবার, ৬:৩১ অপরাহ্ন

১. সুদূর আমেরিকার অঙ্গরাজ্য টেক্সাসের ডালাস থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক চিকিৎসক আমাকে ই-মেইল করেছেন। সবিনয়ে জানতে চেয়েছেন জীন-ভূতের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। ই-মেইলটা পড়ে কিছুটা ভড়কে গেলাম। এটি সত্য যে মাঝেমধ্যে আমি জীন-ভূত-পেত্নী নিয়ে লেখালেখি করি। কিন্তু জীন-ভুতের সাথে আমার সম্পর্ক আছে কিনা এমন প্রশ্নে কিছুটা বিব্রত এবং অবাক হলাম।
২. ডালাসে বসবাসরত সে ডাক্তার সাহেব ই-মেইলের নিচে একটা অ্যাটাচমেন্ট জুড়ে দিয়েছেন।এটাচমেন্টটি আমাকে পড়ার এবং পড়ে মন্তব্য করার অনুরোধ করেছেন। আমি সেই অ্যাটাচমেন্ট ওপেন করে পড়লাম। আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি ডাক্তারের প্রশ্নটিই বোঝার চেষ্টা করলাম। কেন তিনি জীন-ভূতের প্রতি হঠাৎ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন তা পরিষ্কার হতে শুরু করলো।
৩. সব সম্ভবের এই দেশে গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার ১৮ বছর বয়সী মনিরা খাতুনের সাথে নিশ্চয়ই জীন-পরীর কোনো শত্রুতা ছিল। সেই জীন-পরী চায়নি মনিরা অপারেশন করে সুস্থ হয়ে উঠুন। ২০২০ সালের ৩ মার্চ ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে মনিরার পেটে যে অপারেশন করা হয়, সে অপারেশনের সময় তারই শত্রু কিছু জীন এসে মনিরার পেটের ভেতর ৬ ইঞ্চি লম্বা ছুরি (artery forcep) অপারেশন থিয়েটারে থাকা সকলের অগোচরে রেখে যায়। অপারেশনের দায়িত্বে থাকা ৩/৪ জন সার্জন, নার্স, ওটি বয়, এনেসথেসিস্ট কেউই তা খেয়াল করেননি। যখন খেয়াল করেছেন তখন ২১ মাস চলে গেছে! এর ভেতরে মনিরার জীবন তছনছ হয়ে গেছে। ২১ মাস ধরে তিনি অসহ্য ব্যাথা সহ্য করেছেন। বিশ্বমানের চিকিৎসা প্রদানকারী দেশের বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন। ওনার পেটের মধ্যে যে ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি আছে তা ধরতে ধরতে একুশটি মাস চলে গেছে! তাও কপাল ভালো ২১ বছর লাগেনি!
৪. বিশ্বমানের চিকিৎসা প্রদানকারী (বাংলাদেশি ডাক্তারদের পেশাজীবী সংগঠন বিএমএ এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিছুদিন ধরে এই দাবি করেছেন) দেশের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা মাত্র ২১ মাস সময় নিয়েছেন এই ব্যাপারটি বুঝতে যে মহিলার পেটে ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি রয়েছে। আর এই ভয়াবহ কাজটি সম্পন্ন করেছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা। উনারা বুঝতে পেরেছেন যে কাজটি সম্ভবত সঠিক হয়নি তাই ২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর এই হাসপাতলে অস্ত্রোপচার করে মনিরার পেট থেকে কাঁচি বের করা হয়। বিশ্বমানের এই অপারেশন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিবাদন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, যিনি কয়েকদিন আগেও দাবি করেছেন যে বাংলাদেশের বিশ্ব মানের চিকিৎসা হচ্ছে, ইচ্ছে করলে এই অভিবাদনের অংশীদার হতে পারেন।
