মত-মতান্তর
তারেক মাসুদ, আমার পিতৃতুল্য নির্মাতা
৬ ডিসেম্বর ২০২১, সোমবার, ১১:০২ পূর্বাহ্ন
সিনেমার শেষ দৃশ্য চলছে। হলভর্তি দর্শক। আমি একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে। দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে সিনেমা দেখছেন। সিনেমা শেষে মুহুর্মুহু করতালিতে গোটা হল ভেঙে পড়ছে। দর্শকদের ভালো লাগা, সত্যিই দেখার মতো একটি দৃশ্য। সিনেমার পরিচালক তারেক মাসুদ মঞ্চে উঠে এলেন। উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশ্যে বললেন, এতোক্ষণ আপনারা যে সিনেমা দেখলেন, এর নায়কের সাথে পরিচিত হবেন না? গোটা হলজুড়ে আওয়াজ উঠলো, হ্যাঁ। তারেক ভাই মঞ্চ থেকেই হাত ইশারায় আমাকে ডাকলেন, সামনে চলে এসো। তারেক ভাইয়ের ইঙ্গিত অনুসরণ করে আমাকে দেখার জন্য সকলে পেছনে ফিরে তাকালেন।
আমি একদম পেছন থেকে এগিয়ে যাচ্ছি মঞ্চের দিকে। আশেপাশে থেকে তুমুল করতালি ও শিস বাজিয়ে আমাকে বরণ করা হচ্ছে। কেউ কেউ অন্যদের থেকে মাথা ডানে-বায়ে সরিয়ে আমাকে দেখছেন। আঙুলের ইশারায় আমাকে চিনিয়ে দিচ্ছেন কেউ । মোবাইলে ছবি তুলে নিচ্ছেন অনেকে। এগিয়ে যাওয়ার সময় দু’ পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে অনেকে হাত মেলাচ্ছেন আমার সাথে। ঠিক এই মুহূর্তে আমি যেন এক মস্ত বড় রাজা! সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে আমার। আমি গিয়ে মঞ্চে উঠলাম।
তারেক ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে সকলের সাথে। এই হচ্ছে আমাদের রুহুল (রানওয়ে চলচ্চিত্রে আমার নাম রুহুল ছিলো)। এখন আরেকটি শো শুরু হবে। আপনারা যদি কেউ আমাদের সাথে কথা বলতে চান, আপনাদের যদি কোনো জিজ্ঞাসা থাকে, প্রশ্ন থাকে, কোনো পরামর্শ বা অনুভূতি প্রকাশ চান, আমরা বাইরে আছি। বেরিয়ে এলাম তারেক ভাইয়ের সাথে। দর্শকদের মধ্যে অনেকে চেপে ধরলেন আমাকে। ছবি তুলবেন একসাথে। অটোগ্রাফ চাইলেন আমার। জীবনে প্রথম অটোগ্রাফ দিয়ে চলেছি। এই আনন্দ লেখায় কিছুতেই প্রকাশ করা সম্ভব না!
অবশ্যই আমার এ সফলতার পেছনে তারেক ভাইয়ের অবদান অনস্বীকার্য।
আমি মহাসৌভাগ্যবান যে, তারেক ভাইয়ের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলাম।
রানওয়ের অডিশনের গল্প আমি অনেকবার বলেছি, আজ না হয় শুটিংয়ের কিছু কথা বলি। আমাদের শুটিং হতো অত্যন্ত সাবলীল ছন্দে। কোনো তাড়াহুড়া ছিলো না। পরের দিন কোন কোন দৃশ্যের শুটিং হবে এবং সেটি সম্ভাব্য কত সময়জুড়ে হতে পারে তেমন একটি লিস্ট পেয়ে যেতাম আগেরদিনই। আর দারুণ মজার বিষয় ছিলো যেটি তা হচ্ছে, সমস্ত দিনজুড়ে কোনো শুটিং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হতো না। অর্থাৎ যেদিন খুব ভোর থেকে শুটিং শুরু হতো, সেদিন দেখা যেতো বিকেল কিংবা সন্ধ্যার আগেই শুটিং শেষ। আর যেদিন রাতের দৃশ্যগুলো থাকতো, সন্ধ্যার পর থেকে সেদিন শুরু হতো। এভাবে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে শুটিং করেছি এবং উপভোগ করেছি।
আমার চোখে দেখা তারেক মাসুদ একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ।
কেউ তার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন, কথা বলতে চেয়েছেন, অথচ তিনি তাকে অবজ্ঞা করেছেন, সময় দেন নি, এমনটি কখনো হয় নি। কখনোই না। অনেক বড় নির্মাতা বা চলচ্চিত্রবোদ্ধা থেকে শুরু করে একদম নবীন নির্মাতা বা নির্মাণে আগ্রহী ব্যক্তির সাথেও তিনি তার মূল্যবান সময় শেয়ার করেছেন অকপটে। দিগন্ত বিস্তৃত হাসি মুখের এই মানুষটির মধ্যে অহংকার বা আত্নগরিমা ছিলো না। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকার চলচ্চিত্র প্রেমী।
