প্রথম পাতা
পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বললেন হাক্কানি
কূটনৈতিক রিপোর্টার
৬ ডিসেম্বর ২০২১, সোমবার, ৯:০০ অপরাহ্ন
স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির ভূয়সী প্রশংসা করে একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন ঢাকায় সফররত পাকিস্তানি কূটনীতিক যুক্তরাষ্ট্রের হাডসন ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিভাগের পরিচালক হোসেন হাক্কানি। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে তিনি এ নিয়ে কথা বলেন। সাংবাদিক-স্কলার কাম কূটনীতিক হোসেন হাক্কানি বলেন, বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার দাবি আমার মতো আরও অনেক পাকিস্তানি সমর্থন করেন। আমি নিশ্চিত, আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন, তাহলে অবশ্যই তিনি পাকিস্তানকে একাত্তরের অত্যাচারের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলতেন। যুক্তরাষ্ট্র ও শ্রীলঙ্কায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী হোসেন হাক্কানি বলেন, ক্ষমা চাওয়ার এই দাবি সবার। যারা বিশ্বাস করেন সমষ্টিগত ক্ষমাপ্রার্থনা কষ্ট মোচন করে এবং দুই দেশের মধ্যে ভুলে ভরা অতীতকে পেছনে ফেলে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে। রোববার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত দু’দিনব্যাপী ওয়ার্ল্ড পিস কনফারেন্স-২০২১ এর সফল সমাপ্তি ঘটে। যার সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চ্যুয়ালি বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়। আর হাই ব্রিড প্ল্যাটফরমে বক্তব্য রাখেন সিঙ্গাপুরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গো চক তং এবং ইউনেস্কোর প্রাক্তন মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা। সমাপনী অনুষ্ঠানে হোস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন, প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ছাড়া বিদেশিদের মধ্যে সশরীরে উপস্থিত হোসেন হাক্কানিই ছিলেন একমাত্র বক্তা। তিনি তার বক্তব্যের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করেন। বলেন, ১৪ বছর বয়সে করাচিতে প্রথম ও শেষবার আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তখন থেকেই তার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। হোসেন হাক্কানি বলেন, ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। করাচি ন্যাশনাল পার্কের জনসভায় পশ্চিম পাকিস্তান ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা, অধিকার, গণতন্ত্র ও ন্যায্যতার দাবিতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ রক্তক্ষয়ী সহিংসতা ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে উল্লেখ করে হাক্কানি বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত বিশ্বের অন্যসব রাষ্ট্রের জনগণের জন্য আদর্শ। ১৯৭৫ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বর্ণনা করা হয়েছিল, বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুধাপীড়িত এবং এটি একটি জনবহুল দেশ। বন্যা, খরা ও যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, অযোগ্য আমলাতন্ত্র এবং ব্যাপক দুর্নীতি এদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে একটি দুর্দশার আবর্তে বন্দি করে রেখেছে। কিন্তু আজ প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার হার, মাথাপিছু আয় ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেশি এমন পরিসংখ্যান দিয়ে পাকিস্তানি ওই কূটনীতিক বলেন, ১৯৪৭ সালের আগে ভারতের এবং ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের অংশ ছিল বাংলাদেশ। এ থেকে বোঝা যায় স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে! এটি সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মহান পিতার অসাধারণ কন্যা অভিহিত করে হাক্কানি বলেন, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যাদের পরিবারকে কেড়ে নেয়া হয়, তাদের মধ্যে সবাই সেই কষ্টকে শক্তিতে পরিণত করে মা-বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা পেরেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর পথ অনুসরণের জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাই। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা এবং শেখ হাসিনার কর্মের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যার ভেতরে ও সীমান্তে কোনো সহিংসতা নেই। হাক্কানি বলেন, বঙ্গবন্ধু সহিংসতায় বিশ্বাস করতেন না। ১৯৭২ সালে দেশে ফেরত আসার পর ভারতের সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করতে বলেছিলেন। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও স্থাপন করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, এই বিচার করার মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ যাতে ভবিষ্যতে সংঘটিত না হয় সে বিষয়ে অপরাধীদের সতর্কবার্তা দেয়া হয়। হাক্কানি বলেন, মহাত্মা গান্ধী বা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো বঙ্গবন্ধু যা বিশ্বাস করতেন, সেটা অর্জনের জন্য তার জীবনের এক পঞ্চমাংশ সময় তিনি জেলে কাটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা বলা হয়। কিন্তু আমি বলবো, তিনি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা রাজনৈতিক নেতা। বৃটিশ শাসনামলে মাত্র ছয়দিন তিনি জেলে কাটিয়েছিলেন উল্লেখ করে হাক্কানি বলেন, কিন্তু পরবর্তী জীবনে তিনি পাকিস্তানের ২৪ বছরের প্রায় দশ বছর জেলে ছিলেন। হাক্কানি বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি এবং বাস্তবতার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমরা এমন এক সময় পার করছি যখন আন্তর্জাতিকভাবে সবাই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এটা এমন একটি যুগ যখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে জাতিগুলোর অঙ্গীকার পেছনের দিকে ধাবমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানামুখী সংঘাত পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং বিশ্ব বিভিন্ন ব্লকে আবারো বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সকলকে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, শান্তিই হচ্ছে মানব উন্নতি ও সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত। ন্যায়বিচার, অন্তর্ভুক্তি এবং সহনশীলতাই শান্তির নিয়ামক। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে কোভিড মহামারির মধ্যেও আয়োজিত ঢাকা শান্তি সম্মেলনের ফলাফল প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন ওই কূটনীতিক। তার মতে, শান্তির আলোচনারত বুদ্ধিজীবী ও কর্মী যারা বিশ্বে নানারকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে ঢাকা সম্মেলন তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।