৫. মনিরার পেটে কাঁচি রেখে কে তাঁর পেট সেলাই করে দিল? এই রহস্য উদঘাটনের জন্য স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের বিখ্যাত ডিটেকটিভ শার্লক হোমস এবং ডাক্তার ওয়াটসনকে ডাকতে হয়নি। এই জটিল রহস্যের(!) মূল ঘটনা উদঘাটন করেছেন ওই হাসপাতালের গঠিত তদন্ত কমিটি যার নেতৃত্বে ছিলেন সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামরুল হাসান এবং গাইনি বিভাগের অধ্যাপক কানিজ ফাতেমা ও সার্জারি বিভাগের মোঃ কামরুজ্জামান। এই কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ২১.১২.২১ মঙ্গলবার।
৬. তদন্ত কমিটির রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে হাসপাতালের পরিচালক সাইফুর রহমান একটি বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে ওই অপারেশনের সময় ৩/৪ জন ডাক্তার অংশ নিয়েছিলেন। তদন্ত কমিটি অপারেশন সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি। তিনি আরেক কদম সামনে গিয়ে বলেছেন যে উন্নত দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। তিনি যেটি বলেননি কিন্তু ইশারা-ইঙ্গিতে বলেছেন তা হচ্ছে এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে ঘটলে কোনো সমস্যা নেই। রিপোর্টের কোথাও উল্লেখ নেই যে, ভুল চিকিৎসার শিকার মনিরা খাতুনের পরিবারের কাছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করেছেন অথবা তাদের কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন।
৭. যেহেতু অপারেশনের সঙ্গে ৩/৪ জন সার্জন জড়িত ছিলেন, তাদের কেউ একজন অথবা সম্মিলিতভাবে তাঁরা সবাই এই অপরাধ/ভুল (medical negligence) করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে ওই দিন অপারেশনে মোট কতজন ডাক্তার অংশ নিয়েছিলেন তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। বলা হচ্ছে তিন থেকে চারজন ডাক্তার! যদি ওনারা রোগীর পেটের ভেতরে এই ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি না রেখে থাকেন তাহলে কি কোনো ভূত এসে এই কাঁচি রেখেছিল?
৮. ডালাস প্রবাসী ডাক্তার সাহেবের মন্তব্য-যেহেতু অপারেশনের সময় কোনো ডাক্তার মনিরার পেটে কাঁচি ( ৬ ইঞ্চি লম্বা artery forcep) রাখেননি (তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে) নিশ্চয়ই তা ভূতের কাণ্ড। জীন ভূত ছাড়া কেউ এ কাজ করতে পারে না! প্রশ্ন হচ্ছে যে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ভূত ঢুকলো কীভাবে? আর কেনই বা সেই ভূত মনিরার মতো অসহায় একটি মেয়ের পেটের মধ্যে অপারেশনের সময় কাঁচি রেখে দিল?
৯. আমরা যারা ডাক্তারি পেশার সাথে জড়িত তাদের ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ডায়াগনোসিস করার সময় ভুল হতে পারে। চিকিৎসা প্রদানের সময় ভুল হতে পারে। অপারেশন করার সময় ভুল হতে পারে। ওষুধ খেয়ে বা অপারেশনের সময় সময় রোগী মারা যেতে পারে। অপারেশনের পরে বিভিন্ন জটিলতায় রোগী মারা যেতে পারে। কিন্তু সেই ভুলের মাত্রা কতটুকু?কতটুকু ভুল হলে হাসপাতাল এবং ডাক্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে? বাংলাদেশে কি এরকম কোনো গাইডলাইন আছে? আইন আছে? আইনের প্রয়োগ আছে?