শুটিং চলাকালীন লোকেশনে তারেক ভাইকে দেখে মনে হতো একজন মহারাজা। তিনি যখন হেঁটে বেড়াতেন, সকলে তটস্থ হয়ে থাকতো। নিজ নিজ কাজের প্রতি প্রত্যেকের মনযোগ শতভাগ থাকতো তখন। তিনি যে কাউকে বকাঝকা করে কথা বলেছেন এমনটি নয়, তার মুখ থেকে একটি অকথ্য শব্দও আমি কখনো শুনি নি। তাকে সকলে যতটা না ভয় পেতো, বরং তার চেয়ে বেশি সম্মানে বিনয়ে অবনত হয়ে থাকতো। শুটিংয়ের প্রতিটি বিভাগের কাজই তিনি বুঝতেন। ক্যামেরা, লাইট, আর্ট, মেকআপ, সাউন্ড, অভিনয় সব তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন নিবিড়ভাবে। প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে থাকা আমি, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ অবাক হয়ে দেখতাম।
শুটিংয়ের মজার একটা ঘটনা বলি। শুটিংয়ে কয়েকটা দিন বিরতি পেয়েছি। অলসভাবে ঘুরেফিরে দিন কাটছিলো। দাঁড়ি গোফগুলো বড় হয়ে যাচ্ছিলো। কেমন যেন নিজের কাছে বেখাপ্পা লাগছিলো নিজেকে। ভাবলাম ছোট কাঁচিটা দিয়ে হালকা একটু ছোট করে ফেলি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আয়না হাতে নিয়ে কাঁচি দিয়ে গোফটা একটু ছোট করে ফেললাম। মাথাটা ভালো করে ডানেবায়ে ঘুরিয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখি অন্য এক পাশের তুলনায় আরেকপাশ সামান্য একটু ছোট হয়ে গেছে। আবার একটু কেটেকুটে মিলানোর চেষ্টা করলাম। অনভিজ্ঞ হাতে এবারেও ভুল হলো। যে পাশ ছোট করলাম, তা আরেক পাশের তুলনায় সামান্য একটু ছোট হয়ে গেছে। এই মিলকরণের খেলা শেষে আয়নায় যখন নিজের চেহারা দেখলাম, নিজেই আৎকে উঠলাম! একি! গোঁফ অনেক ছোট হয়ে গেছে। এখন যদি শুটিংয়ের কল এসে পড়ে তখন উপায়? তাড়াতাড়ি করে চলে এলাম তারেক ভাইয়ের অফিসে (তখন মোঃপুর, বাবর রোডে অফিস ছিলো।) অফিসে উপস্থিত ছিলেন সহকারী পরিচালক। তিনি আদ্যোপান্ত দেখে এবং শুনে চোখছানাবড়া করে ফেললেন। জানলাম যে আগামীকাল শুটিং। আমাকে কল দেয়া হতো এখনই। কালবিলম্ব না করে আমাকে পাঠালেন তারেক ভাইয়ের বাসায়। তারেক ভাইয়ের গাড়ি অফিসে ছিলো। সেটিতে করেই তার বাসায় চলে এলাম। মনে মনে দোয়া যতগুলো পারি পড়া শুরু করেছি। তারেক ভাই কি যে বলবেন আজকে! কি দরকার ছিলো এতো চালাকি করার। উৎকণ্ঠায় সারা রাস্তা পারি দিয়ে তার বাসায় পৌঁছালাম। দরজা খুললেন তারেক ভাই নিজেই। আমাকে দেখে তিনি তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে। আমি দোয়া পড়া ভুলে গেছি! একটুক্ষণ তাকিয়ে দেখে তিনি খুব শান্ত গলায় বললেন-এসো, ভিতরে এসো। কোন উচ্চবাচ্য না, কড়া কথা না, কটু কথা না, এতো শান্তভাবে তিনি বললেন যে, প্রাণ ফিরে পেলাম। এই হলেন তারেক মাসুদ। তিনি জানেন কি করে নিজেকে শান্তু ও অবিচল রাখতে হয়। কি করে এগিয়ে যেতে হয় সামনের দিকে। দ্রুত ভাবনা ও পরিকল্পনায় তার জুড়ি নেই। পরের দিন শুটিং হয়েছিলো।
