প্রথম পাতা

শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ কর্ণফুলী মাল্টিপারপাসের বিরুদ্ধে

স্টাফ রিপোর্টার

২৭ অক্টোবর ২০২১, বুধবার, ৯:১৯ অপরাহ্ন

কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা ও গার্মেন্টেস কর্মীদের টার্গেট করে এসব টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা। এসব টাকায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন নিজের নামে রাজধানীতে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফ্ল্যাট, জমি, গার্মেন্টস ও ট্যুর ট্রাভেলসসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।  জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হাজার। প্রতিষ্ঠানটিতে লেনদেন হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকারও বেশি। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার জসীম উদ্দিন প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ  থেকে ওই টাকা নিয়েছে। এ চক্রের ১০ জনকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করলেও চক্রের হোতা জসিমকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- শাকিল আহম্মেদ, চাঁন মিয়া, একে আজাদ, রেজাউল, তাজুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন খাঁন, আব্দুস ছাত্তার, মাসুম বিল্লাহ, টিটু মিয়া ও আতিকুর রহমান। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র?্যাব’র মিডিয়া সেন্টারে  এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি  মো. মোজাম্মেল হক জানান, কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যানের অন্যতম সহযোগী ও প্রকল্প পরিচালক মো. শাকিল আহমেদসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সমিতির সভাপতি জসিমসহ সমিতির কার্যকরী কমিটির অন্য সদস্যদের পাওয়া যায়নি। জসিম উদ্দিন ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে অর্থ ট্রান্সফার করে অর্থপাচার করেছেন। নামে-বেনামে কিনেছেন প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ গড়ে তুলেছেন ৮টি প্রতিষ্ঠান।
মূল অভিযুক্ত জসিম নিজেই সমিতির সভাপতি, সহ-সভাপতি তার শ্বশুর মোতালেব সরকার, সাধারণ সম্পাদক তার প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তার, কোষাধ্যক্ষ তার শ্যালিকা শাহেলা নাজনীন, যুগ্ম সম্পাদক নিকট আত্মীয় লাভলী আক্তার। একরকম পারিবারিক একটি সমিতি। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধনপ্রাপ্ত। সরকারি হিসাবে প্রতিষ্ঠানটিতে ৫১৮ জন গ্রাহক উল্লেখ করা হলেও গ্রাহকদের অভিযোগ মতে ও র‌্যাব’র তদন্তে উঠে এসেছে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার গ্রাহক শত কোটির বেশি টাকা লেনদেন করেছে প্রতিষ্ঠানটিতে।
প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য অনুযায়ী, কেউ যদি একটি ডিপিএস মাসে এক হাজার টাকা করে বছরে ১২ হাজার টাকা জমা দেয়, তবে ৫ বছরে তার ৬০ হাজার টাকা জমা হবে। মেয়াদ শেষে তাকে ৯০ হাজার টাকা দেয়া হবে। আর টার্গেট সংগ্রহকারী ব্যক্তি প্রথম এক বছরে প্রতিমাসে ২০০ টাকা এবং পরবর্তী ৪ বছর প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে লভ্যাংশ পাবেন। আবার কোম্পানির কোনো সদস্য যদি নতুন কোনো সদস্যকে এক হাজার টাকার এফডিআর করাতে পারেন তাহলে টার্গেট সংগ্রহকারীকে মাসে এক হাজার টাকা এবং এফডিআর করা সদস্যকে মাসে দুই হাজার টাকা দেয়ার প্রলোভন দিত কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস। প্রকৃতপক্ষে এটা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না।
৫ বছরে ৫০ শতাংশ লভ্যাংশের ফাঁদ: গ্রেপ্তার শাকিল আহম্মেদ ও চাঁন মিয়া ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্পসময়ে অধিক মুনাফা দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে আগ্রহী করতেন। এভাবে প্রলুব্ধ হয়ে গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষেরা বিনিয়োগ করতেন। প্রতি সদস্য মাসিক ১০০ থেকে এক হাজার টাকা করে কথিত ডিপিএস জমা করতেন। তাদের ৩ বছরে ৩০ শতাংশ এবং ৫ বছরে ৫০ শতাশং মুনাফার প্রলোভন দেওয়া হতো। কিন্তু ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের নিয়মিত লভ্যাংশ দেওয়া হতো না। ডিপিএস’র মেয়াদ পূর্ণ হলেও পাওনা টাকা পরিশোধ করা হতো না। ভুক্তভোগীরা লাভের টাকা চাইতে গেলে হুমকি-ধমকি দেওয়া হতো। নারী গ্রাহকদের প্রতি অশালীন মন্তব্য, পুরুষ সদস্যদের টর্চার শেলে নিয়ে মারধর করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযান পরিচালনাকালে শাকিলের অফিসের টর্চার শেল থেকে মারধর করার সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে।
ধূর্ত জসিম সবসময়েই ছিলেন আড়ালে: মূল অভিযুক্ত পলাতক জসিম উদ্দিন মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা। ২০০৩ সালে তিনি অল্পসময়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬ সালে সমবায় অধিদপ্তর থেকে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস নিবন্ধন পায়, ২০১৩ সালে সমিতিটি পুনঃনিবন্ধন পায়। র‌্যাব কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, সমবায় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ সালে তাদের মোট গ্রাহক সংখ্যা ৫১৮ জন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে ২০-২৫ হাজার গ্রাহক সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। জসিম কোম্পানিতে নতুন নতুন সদস্য আনয়নের লক্ষ্যে পুরাতন সদস্যদের চাপ দিতেন।
গ্রাহকের টাকায় জসিম গড়েছেন ৮ প্রতিষ্ঠান: কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ছাড়াও জসিম নিজের নামে- বেনামে আরও ৭টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। জসিম মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কর্ণফুলী রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, জসিম ইন্টান্যাশনাল ওভারসিস লিমিটেড, জসিম স্টুডেন্ট কনসাল্টেন্সি ফার্ম, জসিম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, জসিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, জসিম নিট কম্পোজিট লিমিটেড। এসব কোম্পানির নামে লেনদেন ও টাকা স্থানান্তর করলেও কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস ছাড়া বাকি ৭ কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
জসিমসহ তার পারিবারের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তার সম্পর্কে মোজাম্মেল হক বলেন, র‌্যাব’র তথ্য মতে জসিম দেশেই আছে। তাকেসহ পারিবারিক চক্রটির সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
ভুক্তভোগী তরিকুল ইসলাম রুবেল জানান, আমার স্ত্রী গার্মেন্টে চাকরি করতো। ২০১৯ সালে তার পাশের এক অপারেটর আমার স্ত্রীকে বলে- তুমি যদি এখানে (কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি.) টাকা রাখো তাহলে প্রতিমাসে লাখে আঠারোশ’ টাকা পাবে। পরে আমার স্ত্রী এখানে দেড় লাখ টাকা রাখে। তাকে আবারও বলা হয়, তুমি তো ডিপিএস করো আরও লাভ পাবে। আমার স্ত্রী তাদের কথামতো দু’টি ডিপিএস করে। একটি ২৫শ’ ও অপরটি ১২শ’ টাকার। এসব টাকার লভ্যাংশ প্রতিমাসে দেয়ার কথা থাকলেও প্রথম দুই-তিন মাস দিয়েছিল। কিন্তু, পরে আর টাকা  দেয়া হয়নি। মূল টাকা ফেরত চাইলেও তারা সেটা  দেয়নি, উল্টো ঘুরাতে থাকে। এভাবে দীর্ঘদিন তাদের অফিস  ঘোরাঘুরি করছি। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪ টুআইসি জয়িতাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status