মত-মতান্তর
জমজম কূপের অলৌকিকত্ব এবং প্রাকৃতিক বাস্তবতা
গাজী মিজানুর রহমান
২০২১-১১-০৬
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) তার মাতার সঙ্গে মক্কায় বসবাসকালীন সময়ে একদিন তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে মাতা হাজেরা (আ.) সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে পানির সন্ধানে দৌড়াতে থাকেন। তখন জমজম কূপ আবিষ্কৃত হয়নি। পানি না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত মাতা একপর্যায়ে দেখেন পুত্রের পায়ের নিচ থেকে পানির ধারা উঠে আসছে। আঁজলা ভরে পানি নিয়ে সন্তানের তৃষ্ণা নিবারণ করেন তিনি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘জমজম’ যার অর্থ থামো (ছড়িয়ে পড়ো না, আমার সন্তানকে পান করতে দাও)! তাঁর আনন্দাশ্রু হয়তো সেদিন মিশে গিয়েছিল জমজমের পানিতে। দ্রুতহাতে মাটি সরিয়ে হাজেরা (আ.) সেদিন অলৌকিকভাবে যে পানির উৎস খুঁজে পেয়েছিলেন, তা থেকে আজও সংগৃহীত হচ্ছে অবারিত পানি, যা জমজম-পানি বলে পরিচিত।
কাবা শরীফ থেকে ৬৬ ফুট দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ১০০ ফুট গভীর জমজম কুয়ার ভেতরে ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১ ফুট নিচে থেকে এখন পানির অস্তিত্ব শুরু। পানির নিচে সেডিমেন্ট স্তর এবং একেবারে নিচে পাথরের স্তর। পাথরের স্তর ভেদ করে কয়েকটি জায়গা দিয়ে পানি কুয়ায় এসে জমা হয়। সে পানি আজ লাখ লাখ হাজি এবং মক্কাবাসীর কাছে অতি প্রিয় পানীয় জল। জমজমের ইতিহাস আর মক্কার ইতিহাস আজ এক হয়ে গেছে। মরুর দেশে যেখানে মরুদ্যানের ছায়া আর যেখানে পানির উৎস, সেখানেই জীবনের কোলাহল জাগে। জমজম কূপের কারণে তাই মক্কায় নতুন বসতি গড়ে উঠেছিল। সেইসাথে ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক কাবা ঘরকে ইবাদতের স্থান হিসেবে পুনর্নির্মাণ করার ফলে ধীরে ধীরে মক্কা এক মর্যাদাসম্পন্ন নগরে পরিণত হয়। এর পরিপূর্ণতা আসে ইসমাইল (আ.) এর বংশে ইসলামের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (স.) এর জন্মের ভেতর দিয়ে ।
মক্কা লোহিত সাগরের খুব কাছে। সৌদি আরবের ভূপ্রাকৃতিক মানচিত্র দেখলে বুঝা যায় যে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার বিবেচনায় লোহিত সাগরের পাড়ের স্থানগুলি সবচেয়ে নিচু। এদের উচ্চতা ০-১০০ মিটারের মধ্যে। অন্যদিকে সমগ্র মধ্যাঞ্চলের উচ্চতা .২০০ থেকে ১০০০ মিটার। আবার সমুদ্রের কাছে অবস্থিত হলেও তায়েফ থেকে নাজরান পর্যন্ত বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা ২০০০-৩০০০ মিটার উচ্চতায় রয়েছে। অপরদিকে, এই পাহাড়-সংলগ্ন এলাকা ১০০০-২০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এরকম উঁচু ভূমির কাছাকাছি এবং লোহিত সাগরের পাড় থেকে মাত্র ৪৩ মাইল দূরে অবস্থিত মক্কা উপত্যকা জেদ্দা-সংলগ্ন নিম্নভূমি অপেক্ষা উঁচু হলেও সমগ্র মধ্যাঞ্চল অপেক্ষা নিচু। সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২৭৭ মিটার। আমরা জানি, যখন বৃষ্টিপাত হয় তখন পানি উঁচু স্থান থেকে গড়িয়ে নদী অথবা নিচু এলাকা দিয়ে সাগরে প্রবাহিত হ্য়। কিছু পানি ভূতলে প্রবেশ করে।