পিতৃতুল্য তারেক মাসুদকে আমি কি ভীষন পরিমাণ অনুভব করি, তা বোঝাতে পারবো না কোনোদিনই। তিনি আমার সুখ-দুঃখ সকল সময়ে পিতার মতোই পাশে ছিলেন। কাঁধে হাত রেখে সাহস দিয়েছেন। সেই দিনের কথাটি আমার আজ এখনো মনে পড়ে। মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের জন্য আমি মনোনয়ন পেয়েছি। সমালোচকদের ভোটে সেরা চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া আমার জন্য দারুণ একটি অর্জনই বটে। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের দিন আমার পাশে ছিলেন তারেক মাসুদ, ছিলেন ক্যাথরিন মাসুদ এবং রানওয়েতে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা মনি আপা। মনি আপা সেরা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পান এবং আমাদের চলচ্চিত্র 'রানওয়ে' সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনয়ন পায়। আমরা অপেক্ষা করছি। নাম ঘোষণা করা হচ্ছে একেকটি ক্যাটাগরিতে। সেরা চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে আমি পুরস্কারটি পাই নি। মন খারাপ হয়ে গেলো। তারেক ভাই আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, মন খারাপ করো না। এতো অল্প সময়ে অনেকে এতদূর পর্যন্ত আসতেও পারে না। তুমি সেরা চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পর্যন্ত পেয়েছ, এটি কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। আর সামনে অনেক পথ বাকি আছে এখনো। সেদিন তারেক ভাইয়ের সস্নেহে আমি দুঃখ ভুলে গিয়েছিলাম। সত্যি বলছি, আমার মধ্যে আর একটুও মন খারাপ অবস্থা ছিলো না। এমন পিতা যার কাঁধে হাত রেখে সাহস দেয়, শক্তি যোগায়, তার আর অপূর্ণতা কোথায়?
আজ তারেক ভাই নেই, আমি এখনও মানতে পারি না। জনবহুল এলাকায় পুত্রের সাহস পরীক্ষার জন্য যেমন পুত্রকে রেখে পিতা আড়াল হয়ে পুত্র কি করে পর্যবেক্ষণ করেন, তেমনি আমার সব সময় মন হয় তারেক ভাই আড়াল হয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি ভিতস্ত হলে তিনি আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে আমাকে ডাকবেন, ‘রুহল, এই যে আমি এখানে’।
অনেকেই শুনেছেন হয়তো, তারেক ভাই একটি কথা প্রায়ই বলতেন, দর্শকই আমার প্রাণ। সেই প্রাণ আজও বেঁচে রয়েছে হাজারো দর্শকের মাঝে। বেঁচে থাকবে চিরকাল এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
'শুভ জন্মদিন তারেক ভাই।'
লেখক-
ফজলুল হক
অভিনেতা
আমি একদম পেছন থেকে এগিয়ে যাচ্ছি মঞ্চের দিকে। আশেপাশে থেকে তুমুল করতালি ও শিস বাজিয়ে আমাকে বরণ করা হচ্ছে। কেউ কেউ অন্যদের থেকে মাথা ডানে-বায়ে সরিয়ে আমাকে দেখছেন। আঙুলের ইশারায় আমাকে চিনিয়ে দিচ্ছেন কেউ । মোবাইলে ছবি তুলে নিচ্ছেন অনেকে। এগিয়ে যাওয়ার সময় দু’ পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে অনেকে হাত মেলাচ্ছেন আমার সাথে। ঠিক এই মুহূর্তে আমি যেন এক মস্ত বড় রাজা! সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে আমার। আমি গিয়ে মঞ্চে উঠলাম।
তারেক ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে সকলের সাথে। এই হচ্ছে আমাদের রুহুল (রানওয়ে চলচ্চিত্রে আমার নাম রুহুল ছিলো)। এখন আরেকটি শো শুরু হবে। আপনারা যদি কেউ আমাদের সাথে কথা বলতে চান, আপনাদের যদি কোনো জিজ্ঞাসা থাকে, প্রশ্ন থাকে, কোনো পরামর্শ বা অনুভূতি প্রকাশ চান, আমরা বাইরে আছি। বেরিয়ে এলাম তারেক ভাইয়ের সাথে। দর্শকদের মধ্যে অনেকে চেপে ধরলেন আমাকে। ছবি তুলবেন একসাথে। অটোগ্রাফ চাইলেন আমার। জীবনে প্রথম অটোগ্রাফ দিয়ে চলেছি। এই আনন্দ লেখায় কিছুতেই প্রকাশ করা সম্ভব না!