১০. পশ্চিমা বিশ্বে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে এবং ঘটছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটার পরে কী ঘটে? তদন্ত কমিটির সে ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেননি। ইচ্ছে করে দেননি নাকি উনারা জানেন না? উন্নত বিশ্বে এ ধরনের অবহেলার ঘটনা ঘটলে পরবর্তীতে কী ঘটে তার বর্ণনা যদি তদন্ত কমিটি দিতেন তাহলে তাঁরা ফেঁসে যেতেন। নিশ্চিত ফেঁসে যেতেন। এ লেখার শেষে এ সংক্রান্ত কিছু ঘটনার লিংক দিলাম।
১১. যুক্তরাজ্যে কর্মরত কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট এবং একটি NHS ট্রাস্টের ( a few hospitals under a trust) Clinical Director ডা. সুমন আহমেদকে এ বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি যা বললেন এবং আমি তাঁর সাথে একমত- এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর যা নিশ্চিতভাবে সংঘটিত হবে তা হচ্ছে- হাসপাতালে অভ্যন্তরীণ তদন্ত, রোগীকে বা রোগীর আত্মীয় স্বজনের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা, আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের তাদের রেগুলেটরি বডির (যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে GMC- General Medical Council) কাছে রেফার করা। শুনানির পর (মাস থেকে বছর চলে যেতে পারে) ডাক্তারদের রেগুলেটরি বডি তখন সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের করা ভুলগুলো কি নিছক মানবিক ভুল নাকি তাদের জ্ঞান এবং ট্রেনিংয়ে সীমাবদ্ধতা ছিল। ভুলের ধরন এবং মাত্রার উপর নির্ভর করে ডাক্তারদের সীমিত সময়ের জন্য (কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর) প্র্যাকটিস থেকে সাসপেন্ড করা হতে পারে। ভুলের মাত্রা মারাত্মক হলে ওই ডাক্তার দের চিরদিনের জন্য মেডিকেল প্র্যাকটিস থেকে নিষিদ্ধ করা হতে পারে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। সে কারণেই মনিরা খাতুনের কাহিনী ওখানেই খতম হয়ে গেল।
১২. ডাক্তারের হাতে রোগী মারা যেতেই পারে। ডাক্তারকে রেগুলেটরি বডি বা আদালতের সামনে ডাকা হতে পারে। সেই ডাক্তারকে তাহলে defend করবে কে? আইনি সহায়তা দেবে কে? ডাক্তারের হাতে মারা মারা যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত রোগীর আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেবে কে? সে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে হাসপাতালে ভূমিকা থাকবে কি থাকবে না?
১৩. ডাক্তারদের এবং রোগীদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য পশ্চিমা দেশের ডাক্তারদের প্র্যাকটিস করার সাথে সাথে compulsory ইন্সুরেন্স করতে হয়। মেডিকেলের ভাষায় যাকে বলা হয় indemnity insurance. দুই ধরনের মেডিকেল ইনডেমনিটি রয়েছে। একটি হচ্ছে ব্যক্তিগত ইনডেমনিটি, আরেকটি একটি হাসপাতালের নিজস্ব ইনডেমনিটি পলিসি।সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল তার অধীনে কর্মরত ডাক্তারদের প্রটেক্ট করার জন্য ইনডেমনিটি পলিসি নিজস্ব খরচে কিনে থাকে। কিন্তু যদি দেখা যায় সংশ্লিষ্ট ডাক্তার হাসপাতালে পলিসি অনুসরণ করেননি অথবা নিজস্ব স্টাইলে চিকিৎসা দিয়ে রোগীর ক্ষতি সাধন করেছেন, তখন সংশ্লিষ্ট রোগীর আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য/ আদালতে তাকে ডিফেন্ড করার জন্য তার ব্যক্তিগত মেডিকেল ডিফেন্স/ইনডেমনিটি টিম এগিয়ে আসবে।
১৪. আমি ধরে নিচ্ছি যে, হতভাগা মনিরা খাতুনের কপালে কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ জোটেনি। না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ না ডাক্তারদের ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। অন্তত এ ধরনের কোনো সংবাদ পত্রিকায় আসেনি। সরকারের উচিত ডাক্তারদের প্রটেক্ট করা, হাসপাতালকে বাঁচানো। সর্বোপরি রোগীদের বাঁচানো।
১৫. ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মনিরা খাতুন ওই হাসপাতালে গিয়ে নিশ্চয়ই কোনো পাপ করেননি। হাসপাতাল এবং ডাক্তারদের পক্ষ থেকে চিকিৎসায় মারাত্মক অবহেলা সকলের কাছে দৃশ্যমান হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন তা কিছু মারাত্মক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। তাতে হাসপাতাল এবং ডাক্তারদের উপর থেকে মানুষের আস্থা নষ্ট হবে।
