বিশ্বজমিন

ধর্ম অবমাননার অভিযোগ: শ্রীলঙ্কানকে পিটিয়ে হত্যা, লাশে আগুন: ‘পাকিস্তানের লজ্জা’ (ভিডিও)

মানবজমিন ডেস্ক

৪ ডিসেম্বর ২০২১, শনিবার, ১১:০৩ পূর্বাহ্ন

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কার নাগরিক প্রিয়ান্থা কুমারাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে উত্তেজিত জনতা। এরপর তার মৃতদেহে আগুন ধরিয়ে দেয়। ডিসি ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গিয়ে উত্তেজিত জনতার কাছ থেকে লাশ উদ্ধার করে তাদের হেফাজতে নিয়েছেন। এ ঘটনাকে পাকিস্তানের জন্য লজ্জার বলে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি অপরাধীদের শনাক্ত করে পূর্ণাঙ্গ আইনি ব্যবস্থায় কঠোর শাস্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা ও মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো। অন্যদিকে ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কলম্বো। তারা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

এ খবর দিয়েছে অনলাইন ডন।  এতে বলা হয়, ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার শিয়ালকোটের ওয়াজিরাবাদ রোডে অবস্থিত রাজকো ইন্ড্রাস্ট্রিজ নামের একটি গার্মেন্ট কারখানায়। এখানে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে ১০ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছিলেন প্রিয়ান্থা কুমারা। শুক্রবার এই কারখানার শ্রমিকরা কারখানায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। তাদের অভিযোগ- ধর্ম অবমাননা করেছেন প্রিয়ান্থা কুমারা। এ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় উগোকি পুলিশ স্টেশনের কয়েকজন পুলিশ। কিন্তু মুহূর্তে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা গণনার বাইরে চলে যায়। এ অবস্থায় পরিস্থিতিতে দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পুলিশ। স্থানীয় একজন সাংবাদিকের মতে, জেলা পুলিশ প্রধানকে অনেকবার মোবাইলে ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।

এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ওয়াজিরাবাদ রোডে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। বিক্ষোভে যোগ দেয় কারখানার সব শ্রমিক। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিপুল সংখ্যক স্থানীয় মানুষ। এত বিপুল পরিমাণ বিক্ষোভকারীকে দেখে ভবনের ছাদে উঠে যান প্রিয়ান্থা কুমারা। কিন্তু স্লোগান দিতে দিতে বিক্ষোভকারীরা তার পিছু নেয় এবং ধরে ফেলে। তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় রাস্তায়। এরপর প্রহার করা হয়। এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। জনতা তার মৃতদেহে আগুন ধরিয়ে দেয়।

এ খবরে শিয়ালকোটের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) তাহির ফারুক এবং জেলা পুলিশ কর্মকর্তা ওমর সাঈদ মালিক ভারি পুলিশ বহর নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তারা মৃতদেহ তাদের হেফাজতে নেন। রেসক্যু ১১২২ ডিস্ট্রিক্ট ইমার্জেন্সি অফিসার নাভিদ ইকবাল বলেছেন, তারা অবিলম্বে মৃতদেহ হস্তান্তর করেছেন শিয়ালকোটের আল্লামা ইকবাল টিচিং হাসপাতালে।

প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ ইফতিখার এবং মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেছেন, যখন বিক্ষোভ শুরু হয় এবং রোড ব্লক হয়ে যায়, তখন সেখানে উপস্থিত হন উগোকি পুলিশের মাত্র তিনজন সদস্য। যদি জেলা পুলিশ কর্মকর্তা স্পর্শকাতর এই বিষয়ে সময়মতো সাড়া দিতেন তাহলে এই হত্যা এড়ানো যেতো। এই ভয়াবহতার জন্য তারা পুলিশকে দায়ী করেন।
মোহাম্মদ হাফিজ এবং জব্বার খান স্মরণ করেন ২০১০ সালের ঘটনা।