সেভাবে মরুভূমির দেশে বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানি মরুভূমির বালুকা রাশি ভেদ করে মাটির তলদেশে পাথরের খাঁজে খাঁজে গিয়ে জমা হয়। আর মাটির নিচে পানিপূর্ণ থালার মতো থৈ থৈ করে। এটা সব স্থানে হয় না। ভূগর্ভস্থ পানির গতিপথে অপেক্ষাকৃত নিচু স্থানবিশেষে এমন হতে পারে । মক্কা উপত্যকার তলদেশ এমন একটা ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। অনুমান করা যায় যে, জমজম কুয়া এমন এক ভূগর্ভস্থ বিস্তীর্ণ পানির উৎসের কেদ্রবিন্দুতে অবস্থিত ।
জমজম থেকে আগে কায়িক পরিশ্রমে পানি তোলা হতো এখন পাম্পের সাহায্যে মিলিয়ন মিলিয়ন লিটার পানি উঠানো হয়। মিশরের পত্রিকা ইজিপ্ট টু-ডে এবং ম্যাজেস্টিক ইসলাম ওয়ার্ডপ্রেস ডটকম এর দেয়া তথ্য মতে, প্রতি সেকেন্ড ৮০০০ লিটার গতিতে পানি তুললে দৈনিক ৭০০ মিলিয়ন লিটার পানি তোলা যায়। এ পরিমাণ পানি তুললে ভূপৃষ্ঠ থেকে কুয়ার পানির স্তর ৪৪ ফুট নিচে নেমে যায়। আবার পানি তোলা ১১ মিনিট বন্ধ রাখলে পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৩ ফুট নিচ পর্যন্ত উঠে আসে, অর্থাৎ তুলে নেয়া পানি পুনর্ভরণ হয়ে যায়। সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ হাজি সাহেবগণ হজ মৌসুমে মক্কায় হজ করতে যান। এছাড়া প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ ওমরাহ পালন করে থাকেন। হাজি সাহেবগণ এবং মক্কার বাসিন্দাগণ অকাতরে পানি পান করেন আর ক্যানভর্তি করে নিয়ে যান ; তবু জমজমের পানি অফুরন্তই রয়ে যায়। এটা মহান আল্লাহর এক কুদরতি নিয়ামত। জমজমের পানির প্রতি মানুষের মহব্বত দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় ।
বালুর স্তর আর পাথরকণার স্তর ভেদ করে ভূগর্ভস্ত বৃষ্টির পানি কুয়ায় এসে কুয়ার উপরিভাগে স্থান নেয়। ফলে এ পানি প্রাকৃতিকভাবে সর্বাধিক দূষণমুক্ত। গবেষণায় দেখা গেছে যে জমজমের পানির প্রাকৃতিক উপাদান স্বাস্থ্যের জন্য এবং রোগপ্রতিরোধের জন্য অতি উত্তম। বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানি উত্তোলন, পরীক্ষণ এবং সরবরাহকরণ কাজ চলে। আগের দিনে যখন মিডিয়া, প্রযুক্তি এবং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া এত নিবিড় ছিল না, তখনও বিশ্বের নানা স্থানের মানুষ জমজমের পানি নিয়ে গবেষণা করেছেন বলে জানা যায়। তাদের পরীক্ষায় জমজমের পানি দূষণমুক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখন বিশ্বের যে কোনো স্থানে বসে জমজমের পানি নিয়ে পরীক্ষা চালানো সহজ। তবে এই পানি রপ্তানিযোগ্য এবং বিক্রয়যোগ্য নয় বলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে সংগ্রহ করতে হবে, নইলে বিভ্রান্তি হতে পারে। একবার ইংল্যান্ডের দোকানে দোকানে বিক্রয়ের জন্য রাখা জমজমের পানি নিয়ে বি.বি.সি পরীক্ষা করে বলেছিল দূষণের মাত্রা বেশি।
