দেশ বিদেশ

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ভাঙতে হবে নীরবতা

৭ ডিসেম্বর ২০২১, মঙ্গলবার, ৬:২১ অপরাহ্ন

বিশ্বের যেসব দেশে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের হার বেশি, সেসব দেশের তালিকায় এসেছে বাংলাদেশের নাম।  ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৫০ শতাংশই জীবনে কখনো না কখনো সঙ্গীর হাতে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
 
বিশ্বের ১৬১টি দেশ ও অঞ্চলে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারী নির্যাতনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তাদের তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবদ্দশায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমে পরিবার থেকেই পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক তানিয়া হক। তিনি বলেন, সামাজিক-পারিবারিক সমতা, সম–অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে তবেই নারীর ক্ষমতায়ন হবে এবং সহিংসতা কমবে।

অবশ্য বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করা বাল্যবিবাহ নিয়ে সম্প্রতি উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ। গত সোমবার তাদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশে বালবিবাহের ব্যাপকতা বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ। করোনা মহামারি মেয়েদের বাল্যবিবাহের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

নারী ও  কন্যাশিশু নির্যাতন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে করোনাকালে অর্থাৎ গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের নারী নির্যাতনের ঊর্ধ্বগতি উদ্বেগজনক। মানবতাবিরোধী এ অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

শীর্ষস্থানীয় নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৩টি বাংলা ও ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে সারা দেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের তথ্য সংরক্ষণ করে। সংরক্ষিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যাসহ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের মতো বিভিন্ন অপরাধের সংখ্যা ছিল ১৪৫১। চলতি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ১৭৯৪টি। এ হিসাবে বৃদ্ধির হার প্রায় ২৪ শতাংশ।

জাতীয় দৈনিকগুলোয় নারী নির্যাতন সম্পর্কিত যত খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেটাই সব নয়। প্রকৃত সংখ্যা অবশ্যই অনেক বেশি। অনেক কারনে সংবাদপত্রে সব খবর প্রকাশ হয় না। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্তকরণের মতো অনেক ঘটনা থানায় রিপোর্ট হয় না। মামলাও হয় না। নির্যাতিত নারী বা কন্যাশিশুর অনেক অভিভাবক পুলিশের কাছে যান না। তারা এই ভেবে ভয় পান যে, ঘটনা প্রচারিত হলে নির্যাতিত মেয়েটি সমাজের কাছে হেয় হবে অথবা আরও বেশি লাঞ্ছিত হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারী বা অপরাধীরা প্রভাবশালী হয় অথবা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকে। প্রভাব খাটিয়ে নির্যাতিত নারীকে মামলা করতে দেওয়া হয় না, মামলা করলেও তা ধামাচাপা দেয়ার ব্যাবস্থা হয়ে যায়।

জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর সংবাদদাতা থাকেন দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত। তারাই তাদের পত্রিকায় নারী নির্যাতন বা এ ধরনের অপরাধের খবর পাঠান। অনেক সময় সাংবাদিকরাও এসব খবর পান না, পেলেও থানায় মামলা না হওয়া পর্যন্ত পত্রিকায় খবর পাঠাতে তাদের সীমাবদ্ধতা থাকে। প্রভাবশালী মহলের চাপও থাকে তাদের ওপর। এসবকিছু বিবেচনা করেই বলা যায়, সংবাদপত্রে নারী নির্যাতনের যত খবর প্রকাশিত হয়, তা প্রকৃত পরিস্থিতির প্রতিফলন নয়। নারী নির্যাতনের ঘটনা আসলে অনেক বেশি ঘটছে।

তা সত্ত্বেও এ কথা মানতেই হবে, মহিলা পরিষদ ১৩টি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে নারী নির্যাতনের যে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছে, তা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির প্রমাণ। এ জরিপে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের মোট ৩৮ ধরন চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা, শ্লীলতাহানি, যৌন নিপীড়ন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, অপহরণ, নারী পাচার, যৌতুকের কারণে নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ ইত্যাদি।

মহিলা পরিষদের জরিপে দেখা যায়, গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নারী নির্যাতন সম্পর্কিত মোট ৩৪৪০টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাই সর্বোচ্চ, ১০৭৪টি। গণধর্ষণের ২৩৬টি ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৩৩ নারীকে। ধর্ষণচেষ্টার ২০০ খবর পাওয়া গেছে। শ্লীলতাহানি ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১১৭ জন। অপহরণ করা হয়েছে ১২৫ নারীকে। নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ৯৭টি। গত বছর ৪৬৮ নারীকে হত্যা করা হয়, রহস্যজনক মৃত্যু হয় ২৫২ জনের।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে নারী নির্যাতনের ১৭৯৪টি ঘটনা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৫৭২, গণধর্ষণ ১০৫, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৬ জনকে। শ্লীলতাহানি ও যৌন নিপীড়ন হয়েছে ৫৯টি। ছয় মাসে সারা দেশে হত্যা করা হয়েছে ২২১ জন নারীকে। রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ২২৫ জনের। অপহরণ করা হয় ৯৫ জনকে। যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয় ৩০ জনকে, নির্যাতিত হন ৪৪ জন।

এ বছর ছয় মাসে নারী-কন্যাশিশু নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটেছে, তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। অপরাধের ঊর্ধ্বমুখী ধারা থেকে আশঙ্কা হয় এ বছরের মোট ঘটনা গত বছরের চেয়ে বেশি হবে।

দেশে নারী নির্যাতন আগেও ছিল। গত বছর হঠাৎ তা বেড়ে গেছে, এ বছরও ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু এ অপরাধ বাড়ছে কেন? বিশেষ করে করোনাকালের এ দুঃসময়ে?

কারণ যাই হোক, পরিবার,সামাজিক দায়িত্ত্ববোধ এবং আইনের সুশাসন ও বিচারের যথাযথ প্রয়োগ যদি সম্ভব হয়, তবেই এ দেশে নারী নির্যাতন কমানো সম্ভব হবে। তাছাড়া আমাদের প্রত্যেককেই নিজের বিবেক জাগ্রত করে এমন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠিন গড়ে তুলতে হবে।

লেখক
আয়েশা সিদ্দিকা
নারী আন্দোলন কর্মী,
কলামিস্ট ও সোশ্যাল মিডিয়া এক্টিভিস্ট।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status