ওই সময় বিক্ষোভকারীরা পিটিয়ে হত্যা করে দুই ভাইকে। তখনও সময়মতো পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি। শুক্রবারের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আমলে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী উসমান বুজদার। তিনি এ বিষয়ে প্রধান সচিব ও পাঞ্জাব আইজিপিকে রিপোর্ট দিতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, শিয়ালকোটের এই ভয়াবহতায় আমি চরমমাত্রায় শোকাহত। পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য আইজিপিকে নির্দেশ দিয়েছি। কাউকেই আইন তার নিজের হাতে তুলে নিতে দেয়া হবে না। কাউকে অমানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য ছাড় দেয়া হবে না। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নির্যাতনের ভিডিও সংগ্রহ করেছে পুলিশ। সন্দেহজনকভাবে তারা কমপক্ষে ১৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অজ্ঞাত স্থানে। ভয়াবহ এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এ দিনটিকে পাকিস্তানের জন্য লজ্জার বলে উল্লেখ করে বলেছেন, তদন্তের বিষয়টি আমিই তদারকি করছি। যারা দায়ী তাদেরকে আইনের কঠোরতার মধ্য দিয়ে শাস্তি দিতে কোনোই ভুল করা হবে না। গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যথাযথ তদন্তের মধ্য দিয়ে ন্যাবিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। মুখপাত্র সুগিশারা গুনারতœা বলেছেন, পাকিস্তানের শিয়ালকোটে একজন শ্রীলঙ্কানকে নির্যাতন শেষে তার মৃতদেহে আগুন ধরিয়ে দেয়ার রিপোর্ট পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিস্তারিত জানার প্রক্রিয়ায় রয়েছে ইসলামাবাদে অবস্থিত শ্রীলঙ্কান হাই কমিশন।

দিনশেষে পাঞ্জাম মুখ্যমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক স্পেশাল এসিসট্যান্ট হাসান খাওয়ার বলেছেন, এই নির্মম হত্যার প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা হচ্ছে।
এদিন সন্ধ্যায় পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যসচিব, আইজিপি, অতিরিক্ত মুখ্যসচিব (স্বরাষ্ট্র) স্পেশাল ব্রাঞ্চ অ্যান্ড কাউন্টার টেরোরিজম ডিপার্টমেন্টের অতিরিক্ত ইন্সপেক্টর জেনারেলের সঙ্গে সিভিল সেক্রেটারিয়েটে বৈঠক করেছেন পাঞ্জাবের আইনমন্ত্রী বাশারাত রাজা। এতে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন শিয়ালকোটের ডিসি এবং ডিপিও। তারা বলেছেন, মৃত শ্রীলঙ্কান ছিলেন একজন কঠোর প্রশাসক।

তাকে হত্যায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ১১০ জন সন্দেহভাজনকে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছিল। অপরাধীদের শনাক্ত করতে পুলিশ ওই কারখানার অন্য ম্যানেজারদের সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ছাড়াও ওই ম্যানেজার একজন কঠোর প্রশাসক ছিলেন এ বিষয়টি মাথায় রাখতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। গভীর রাতে আইজিপি জানান, এ ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন দু’জন ফারহান ইদ্রিস এবং উসমান রশিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ঠাণ্ডা মাথায় এ হত্যার কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া। ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স সেনাপ্রধানকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, যেকোনো মূল্যে এই রকম ভয়াবহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মেনে নেয়া যায় না। হায়েনার মতো অপরাধের জন্য দায়ীদের গ্রেপ্তারে এবং বিচারের আওতায় আনতে তিনি বেসামরিক প্রশাসনকে সব রকম সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। ওদিকে রাজনৈতিক মহল থেকে নিন্দার ঝড় বইছে। কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিষয়ক মন্ত্রী শিরিন মাজারি টুইটে বলেছেন, শিয়ালকোটে ওই কারখানার শ্রীলঙ্কান ম্যানেজারের ওপর হামলা এবং হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাই। কোনো অবস্থাতেই দাঙ্গাকারীদের সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে পাঞ্জাব রাজ্য সরকারকে। ঘটনা তদন্তে পাঞ্জাব সরকারকে সহায়তা করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার- এ মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ।

পাকিস্তান মুসলিম লিগ- নওয়াজের (পিএমএলএন) ভাইস প্রেসিডেন্ট মরিয়ম নওয়াজ এই বর্বর হত্যাকাণ্ডে নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এই হত্যা আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের কি পরিচয় তুলে ধরবে? অন্যদিকে অবিলম্বে, স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস কমিটি অব পাকিস্তান। নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারাও অবিলম্বে, নিরপেক্ষ, পক্ষপাতীত্বহীন এবং দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের শাস্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তান উলেমা কাউন্সিল এবং ইন্টারফেইথ হারমনি কাউন্সিল। তবে কট্টরপন্থি তেহরিকে লাব্বাইক পাস্তিান এ ঘটনা থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখেছে। তারা শুধু এ হত্যার নিন্দা জানিয়েছে।


   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status