মত-মতান্তর

আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবস

সালেক উদ্দিন

২ ডিসেম্বর ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১:৪০ অপরাহ্ন

ফাইল ফটো

২রা ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবস। প্রাচীন ও মধ্যযুগের তথা অন্ধকার যুগের যত মানবেতর অপকর্ম সংগঠিত হতো তার মধ্যে অন্যতম হলো দাস প্রথা। এই প্রথায় অর্থ ও শক্তির বলে বলিয়ান মানুষরা পণ্য হিসেবে মানুষকে কিনতো, মানুষকে বিক্রি করতো। দাস বেচাকেনার হাট বসতো, নিলাম ডাকা হতো। সেই সময় দাসদের গৃহপালিত পশুর মতো গোশালায় ঘোডাশালায় বেঁধে রাখা হতো। জোরপূর্বক শ্রমের জন্য বাধ্য করা হতো। পশুর মতো পেটানো হতো। দাস হত্যা করা আইনষিদ্ধ ছিল।

ক্রয়কৃত মানুষটির স্বাধীনতার শতভাগ হরণ করা এবং পণ্যের মতোই তাদের ব্যবহার করাই ছিল দাস প্রথার উদ্দেশ্য। পৃথিবীর এই অন্ধকারাচ্ছন্ন কলংকিত অধ্যায়ের সকল প্রভাবমুক্তির লক্ষে ১৯৪৯ সালের ২রা ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দাসত্ব বিলোপ করতে বিশ্বব্যাপী দাস প্রথা ও ব্যবসা নিষিদ্ধকরণের উপর কনভেনশন গৃহীত হয়। উদ্দেশ্য প্রাচীন ও মধ্যযুগের বর্বর দাস প্রথার নতুন মোড়কে এই সভ্য জগতে প্রচলিত মানবপাচার, যৌনদাস, জবরদস্তিমূলক শিশুশ্রম ইত্যাদি বন্ধের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো। মোদ্দাকথায় দুর্বলের উপর সবলের অন্যায় অবিচার রোধ করা। এজন্য এই দিনটি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

প্রাচীন ও মধ্যযুগে সমাজে দাস-দাসীর সংখ্যা দিয়ে প্রভাবশালী মানুষের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হতো। অমানবিক কার্যক্রম করানো হতো এই দাস-দাসী দিয়ে। প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতো তারা। দাসীদের ব্যবহার করা হতো যৌন লালসা পূরণে। তাদের সন্তান-সন্ততিরাও হতো খুদে দাস ও দাসী এবং তাদেরও বিক্রি করা হতো দাস বাজারে। দেশ-বিদেশে দাস-দাসী আমদানি-রপ্তানির একটি লাভজনক ব্যবসাও ছিল তখন।

ইতিহাস বলে ১৭৬০ সালে হাম্বুরাবি নামের বেবিলনের এক শাসক আইন করে দাসপ্রথা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপর পৃথিবীর অনেক সভ্যতায় এই প্রথার লালন করেছে। বিশেষ করে গ্রীক সভ্যতায় এর ভয়াবহতা ছিল ব্যাপক।
মানুষের জন্মগত অধিকারের বাতাস অন্ধকার যুগ ভেদ করে আসতে শুরু করলেও দাস প্রথা চলছিল সভ্য সমাজেও। ১৭৯১ সালের আগস্টে দাসপ্রথা তথা মানব নির্যাতনের বিরুদ্ধে বর্তমান হাইতি ও ডোমিনিকান রিপাবলিক অঞ্চলে বিক্ষোভ শুরু হয়।

সমাজে দাস প্রথার কুফল অনুমেয় ছিল দীর্ঘদিন থেকেই। দাসত্ব বিলোপ কনভেনশনের বহু আগে থেকেই দাস প্রথা বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল বিশ্বব্যাপী মানব সমাজ। ১৭৯১ সালের ২২শে আগস্ট বর্তমান হাইতি ও ২৩শে আগস্ট ডোমিনিকান রিপাবলিক অঞ্চলের বিক্ষোভ শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৮০৭ সালে ব্রিটেন এবং ১৮০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকান দাসদের মুক্তি দেয়। দাসত্ব বিলোপের সংগ্রাম তুঙ্গে উঠলে প্রথম যেসব দেশ এই দাসপ্রথা বিলুপ্তি ঘোষণা করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মেক্সিকো, ব্রিটেন, ডেনমার্ক, সুইডেন।

১৮২৯ সালে মেক্সিকো, ১৮৪৩ সালে ব্রিটেন, ১৮৪৬ সালে সুইডেন, ১৮৪৮ সালে ফ্রান্স ও ডেনমার্ক, ১৮৫৩ সালে আর্জেন্টিনা, ১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ১৮৮৬ সালে কিউবা, ১৮৮৮সালে ব্রাজিল, ১৮৯৬ সালে মাদাগাস্কার দাসপ্রথা বিলোপ করে।
এশিয়ায় দাস প্রথা বিলোপের বাতাস লাগে আরো অনেক পরে। ১৯১০ সালে চীন দাস প্রথা বিলোপের পর ১৯২৬ সালে নেপাল, ১৯২৩ সালে আফগানিস্তান, ১৯২৪ সালে ইরাক, ১৯২৮ সালে ইরান, ১৯২৯ সালে মিয়ানমার, ১৯৬২ সালে সৌদি আরব, ১৯৬৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত দাসপ্রথা বিলোপ করে।

জগৎজুড়ে দাসপ্রথা এবং সেই প্রথার বিলুপ্তি ইতিহাস বর্ণনা এই লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। মানব ইতিহাসে কলঙ্কময় অধ্যায়- দাস প্রথার বিলুপ্তি কনভেনশন যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রবর্তিত হয়েছিল সেই উদ্দেশ্য কতটা সাধিত হয়েছে সেটাই এই লেখার বিবেচ্য বিষয়।

আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলুপ্তি কনভেনশনের উদ্দেশ্যই ছিল দুর্বলের উপর সবলের নির্যাতন, মানব পাচার, যৌনদাসী সৃজন ও লালন, শিশুশ্রম বন্ধ, জবরদস্তি করে বিযয়ে এবং সেই মাধ্যমে দাসিতে পরিণত করা ইত্যাদি সমাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরসন। কিন্তু উদ্দেশ্য কি চরিতার্থ হয়েছে ? নাকি মধ্যযুগীয় দাসপ্রথা নতুন মোড়কে আধুনিক গণতান্ত্রিক সভ্য বিশ্বে বহুল তবিয়তে জেঁকে বসেছে।

পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলো তো বটেই এমনকি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও মানব নির্যাতন, নারী পাচার, অর্থ ক্ষমতা ও শক্তির অপব্যবহার, যৌনদাসী সৃজন ও লালন ইত্যাদির মাধ্যমে দাসপ্রথার কর্মকা- যে অব্যাহত রয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আগে দাসদের রপ্তানি বাণিজ্য চলতো, প্রকাশ্য বাজারে দাস-দাসী কেনাবেচা হত, অমানবিক পরিশ্রম করানো হতো তাদের দিয়ে এবং এই শ্রমের মূল্য তারা পেত না। মূল্য পেত তৃতীয় পক্ষ। এখনো অসৎ ম্যানপাওয়ার রপ্তানি ব্যবসায়ীদের কর্মকা-ে এই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি যে ঘটছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত সংগঠিত হচ্ছে মানব পাচারের বিভিন্ন মানবেতর ঘটনা। নারী পাচার সে তো তৃতীয় বিশ্বের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা প্রবাহের একটি। শুধু আমাদের দেশের কথাই যদি বলি তাহলে বলতেই হয় এদেশের শক্তিশালী নারী পাচার চক্রের বদৌলতেই পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পতিতালয়ের শোভা বর্ধিত হচ্ছে পাচারকৃত বাঙালি রমণীদের দিয়ে। দাসপ্রথা প্রচলিত সেই সমাজের দাসীদের মতই তারা ঠুকরে ঠুকরে মরছে অন্ধ গলিতে।

শুধু কি তাই বিদেশে গৃহকর্মী পাঠানোর নাম করে আরব বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশে যে রমণীদের পাঠানো হচ্ছে তাদের চিৎকার এখনো মরুর আকাশ বাতাসে ঘুরপাক খায়। যৌন নির্যাতন থকে শুরু করে এমন কোন নির্যাতন নেই যা তাদের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে না। যেন মধ্যযুগের দাস প্রথার আধুনিক উদাহরণ। দেশের পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে এসব বিষয় নিয়ে বেশ তোলপাড় হয় আবার কার ইশারায় যেন তা থেমে যায়।

দাসত্ব বিলোপ কনভেনশন গৃহীতের শতবার্ষিকী উদযাপন প্রায় কাছে চলে এসেছি আমরা। এই দীর্ঘ সময় পার করেও বলা যেতেই পারে কনভেনশনের উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়নি। পৃথিবীতে বিভিন্ন অঞ্চলে দাসপ্রথার কার্যকলাপ ভিন্ন আঙ্গিকে চলছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আরব ও আফ্রিকার অঞ্চলে এর প্রভাব এখনো প্রখর।

আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপের কনভেনশনে ধারণা করা হয়েছিল যে অভিশপ্ত এই প্রথা আর ফিরে আসবেনা। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনও সম্পদশালী ভূমি মালিকদের জমি চাষে ‘কৃষক ক্রীতদাস’ রয়েছে, রয়েছে শিশুশ্রমের অবাধ ব্যবহার। পতিতাবৃত্তিতে বাধ্যকরা। জোরপূর্বক বিযয়ের প্রবণতা বন্ধ হয়ার লক্ষণ নেই। এসব অবশ্যই দাসত্বের আওতায় পড়ে।এইসব কর্মকান্ডকে এক কথায় বললে বলা যেতে পারে আধুনিক দাসবাদ।

সমাজে আধুনিক দাসবাদ বন্ধ হবে - সেটাই আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবসের প্রত্যাশা।সেই প্রত্যাশা পূরণের প্রত্যুয় পরিকল্পনা ও প্রস্তুুতি আমাদের রয়েছে কিনা তা প্রমানের সময় এসেছে।


লেখকঃ কথা সাহিত্যিক, কলামিস্ট, জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমি।
নাট্যকার, গীতিকার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status