সেই পানি জমজমের পানি ছিল না। জমজম একি আল্লাহ-প্রদত্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। এই কূপ নিয়ে যে অলৌক্কিত্ব আছে, তা হচ্ছে এর আবিষ্কারের মধ্যে। মাটির অনেক নিচে হাজার হাজার বছর পড়ে থাকা কুয়া সেদিন এক তৃষ্ণার্ত শিশুর ক্রন্দন আর তার মায়ের আকুতি শুনে হঠাৎ নিজেকে যেভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেটাই হচ্ছে জমজমের অলৌকিকত্ব ।
লেখক : সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট
কাবা শরীফ থেকে ৬৬ ফুট দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ১০০ ফুট গভীর জমজম কুয়ার ভেতরে ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১ ফুট নিচে থেকে এখন পানির অস্তিত্ব শুরু। পানির নিচে সেডিমেন্ট স্তর এবং একেবারে নিচে পাথরের স্তর। পাথরের স্তর ভেদ করে কয়েকটি জায়গা দিয়ে পানি কুয়ায় এসে জমা হয়। সে পানি আজ লাখ লাখ হাজি এবং মক্কাবাসীর কাছে অতি প্রিয় পানীয় জল। জমজমের ইতিহাস আর মক্কার ইতিহাস আজ এক হয়ে গেছে। মরুর দেশে যেখানে মরুদ্যানের ছায়া আর যেখানে পানির উৎস, সেখানেই জীবনের কোলাহল জাগে। জমজম কূপের কারণে তাই মক্কায় নতুন বসতি গড়ে উঠেছিল। সেইসাথে ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক কাবা ঘরকে ইবাদতের স্থান হিসেবে পুনর্নির্মাণ করার ফলে ধীরে ধীরে মক্কা এক মর্যাদাসম্পন্ন নগরে পরিণত হয়। এর পরিপূর্ণতা আসে ইসমাইল (আ.) এর বংশে ইসলামের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (স.) এর জন্মের ভেতর দিয়ে ।
মক্কা লোহিত সাগরের খুব কাছে। সৌদি আরবের ভূপ্রাকৃতিক মানচিত্র দেখলে বুঝা যায় যে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার বিবেচনায় লোহিত সাগরের পাড়ের স্থানগুলি সবচেয়ে নিচু। এদের উচ্চতা ০-১০০ মিটারের মধ্যে। অন্যদিকে সমগ্র মধ্যাঞ্চলের উচ্চতা .২০০ থেকে ১০০০ মিটার। আবার সমুদ্রের কাছে অবস্থিত হলেও তায়েফ থেকে নাজরান পর্যন্ত বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা ২০০০-৩০০০ মিটার উচ্চতায় রয়েছে। অপরদিকে, এই পাহাড়-সংলগ্ন এলাকা ১০০০-২০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এরকম উঁচু ভূমির কাছাকাছি এবং লোহিত সাগরের পাড় থেকে মাত্র ৪৩ মাইল দূরে অবস্থিত মক্কা উপত্যকা জেদ্দা-সংলগ্ন নিম্নভূমি অপেক্ষা উঁচু হলেও সমগ্র মধ্যাঞ্চল অপেক্ষা নিচু। সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২৭৭ মিটার। আমরা জানি, যখন বৃষ্টিপাত হয় তখন পানি উঁচু স্থান থেকে গড়িয়ে নদী অথবা নিচু এলাকা দিয়ে সাগরে প্রবাহিত হ্য়। কিছু পানি ভূতলে প্রবেশ করে।
সেভাবে মরুভূমির দেশে বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানি মরুভূমির বালুকা রাশি ভেদ করে মাটির তলদেশে পাথরের খাঁজে খাঁজে গিয়ে জমা হয়। আর মাটির নিচে পানিপূর্ণ থালার মতো থৈ থৈ করে। এটা সব স্থানে হয় না। ভূগর্ভস্থ পানির গতিপথে অপেক্ষাকৃত নিচু স্থানবিশেষে এমন হতে পারে । মক্কা উপত্যকার তলদেশ এমন একটা ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। অনুমান করা যায় যে, জমজম কুয়া এমন এক ভূগর্ভস্থ বিস্তীর্ণ পানির উৎসের কেদ্রবিন্দুতে অবস্থিত ।
