মত-মতান্তর

রাজনীতির উত্তাপ এখন বাজারে!

ড. মাহফুজ পারভেজ

৭ নভেম্বর ২০২১, রবিবার, ২:৫২ অপরাহ্ন

শীতকালে বাংলাদেশের রাজনীতি উতপ্ত হয়, এমনটিই বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। বাংলাদেশের রাজনীতির এই পরিচিত ছবি হঠাৎ বদলে গেছে। রাজনীতির উত্তাপ চলে গেছে বাজারে। চারিদিকে মূল্যবৃদ্ধির আগুনে মানুষের নাভিশ্বাস।

কয়েক মাস ধরেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে চলছে দাম বৃদ্ধির পাগলা ঘোড়া। দামের অস্থিরতায় লবেজান আমজনতা। জরুরি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে কয়েক দফায়। চাল, তেল, মাছ, মাংস, এমনকি মাঠভর্তি শীতের সবজিও রয়েছে ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির তালিকায়।

দাম বাড়ার বিপদের মধ্যেই হঠাৎ জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাজারের আগুনকে যেন দাবানলে পরিণত করেছে। প্রতি সপ্তাহেই প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে দ্রব্যমূল্যে। ধর্মঘটের কারণে পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ থাকায় পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। এতেই পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ বড় ধরনের ভোগান্তির মুখে পড়েছেন। নির্ধারিত বেতনের চাকুরিজীবীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। মাসের খরচ চালাতে হীমসীম অবস্থা অনেকেরই।

যারা নিত্যদিন বাজার করেন, তাদের অভিজ্ঞতা মর্মান্তিক। প্রতিদিন বাজারে নতুন নতুন দাম দেখে তারা অস্থির, বিব্রত ও পর্যুদস্ত। পেয়াজ, আলু, পটোল, টমেটো, গাজর, কাঁচা মরিচসহ বেশির ভাগ সবজির দাম পরিবহন ধর্মঘটের আগের তুলনায় পাঁচ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এরই আগে বেড়েছে ভোজ্য তেলের দাম। প্রতিটি পণ্যেই মূল্যবৃদ্ধির ছাপ।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ইত্যাদি বড় শহরকে নির্ভর করতে হয় দেশের নানা স্থানে উৎপাদিত পণ্যের উপর। সাধারণত সবজি বেশি আসে নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে। আগে যে ট্রাকের ভাড়া ছিল ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা, এখন সে ট্রাকের ভাড়া সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা। সেই বাড়তি ভাড়া পণ্যের সঙ্গে যোগ করেই পাইকারি বাজারে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে পথে পথে অদৃশ্য চাঁদাবাজি। এসব অব্যবস্থায় পণ্যে দাম বেড়েছে। পকেট কাটা হচ্ছে সাধারণ নাগরিকদের।

বাজার ব্যবস্থার ভোগান্তি ভোগ করছেন সাধারণ মানুষ। ক্রেতা অধিক মূল্য দিলেও উৎপাদনকারী পাচ্ছেন না প্রকৃত মূল্য। মাঠের কৃষকদের সাথে সাংবাদিকরা কথা বলে জেনেছেন, তাদের কাছ থেকে সবজি কম দামে কিনে পাইকারি বাজারে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে কৃষকদের মাথায় হাত বুলিয়ে লাভবান হচ্ছে ফড়িয়া ব্যাপারিরা। আর সাধারণ ক্রেতারা সবজি কিনতে গিয়ে দিশেহারা। কৃষকরাও হতাশ। গ্রামের পাইকারি বাজারে বেগুন প্রকার ভেদে ৪০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পেঁপে ১৫ টাকা কেজি , শসা ৪০ টাকা কেজি, করলা ৬০ টাকা কেজি, বরবটি ৫০ টাকা, ঝিঙ্গা ৩০ টাকা, ফুলকপি ৫০-৫৫ টাকা কেজি, বাঁধাকপি ৪০-৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রামে এসবই দুই-তিন গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে, যার কোনও অংশই কৃষকরা পান না।