১৬. মনিরা খাতুনের পেটে ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি ২১ মাস রেখে দেওয়ার পরও আপনারা যেভাবে আপনাদের কর্মকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন তা সভ্য সমাজে বিরল। আপনাদের বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে যে মনিরা খাতুনের পর জামিলা খাতুনরা যদি হাসপাতালে অপারেশন করাতে আসেন তাহলে সেই অপারেশনের সময় ওনার পেটে ১০ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি বা ছুরি রেখে দিলেও কোনো সমস্যা হবে না। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের এবং হাসপাতালকে কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না। আপনাদের বক্তব্য অনুসারে যেহেতু এ ধরনের ঘটনা পশ্চিমা বিশ্ব ঘটে কাজেই বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে হৈচৈ করার কোনো মানে হয় না।
১৭. জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা সরকারি হাসপাতাল মানুষকে যদি এভাবে নাজেহাল করা হয়, মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, অবহেলা কারীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়, তাহলে আপনাদের প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে কীভাবে? চিকিৎসক হিসেবে আমরা কি সব জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে চলে গেলাম? মানুষের প্রতি আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই? মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই? এ প্রশ্নগুলো আমি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে করলাম। একবার চিন্তা করুন আপনাদের এই তদন্তের সারাংশ কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে।
১৮. আমেরিকা প্রবাসী সেই ডাক্তার সাহেবের প্রশ্নের দিকে ফিরে আসি। তিনি খুব যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এবং আমি তার সাথে একই প্রশ্ন উত্থাপন করছি। চারজন ডাক্তার যখন অপারেশন করছিলেন তখন তাদের একজন অথবা সম্মিলিতভাবে সবাই রোগীর পেটে ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি রেখে সেলাই করে দেওয়ার ভুলের জন্য দায়ী। যেহেতু ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে পারেননি, তাই প্রশ্নটি হচ্ছে মনিরা খাতুনের পেটে ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি নিশ্চয়ই কোনো জীন বা ভূত রেখে গেছে। আমরা কি ভূতের রাজ্যে আছি?
---
ডা: আলী জাহান
কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য;
সাবেক পুলিশ সার্জন, যুক্তরাজ্য
[email protected]
লিংক- https://barcankirby.co.uk/legal-services/for-you-and-your-family/medical-negligence-claims/med-neg-client-stories/
২. ডালাসে বসবাসরত সে ডাক্তার সাহেব ই-মেইলের নিচে একটা অ্যাটাচমেন্ট জুড়ে দিয়েছেন।এটাচমেন্টটি আমাকে পড়ার এবং পড়ে মন্তব্য করার অনুরোধ করেছেন। আমি সেই অ্যাটাচমেন্ট ওপেন করে পড়লাম। আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি ডাক্তারের প্রশ্নটিই বোঝার চেষ্টা করলাম। কেন তিনি জীন-ভূতের প্রতি হঠাৎ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন তা পরিষ্কার হতে শুরু করলো।
৩. সব সম্ভবের এই দেশে গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার ১৮ বছর বয়সী মনিরা খাতুনের সাথে নিশ্চয়ই জীন-পরীর কোনো শত্রুতা ছিল। সেই জীন-পরী চায়নি মনিরা অপারেশন করে সুস্থ হয়ে উঠুন। ২০২০ সালের ৩ মার্চ ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে মনিরার পেটে যে অপারেশন করা হয়, সে অপারেশনের সময় তারই শত্রু কিছু জীন এসে মনিরার পেটের ভেতর ৬ ইঞ্চি লম্বা ছুরি (artery forcep) অপারেশন থিয়েটারে থাকা সকলের অগোচরে রেখে যায়। অপারেশনের দায়িত্বে থাকা ৩/৪ জন সার্জন, নার্স, ওটি বয়, এনেসথেসিস্ট কেউই তা খেয়াল করেননি। যখন খেয়াল করেছেন তখন ২১ মাস চলে গেছে! এর ভেতরে মনিরার জীবন তছনছ হয়ে গেছে। ২১ মাস ধরে তিনি অসহ্য ব্যাথা সহ্য করেছেন। বিশ্বমানের চিকিৎসা প্রদানকারী দেশের বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন। ওনার পেটের মধ্যে যে ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি আছে তা ধরতে ধরতে একুশটি মাস চলে গেছে! তাও কপাল ভালো ২১ বছর লাগেনি!