অবশ্যই আমার এ সফলতার পেছনে তারেক ভাইয়ের অবদান অনস্বীকার্য।
আমি মহাসৌভাগ্যবান যে, তারেক ভাইয়ের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলাম।
রানওয়ের অডিশনের গল্প আমি অনেকবার বলেছি, আজ না হয় শুটিংয়ের কিছু কথা বলি। আমাদের শুটিং হতো অত্যন্ত সাবলীল ছন্দে। কোনো তাড়াহুড়া ছিলো না। পরের দিন কোন কোন দৃশ্যের শুটিং হবে এবং সেটি সম্ভাব্য কত সময়জুড়ে হতে পারে তেমন একটি লিস্ট পেয়ে যেতাম আগেরদিনই। আর দারুণ মজার বিষয় ছিলো যেটি তা হচ্ছে, সমস্ত দিনজুড়ে কোনো শুটিং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হতো না। অর্থাৎ যেদিন খুব ভোর থেকে শুটিং শুরু হতো, সেদিন দেখা যেতো বিকেল কিংবা সন্ধ্যার আগেই শুটিং শেষ। আর যেদিন রাতের দৃশ্যগুলো থাকতো, সন্ধ্যার পর থেকে সেদিন শুরু হতো। এভাবে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে শুটিং করেছি এবং উপভোগ করেছি।
আমার চোখে দেখা তারেক মাসুদ একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ।
কেউ তার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন, কথা বলতে চেয়েছেন, অথচ তিনি তাকে অবজ্ঞা করেছেন, সময় দেন নি, এমনটি কখনো হয় নি। কখনোই না। অনেক বড় নির্মাতা বা চলচ্চিত্রবোদ্ধা থেকে শুরু করে একদম নবীন নির্মাতা বা নির্মাণে আগ্রহী ব্যক্তির সাথেও তিনি তার মূল্যবান সময় শেয়ার করেছেন অকপটে। দিগন্ত বিস্তৃত হাসি মুখের এই মানুষটির মধ্যে অহংকার বা আত্নগরিমা ছিলো না। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকার চলচ্চিত্র প্রেমী।
শুটিং চলাকালীন লোকেশনে তারেক ভাইকে দেখে মনে হতো একজন মহারাজা। তিনি যখন হেঁটে বেড়াতেন, সকলে তটস্থ হয়ে থাকতো। নিজ নিজ কাজের প্রতি প্রত্যেকের মনযোগ শতভাগ থাকতো তখন। তিনি যে কাউকে বকাঝকা করে কথা বলেছেন এমনটি নয়, তার মুখ থেকে একটি অকথ্য শব্দও আমি কখনো শুনি নি। তাকে সকলে যতটা না ভয় পেতো, বরং তার চেয়ে বেশি সম্মানে বিনয়ে অবনত হয়ে থাকতো। শুটিংয়ের প্রতিটি বিভাগের কাজই তিনি বুঝতেন। ক্যামেরা, লাইট, আর্ট, মেকআপ, সাউন্ড, অভিনয় সব তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন নিবিড়ভাবে। প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে থাকা আমি, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ অবাক হয়ে দেখতাম।
শুটিংয়ের মজার একটা ঘটনা বলি। শুটিংয়ে কয়েকটা দিন বিরতি পেয়েছি। অলসভাবে ঘুরেফিরে দিন কাটছিলো। দাঁড়ি গোফগুলো বড় হয়ে যাচ্ছিলো। কেমন যেন নিজের কাছে বেখাপ্পা লাগছিলো নিজেকে। ভাবলাম ছোট কাঁচিটা দিয়ে হালকা একটু ছোট করে ফেলি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আয়না হাতে নিয়ে কাঁচি দিয়ে গোফটা একটু ছোট করে ফেললাম। মাথাটা ভালো করে ডানেবায়ে ঘুরিয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখি অন্য এক পাশের তুলনায় আরেকপাশ সামান্য একটু ছোট হয়ে গেছে। আবার একটু কেটেকুটে মিলানোর চেষ্টা করলাম। অনভিজ্ঞ হাতে এবারেও ভুল হলো। যে পাশ ছোট করলাম, তা আরেক পাশের তুলনায় সামান্য একটু ছোট হয়ে গেছে। এই মিলকরণের খেলা শেষে আয়নায় যখন নিজের চেহারা দেখলাম, নিজেই আৎকে উঠলাম! একি! গোঁফ অনেক ছোট হয়ে গেছে। এখন যদি শুটিংয়ের কল এসে পড়ে তখন উপায়? তাড়াতাড়ি করে চলে এলাম তারেক ভাইয়ের অফিসে (তখন মোঃপুর, বাবর রোডে অফিস ছিলো।) অফিসে উপস্থিত ছিলেন সহকারী পরিচালক। তিনি আদ্যোপান্ত