জমজম থেকে আগে কায়িক পরিশ্রমে পানি তোলা হতো এখন পাম্পের সাহায্যে মিলিয়ন মিলিয়ন লিটার পানি উঠানো হয়। মিশরের পত্রিকা ইজিপ্ট টু-ডে এবং ম্যাজেস্টিক ইসলাম ওয়ার্ডপ্রেস ডটকম এর দেয়া তথ্য মতে, প্রতি সেকেন্ড ৮০০০ লিটার গতিতে পানি তুললে দৈনিক ৭০০ মিলিয়ন লিটার পানি তোলা যায়। এ পরিমাণ পানি তুললে ভূপৃষ্ঠ থেকে কুয়ার পানির স্তর ৪৪ ফুট নিচে নেমে যায়। আবার পানি তোলা ১১ মিনিট বন্ধ রাখলে পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৩ ফুট নিচ পর্যন্ত উঠে আসে, অর্থাৎ তুলে নেয়া পানি পুনর্ভরণ হয়ে যায়। সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ হাজি সাহেবগণ হজ মৌসুমে মক্কায় হজ করতে যান। এছাড়া প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ ওমরাহ পালন করে থাকেন। হাজি সাহেবগণ এবং মক্কার বাসিন্দাগণ অকাতরে পানি পান করেন আর ক্যানভর্তি করে নিয়ে যান ; তবু জমজমের পানি অফুরন্তই রয়ে যায়। এটা মহান আল্লাহর এক কুদরতি নিয়ামত। জমজমের পানির প্রতি মানুষের মহব্বত দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় ।
বালুর স্তর আর পাথরকণার স্তর ভেদ করে ভূগর্ভস্ত বৃষ্টির পানি কুয়ায় এসে কুয়ার উপরিভাগে স্থান নেয়। ফলে এ পানি প্রাকৃতিকভাবে সর্বাধিক দূষণমুক্ত। গবেষণায় দেখা গেছে যে জমজমের পানির প্রাকৃতিক উপাদান স্বাস্থ্যের জন্য এবং রোগপ্রতিরোধের জন্য অতি উত্তম। বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানি উত্তোলন, পরীক্ষণ এবং সরবরাহকরণ কাজ চলে। আগের দিনে যখন মিডিয়া, প্রযুক্তি এবং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া এত নিবিড় ছিল না, তখনও বিশ্বের নানা স্থানের মানুষ জমজমের পানি নিয়ে গবেষণা করেছেন বলে জানা যায়। তাদের পরীক্ষায় জমজমের পানি দূষণমুক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখন বিশ্বের যে কোনো স্থানে বসে জমজমের পানি নিয়ে পরীক্ষা চালানো সহজ। তবে এই পানি রপ্তানিযোগ্য এবং বিক্রয়যোগ্য নয় বলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে সংগ্রহ করতে হবে, নইলে বিভ্রান্তি হতে পারে। একবার ইংল্যান্ডের দোকানে দোকানে বিক্রয়ের জন্য রাখা জমজমের পানি নিয়ে বি.বি.সি পরীক্ষা করে বলেছিল দূষণের মাত্রা বেশি।
সেই পানি জমজমের পানি ছিল না। জমজম একি আল্লাহ-প্রদত্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। এই কূপ নিয়ে যে অলৌক্কিত্ব আছে, তা হচ্ছে এর আবিষ্কারের মধ্যে। মাটির অনেক নিচে হাজার হাজার বছর পড়ে থাকা কুয়া সেদিন এক তৃষ্ণার্ত শিশুর ক্রন্দন আর তার মায়ের আকুতি শুনে হঠাৎ নিজেকে যেভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেটাই হচ্ছে জমজমের অলৌকিকত্ব ।
লেখক : সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট