মত-মতান্তর

বিশ্বমানের চিকিৎসার দেশে ছাগল চোর আর ঝাড়ুদার সার্জন কাহিনী

যুক্তরাজ্য থেকে ডা. আলী জাহান

১ ডিসেম্বর ২০২১, বুধবার, ১১:৫৩ অপরাহ্ন

১. বাংলাদেশি চিকিৎসকদের নির্বাচিত পেশাজীবী সংগঠন বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন) সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসা বাংলাদেশে করার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা বাংলাদেশে হচ্ছে। তারা আরও দাবি করেছেন যে, প্রায় সব জটিল রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব। অবশ্য তারা এ কথাও বলেছেন যে, বিদেশী চিকিৎসক এসে দেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করতে পারেন। উনাদের এই কথার সাথে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার দায়িত্বে নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বক্তব্যের কোনো মিল নেই। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসার দায়িত্বে নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অতিসত্বর তাকে দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার দায়িত্ব কি বিএমএ নিতে চাইছে?

২. কার চিকিৎসা কোথায় হবে তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব কি এ পেশাজীবী সংগঠনের? বিবৃতি পড়ে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। পেশাজীবী সংগঠনের দায়িত্ব হচ্ছে ডাক্তারদের স্বার্থ রক্ষা করা, চিকিৎসার জন্য নিরাপদ কর্মস্থল সৃষ্টি নিশ্চিত করা, চিকিৎসকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য সরকারের সাথে দেন-দরবার করা। কার চিকিৎসা কোথায় হবে তা নির্ধারণ করার মহান দায়িত্ব এই পেশাজীবী সংগঠনকে দিলো কে? 

৩. যারা এখনো এমবিবিএস পাস করেননি কিন্তু থার্ড বা ফোর্থ ইয়ারে পড়ছেন তারাও জানেন, লিভার সিরোসিসের চূড়ান্ত চিকিৎসা হচ্ছে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট। বিএমএ’র বক্তব্য অনুসারে বাংলাদেশে সফলভাবে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে যেহেতু, বাংলাদেশে বিশ্বমানের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ব্যাপারটা কি আসলেই তাই? 

৪. মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরামের এডমিন লেখিকা শারমিন আক্তার একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন। প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। কিন্তু উনার প্রশ্নটি নিয়েই আমি ভাবছি। পাঠকরা দেখুন তো আপনারা দিতে পারেন কিনা। অথবা বিএমএ নেতৃবৃন্দ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন কিনা। তার বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে বিশ্বমানের চিকিৎসা যদি থেকে থাকে তাহলে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কেন চিকিৎসার জন্য বাইরে যান? আশা করি বিএমএ নেতৃবৃন্দ এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন।

৫. মাঝেমধ্যে পত্রিকায় খবর আসে বাংলাদেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য লন্ডন, সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ড যাচ্ছেন। সর্দি-কাশি পরীক্ষা করার জন্য অমুক মন্ত্রী বা এমপি আমেরিকা যাচ্ছেন। সামান্য সর্দি-কাশি, চোখের ক্যাটারাক্ট অপারেশন, বদহজমের চিকিৎসার জন্য যখন ক্ষমতাশালীরা দেশের বাইরে যান তখন চিকিৎসক হিসেবে আপনাদের লজ্জা লাগে না? কখনো উনাদেরকে বলতে পারেন না যে দেশেই চিকিৎসা আছে, আপনারা বিদেশে যাবেন না। আপনারা সেই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেননি এবং পারবেন না। তাহলে এ প্রশ্ন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ক্ষেত্রে করছেন কেন? যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সর্দি, হাঁচি, কাশি, বদহজমের চিকিৎসা করতে পারে না সে দেশের চিকিৎসকরা কীভাবে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করবেন? করতেও পারেন। কিন্তু আপনাদের আস্থা আছে তো?

৬.  বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার(বিশেষ করে সরকারি) কী অবস্থা  তা যারা দেশে আছেন এবং এই হাসপাতালগুলো ভিজিট করেছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন।  ব্যাপারটা বোঝার জন্য ক’দিন আগে প্রকাশিত দুটি খবর আপনাদের সামনে উপস্থাপন করবো।

৭. ১৮ই নভেম্বর দেশের প্রায় সবকটি পত্রিকার অন্যতম একটি খবর ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক কান গলা বিভাগে ঐ হাসপাতালের ঝাড়ুদার সবুজ অস্ত্রোপচার করছিলেন। বাংলাদেশের সরকারি এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর যে র‍্যাঙ্কিং আছে তার শীর্ষে অবস্থানকারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন ঝাড়ুদার যদি অপারেশন করেন তাহলে বাকি হাসপাতালগুলোতে কি হচ্ছে?  

৮. ২৩শে নভেম্বর অনেকগুলো বাংলা দৈনিকের একটি শীর্ষ খবর ছিল পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার এবং কর্মচারীরা মিলে অসহায় এক ব্যক্তির ছাগল চুরি করে ভুরিভোজ করেন। এই মহান কাজে অংশ নেন হাসপাতালের দায়িত্বরত ৫ জন ডাক্তার এবং কয়েকজন কর্মচারী। ঘটনার কোনো ফলোআপ রিপোর্ট নেই। তবে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন তথ্য নেই। ডাক্তারদের অবস্থা এমন খারাপ যে ছাগল চুরি করতে হবে?

৯. ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ঝাড়ুদার কেন অপারেশন করবেন? নাজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তাররা কেন ছাগল চুরিতে (অভিযোগ) অংশগ্রহণ করবেন? এ বিষয়গুলো নিয়ে বিএমএ’র কথা বলা উচিত ছিল। সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপর হওয়া উচিত ছিল। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তারদের আর্থিক অবস্থা কেন এমন খারাপ হলো যে ছাগল চুরি করতে হবে তা নিয়ে বিএমএ'র তদন্ত করা উচিত ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তারদের কেন এতো অভাব পড়লো যে জন্য অস্থায়ী ঝাড়ুদার অপারেশন করবে তা নিয়ে যে তদন্ত হচ্ছে তাতে বিএমএ’র অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল।

১০. বাংলাদেশে কথা বলতে কোনো ট্যাক্স লাগে না। কথা বলার জন্য কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে মুখে যা আসে তাই স্বাধীনভাবে বলে ‌যাচ্ছেন কর্তাব্যক্তিরা। এসব কথাবার্তা শুনে আমরা যে লজ্জা পাচ্ছি তা কিন্তু উনারা বুঝতে চাইছেন না।

১১. স্বঘোষিত বিশ্বমানের চিকিৎসা প্রদানকারী দেশের চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠনের উচিত কার চিকিৎসা কোথায় হবে তা তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের ওপর ছেড়ে দেয়া। উনাদের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। একটু সময় থাকলে সরকারি হাসপাতালে ইমারজেন্সি ডিপার্টমেন্টে ডাক্তারদের অসহায় অবস্থা দেখে আসুন। উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে ডাক্তাররা কী রকম অমানবিক পরিবেশে আছেন তা একটু তদন্ত করে আসুন। ছাগল চুরি বন্ধ করুন। ঝাড়ুদার আর ক্লিনারদের দিয়ে অপারেশন বন্ধ করানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করুন। সম্মানের  এবং নিরাপত্তার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করার পরিবেশ নিশ্চিত করুন। কার চিকিৎসা কোথায় হবে তা নির্ধারণ করা আপনাদের কাজ নয়। ওই বিষয়গুলো ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিন। মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি না করলেও পারেন। দিন শেষে আপনারা চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ নন।

--- 

ডা. আলী জাহান 

যুক্তরাজ্যে কর্মরত বাংলাদেশি চিকিৎসক 

[email protected]

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status