দেখে এবং শুনে চোখছানাবড়া করে ফেললেন। জানলাম যে আগামীকাল শুটিং। আমাকে কল দেয়া হতো এখনই। কালবিলম্ব না করে আমাকে পাঠালেন তারেক ভাইয়ের বাসায়। তারেক ভাইয়ের গাড়ি অফিসে ছিলো। সেটিতে করেই তার বাসায় চলে এলাম। মনে মনে দোয়া যতগুলো পারি পড়া শুরু করেছি। তারেক ভাই কি যে বলবেন আজকে! কি দরকার ছিলো এতো চালাকি করার। উৎকণ্ঠায় সারা রাস্তা পারি দিয়ে তার বাসায় পৌঁছালাম। দরজা খুললেন তারেক ভাই নিজেই। আমাকে দেখে তিনি তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে। আমি দোয়া পড়া ভুলে গেছি! একটুক্ষণ তাকিয়ে দেখে তিনি খুব শান্ত গলায় বললেন-এসো, ভিতরে এসো। কোন উচ্চবাচ্য না, কড়া কথা না, কটু কথা না, এতো শান্তভাবে তিনি বললেন যে, প্রাণ ফিরে পেলাম। এই হলেন তারেক মাসুদ। তিনি জানেন কি করে নিজেকে শান্তু ও অবিচল রাখতে হয়। কি করে এগিয়ে যেতে হয় সামনের দিকে। দ্রুত ভাবনা ও পরিকল্পনায় তার জুড়ি নেই। পরের দিন শুটিং হয়েছিলো।
পিতৃতুল্য তারেক মাসুদকে আমি কি ভীষন পরিমাণ অনুভব করি, তা বোঝাতে পারবো না কোনোদিনই। তিনি আমার সুখ-দুঃখ সকল সময়ে পিতার মতোই পাশে ছিলেন। কাঁধে হাত রেখে সাহস দিয়েছেন। সেই দিনের কথাটি আমার আজ এখনো মনে পড়ে। মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের জন্য আমি মনোনয়ন পেয়েছি। সমালোচকদের ভোটে সেরা চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া আমার জন্য দারুণ একটি অর্জনই বটে। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের দিন আমার পাশে ছিলেন তারেক মাসুদ, ছিলেন ক্যাথরিন মাসুদ এবং রানওয়েতে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা মনি আপা। মনি আপা সেরা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পান এবং আমাদের চলচ্চিত্র 'রানওয়ে' সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনয়ন পায়। আমরা অপেক্ষা করছি। নাম ঘোষণা করা হচ্ছে একেকটি ক্যাটাগরিতে। সেরা চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে আমি পুরস্কারটি পাই নি। মন খারাপ হয়ে গেলো। তারেক ভাই আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, মন খারাপ করো না। এতো অল্প সময়ে অনেকে এতদূর পর্যন্ত আসতেও পারে না। তুমি সেরা চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পর্যন্ত পেয়েছ, এটি কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। আর সামনে অনেক পথ বাকি আছে এখনো। সেদিন তারেক ভাইয়ের সস্নেহে আমি দুঃখ ভুলে গিয়েছিলাম। সত্যি বলছি, আমার মধ্যে আর একটুও মন খারাপ অবস্থা ছিলো না। এমন পিতা যার কাঁধে হাত রেখে সাহস দেয়, শক্তি যোগায়, তার আর অপূর্ণতা কোথায়?
আজ তারেক ভাই নেই, আমি এখনও মানতে পারি না। জনবহুল এলাকায় পুত্রের সাহস পরীক্ষার জন্য যেমন পুত্রকে রেখে পিতা আড়াল হয়ে পুত্র কি করে পর্যবেক্ষণ করেন, তেমনি আমার সব সময় মন হয় তারেক ভাই আড়াল হয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি ভিতস্ত হলে তিনি আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে আমাকে ডাকবেন, ‘রুহল, এই যে আমি এখানে’।
অনেকেই শুনেছেন হয়তো, তারেক ভাই একটি কথা প্রায়ই বলতেন, দর্শকই আমার প্রাণ। সেই প্রাণ আজও বেঁচে রয়েছে হাজারো দর্শকের মাঝে। বেঁচে থাকবে চিরকাল এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
'শুভ জন্মদিন তারেক ভাই।'
লেখক-
ফজলুল হক
অভিনেতা