যেসব জায়গা থেকে শাক-সবজি আসে, সেখানে ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা স্থানীয় কৃষকদের থেকে খুব অল্প টাকায় বিভিন্ন শাক-সবজি কিনে থাকেন। সেই কৃষিপণ্য কিনে নেয় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় বাজারের ফড়িয়া এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা মিলেই অল্প পুঁজি দিয়ে কৃষকদের ঠকিয়ে বড় অঙ্কের লাভ করেন। আর সাধারণ ক্রেতারাও বেশি টাকায় পণ্য কিনতে বাধ্য হন।

বাস্তবে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রায় সব ধরনের সবজির দামই বেড়ে গেছে। দুই দিন আগে যে বেগুন ৫০-৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে, সেই বেগুন এখন ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া যে সাইজের ফুলকপি দুইদিন আগে ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেগুলো এখন ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার ৫৫-৬০ টাকাও চাওয়া হচ্ছে। দুইদিন আগে বাজারগুলোতে শিম বিক্রি হয়েছে ১২০-১৩০ টাকায়, একই মানের শিম গতকাল বিক্রি হয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। বেড়েছে পেঁয়াজের দামও। দুইদিন আগে খুচরা বাজারে দেশি পিয়াজ কেজিতে ৫০-৫৫ টাকায় পাওয়া গেছে। তবে গতকাল একই মানের পেঁয়াজ বিক্রেতাদের ৬০-৬৫ টাকা দাম চাইতে দেখা যায়। এ ছাড়া গতকাল খুচরা বাজারগুলোতে ঢেঁড়স কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, টমেটো ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, গাজর ১২০ থেকে ১৬০ টাকা, বরবটি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, পটল ৪০ থেকে ৫০ টাকা, মূলা, চিচিঙ্গা ও ঝিঙে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, করলা ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এসব সবজির মধ্যে বেশির ভাগ সবজিই একদিন আগে মান ও প্রকারভেদে কেজিতে প্রায় ৫ থেকে ১০, ১৫ টাকা কমে পাওয়া গেছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছর করোনার শুরুতে যে দাম বাজারে ছিল তার চেয়ে এখন সব ধরনের পণ্যে ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ বেশি। গেল দুই সপ্তাহে বাজারে বেড়েছে পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও সবজির দাম। পেঁয়াজের দাম মোটামুটি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। যে দেশি পেঁয়াজ ৪০ টাকা কেজিতে কেনা যেত, তা কিনতে এখন ৭০ টাকা লাগছে। ১২৫ টাকার ব্রয়লার মুরগি এখন দাঁড়িয়েছে ১৮০ টাকায়।

প্রায় সবাই লক্ষ্য করেছেন যে, নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যের দামও কেমন করে বেড়েছে। মাস তিনেক আগে বাজারে ১০০ গ্রাম ওজনের একটি সাবানের দাম ছিল ৩৫ টাকা। সেটা এখন ৪০ টাকায় বিক্রি করছে তারা। বেড়েছে ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, নারকেল তেল, শৌচাগারে ব্যবহার করা টিস্যুসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। সুপরিচিত আরেকটি ব্র্যান্ডের এক প্যাকেট টিস্যুর দাম ছিল ১৭ টাকা, যা এখন ২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।

মিডিয়ায় রাজধানীর মাটিকাটা এলাকার বাসিন্দা মামুনুর রশিদ বলেছেন, 'প্রতিদিন তো সবজি কিনতেই পারি নাই। হঠাৎ এতো দাম যে বাড়বে সেটা কল্পনাও করতে পারিনি। শুধু সবজি নয়, বাজারে তো এখন কোনো কিছুই আর সস্তা নাই। দিন দিন শুধু দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। এসব দেখার কেউ নাই।'

মামুনুর রশিদ নিজের মুখে আমজনতার কথাই বলেছেন। 'এসব দেখার কেউ নাই', পরিস্থিতি আসলেই তাই। মাঠ থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত সঠিকভাবে মনিটরিং না করার কারণেই বাজারের এই অস্থিরতা। বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠ প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ থাকলে এমন হতো না। নানা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি এবং এর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাবে জ্বলেপুড়ে যেতো না মানুষের জীবন। রাজনীতির যে উত্তাপ দেখে মানুষ অভ্যস্ত, তা আপাতত স্তিমিত হলেও এখন উত্তপ্ত বাজার জনজীবনে তাণ্ডব ছড়াচ্ছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status