৪. বিশ্বমানের চিকিৎসা প্রদানকারী (বাংলাদেশি ডাক্তারদের পেশাজীবী সংগঠন বিএমএ এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিছুদিন ধরে এই দাবি করেছেন) দেশের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা মাত্র ২১ মাস সময় নিয়েছেন এই ব্যাপারটি বুঝতে যে মহিলার পেটে ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি রয়েছে। আর এই ভয়াবহ কাজটি সম্পন্ন করেছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা। উনারা বুঝতে পেরেছেন যে কাজটি সম্ভবত সঠিক হয়নি তাই ২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর এই হাসপাতলে অস্ত্রোপচার করে মনিরার পেট থেকে কাঁচি বের করা হয়। বিশ্বমানের এই অপারেশন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিবাদন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, যিনি কয়েকদিন আগেও দাবি করেছেন যে বাংলাদেশের বিশ্ব মানের চিকিৎসা হচ্ছে, ইচ্ছে করলে এই অভিবাদনের অংশীদার হতে পারেন।
৫. মনিরার পেটে কাঁচি রেখে কে তাঁর পেট সেলাই করে দিল? এই রহস্য উদঘাটনের জন্য স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের বিখ্যাত ডিটেকটিভ শার্লক হোমস এবং ডাক্তার ওয়াটসনকে ডাকতে হয়নি। এই জটিল রহস্যের(!) মূল ঘটনা উদঘাটন করেছেন ওই হাসপাতালের গঠিত তদন্ত কমিটি যার নেতৃত্বে ছিলেন সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামরুল হাসান এবং গাইনি বিভাগের অধ্যাপক কানিজ ফাতেমা ও সার্জারি বিভাগের মোঃ কামরুজ্জামান। এই কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ২১.১২.২১ মঙ্গলবার।
৬. তদন্ত কমিটির রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে হাসপাতালের পরিচালক সাইফুর রহমান একটি বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে ওই অপারেশনের সময় ৩/৪ জন ডাক্তার অংশ নিয়েছিলেন। তদন্ত কমিটি অপারেশন সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি। তিনি আরেক কদম সামনে গিয়ে বলেছেন যে উন্নত দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। তিনি যেটি বলেননি কিন্তু ইশারা-ইঙ্গিতে বলেছেন তা হচ্ছে এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে ঘটলে কোনো সমস্যা নেই। রিপোর্টের কোথাও উল্লেখ নেই যে, ভুল চিকিৎসার শিকার মনিরা খাতুনের পরিবারের কাছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করেছেন অথবা তাদের কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন।
৭. যেহেতু অপারেশনের সঙ্গে ৩/৪ জন সার্জন জড়িত ছিলেন, তাদের কেউ একজন অথবা সম্মিলিতভাবে তাঁরা সবাই এই অপরাধ/ভুল (medical negligence) করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে ওই দিন অপারেশনে মোট কতজন ডাক্তার অংশ নিয়েছিলেন তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। বলা হচ্ছে তিন থেকে চারজন ডাক্তার! যদি ওনারা রোগীর পেটের ভেতরে এই ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি না রেখে থাকেন তাহলে কি কোনো ভূত এসে এই কাঁচি রেখেছিল?
৮. ডালাস প্রবাসী ডাক্তার সাহেবের মন্তব্য-যেহেতু অপারেশনের সময় কোনো ডাক্তার মনিরার পেটে কাঁচি ( ৬ ইঞ্চি লম্বা artery forcep) রাখেননি (তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে) নিশ্চয়ই তা ভূতের কাণ্ড। জীন ভূত ছাড়া কেউ এ কাজ করতে পারে না! প্রশ্ন হচ্ছে যে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ভূত ঢুকলো কীভাবে? আর কেনই বা সেই ভূত মনিরার মতো অসহায় একটি মেয়ের পেটের মধ্যে অপারেশনের সময় কাঁচি রেখে দিল?
৯. আমরা যারা ডাক্তারি পেশার সাথে জড়িত তাদের ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ডায়াগনোসিস করার সময় ভুল হতে পারে। চিকিৎসা প্রদানের সময় ভুল হতে পারে। অপারেশন করার সময় ভুল হতে পারে। ওষুধ খেয়ে বা অপারেশনের সময় সময় রোগী মারা যেতে পারে। অপারেশনের পরে বিভিন্ন জটিলতায় রোগী মারা যেতে পারে। কিন্তু সেই ভুলের মাত্রা কতটুকু?কতটুকু ভুল হলে হাসপাতাল এবং ডাক্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে? বাংলাদেশে কি এরকম কোনো গাইডলাইন আছে? আইন আছে? আইনের প্রয়োগ আছে?
১০. পশ্চিমা বিশ্বে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে এবং ঘটছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটার পরে কী ঘটে? তদন্ত কমিটির সে ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেননি। ইচ্ছে করে দেননি নাকি উনারা জানেন না? উন্নত বিশ্বে এ ধরনের অবহেলার ঘটনা ঘটলে পরবর্তীতে কী ঘটে তার বর্ণনা যদি তদন্ত কমিটি দিতেন তাহলে তাঁরা ফেঁসে যেতেন। নিশ্চিত ফেঁসে যেতেন। এ লেখার শেষে এ সংক্রান্ত কিছু ঘটনার লিংক দিলাম।
১১. যুক্তরাজ্যে কর্মরত কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট এবং একটি NHS ট্রাস্টের ( a few hospitals under a trust) Clinical Director ডা. সুমন আহমেদকে এ বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি যা বললেন এবং আমি তাঁর সাথে একমত- এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর যা নিশ্চিতভাবে সংঘটিত হবে তা হচ্ছে- হাসপাতালে অভ্যন্তরীণ তদন্ত, রোগীকে বা রোগীর আত্মীয় স্বজনের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা, আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের তাদের রেগুলেটরি বডির (যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে GMC- General Medical Council) কাছে রেফার করা। শুনানির পর (মাস থেকে বছর চলে যেতে পারে) ডাক্তারদের রেগুলেটরি বডি তখন সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের করা ভুলগুলো কি নিছক মানবিক ভুল নাকি তাদের জ্ঞান এবং ট্রেনিংয়ে সীমাবদ্ধতা ছিল। ভুলের ধরন এবং মাত্রার উপর নির্ভর করে ডাক্তারদের সীমিত সময়ের জন্য (কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর) প্র্যাকটিস থেকে সাসপেন্ড করা হতে পারে। ভুলের মাত্রা মারাত্মক হলে ওই ডাক্তার দের চিরদিনের জন্য মেডিকেল প্র্যাকটিস থেকে নিষিদ্ধ করা হতে পারে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। সে কারণেই মনিরা খাতুনের কাহিনী ওখানেই খতম হয়ে গেল।
১২. ডাক্তারের হাতে রোগী মারা যেতেই পারে। ডাক্তারকে রেগুলেটরি বডি বা আদালতের সামনে ডাকা হতে পারে। সেই ডাক্তারকে তাহলে defend করবে কে? আইনি সহায়তা দেবে কে? ডাক্তারের হাতে মারা মারা যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত রোগীর আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেবে কে? সে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে হাসপাতালে ভূমিকা থাকবে কি থাকবে না?
১৩. ডাক্তারদের এবং রোগীদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য পশ্চিমা দেশের ডাক্তারদের প্র্যাকটিস করার সাথে সাথে compulsory ইন্সুরেন্স করতে হয়। মেডিকেলের ভাষায় যাকে বলা হয় indemnity insurance. দুই ধরনের মেডিকেল ইনডেমনিটি রয়েছে। একটি হচ্ছে ব্যক্তিগত ইনডেমনিটি, আরেকটি একটি হাসপাতালের নিজস্ব ইনডেমনিটি পলিসি।সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল তার অধীনে কর্মরত ডাক্তারদের প্রটেক্ট করার জন্য ইনডেমনিটি পলিসি নিজস্ব খরচে কিনে থাকে। কিন্তু যদি দেখা যায় সংশ্লিষ্ট ডাক্তার হাসপাতালে পলিসি অনুসরণ করেননি অথবা নিজস্ব স্টাইলে চিকিৎসা দিয়ে রোগীর ক্ষতি সাধন করেছেন, তখন সংশ্লিষ্ট রোগীর আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য/ আদালতে তাকে ডিফেন্ড করার জন্য তার ব্যক্তিগত মেডিকেল ডিফেন্স/ইনডেমনিটি টিম এগিয়ে আসবে।
১৪. আমি ধরে নিচ্ছি যে, হতভাগা মনিরা খাতুনের কপালে কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ জোটেনি। না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ না ডাক্তারদের ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। অন্তত এ ধরনের কোনো সংবাদ পত্রিকায় আসেনি। সরকারের উচিত ডাক্তারদের প্রটেক্ট করা, হাসপাতালকে বাঁচানো। সর্বোপরি রোগীদের বাঁচানো।
১৫. ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মনিরা খাতুন ওই হাসপাতালে গিয়ে নিশ্চয়ই কোনো পাপ করেননি। হাসপাতাল এবং ডাক্তারদের পক্ষ থেকে চিকিৎসায় মারাত্মক অবহেলা সকলের কাছে দৃশ্যমান হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন তা কিছু মারাত্মক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। তাতে হাসপাতাল এবং ডাক্তারদের উপর থেকে মানুষের আস্থা নষ্ট হবে।
১৬. মনিরা খাতুনের পেটে ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি ২১ মাস রেখে দেওয়ার পরও আপনারা যেভাবে আপনাদের কর্মকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন তা সভ্য সমাজে বিরল। আপনাদের বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে যে মনিরা খাতুনের পর জামিলা খাতুনরা যদি হাসপাতালে অপারেশন করাতে আসেন তাহলে সেই অপারেশনের সময় ওনার পেটে ১০ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি বা ছুরি রেখে দিলেও কোনো সমস্যা হবে না। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের এবং হাসপাতালকে কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না। আপনাদের বক্তব্য অনুসারে যেহেতু এ ধরনের ঘটনা পশ্চিমা বিশ্ব ঘটে কাজেই বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে হৈচৈ করার কোনো মানে হয় না।
১৭. জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা সরকারি হাসপাতাল মানুষকে যদি এভাবে নাজেহাল করা হয়, মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, অবহেলা কারীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়, তাহলে আপনাদের প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে কীভাবে? চিকিৎসক হিসেবে আমরা কি সব জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে চলে গেলাম? মানুষের প্রতি আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই? মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই? এ প্রশ্নগুলো আমি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে করলাম। একবার চিন্তা করুন আপনাদের এই তদন্তের সারাংশ কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে।
১৮. আমেরিকা প্রবাসী সেই ডাক্তার সাহেবের প্রশ্নের দিকে ফিরে আসি। তিনি খুব যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এবং আমি তার সাথে একই প্রশ্ন উত্থাপন করছি। চারজন ডাক্তার যখন অপারেশন করছিলেন তখন তাদের একজন অথবা সম্মিলিতভাবে সবাই রোগীর পেটে ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি রেখে সেলাই করে দেওয়ার ভুলের জন্য দায়ী। যেহেতু ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে পারেননি, তাই প্রশ্নটি হচ্ছে মনিরা খাতুনের পেটে ৬ ইঞ্চি লম্বা কাঁচি নিশ্চয়ই কোনো জীন বা ভূত রেখে গেছে। আমরা কি ভূতের রাজ্যে আছি?
---
ডা: আলী জাহান
কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য;
সাবেক পুলিশ সার্জন, যুক্তরাজ্য
[email protected]
লিংক- https://barcankirby.co.uk/legal-services/for-you-and-your-family/medical-negligence-claims/med-neg-client-stories/