মত-মতান্তর

মালিয়া, আম্বানী, আদানি ও কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি

ড. মাহফুজ পারভেজ

২৬ অক্টোবর ২০২১, মঙ্গলবার, ১:২৪ অপরাহ্ন

বিজয় মালিয়া, মুকেশ আম্বানী, গৌতম আদানি

বিশ্বায়নের ফলে কর্পোরেট সংস্কৃতির এখন রমরমা। অর্থনীতির সিংহভাগই তাদের দখলে। পুঁজি, বিনিযোগ, কর্মসংস্থান, শেয়ার বাজার তথা যাবতীয় আর্থিক কার্যকলাপের নেতৃত্বে আসীন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার চর্চায়ও কর্পোরেটগুলো পিছিয়ে নেই।

এমতাবস্থায় কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সামাজিক দায়বদ্ধতা নামক বিষয়টি সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। কারণ, বিশ্ববাসী জানে, যে কর্পোরেট সংস্থাগুলো তাদের পণ্য তৈরি করতে, পরিবেশ দূষণ করে, প্রাকৃতিক সংস্থান ব্যবহার করে নিজেদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বাড়ায়। আর তাই তাদের কলকারখানা গুলোর দ্বারা সৃষ্ট দূষণ সমাজে বসবাসরত মানুষদের সহ্য করতে হয়। তদুপরি, সমাজ ও মানুষের কাছ থেকে মুনাফা হাসিল করে বলে তাদেরকে লভ্যাংশের একটি সামান্য অংশ কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি খাতে মানুষ ও সমাজের কল্যাণার্থে খরচ করতে হয়।

ফলে বিশ্বের দেশে দেশে কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি নিয়ে চর্চা হচ্ছে। পাশের দেশ ভারতে কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সামাজিক দায়বদ্ধতার আইন প্রথম এপ্রিল ১, ২০১৪ সালে প্রয়োগ করা হয়। সেখানে যে শীর্ষ ১০টি সংস্থা এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ও বিপুল টাকা প্রদান করে, সেগুলো হলো: ১. রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিস: ৭৬০.৬ মিলিয়ন, 2. ONGC: ৪৯৫.২ মিলিয়ন, ৩. INFOSYS: ২৩৯.৫ মিলিয়ন, ৪. TCS: ২১৯ মিলিয়ন, ৫. ITC: ২১৪.১ মিলিয়ন, ৬. MTPC: ২০৫.২ মিলিয়ন, ৭. MMDC: ১৮৮.৭ মিলিয়ন, ৮. টাটা স্টিল: ১৭১.৫ মিলিয়ন, ৯. অয়েল ইন্ডিয়া: ১৩৩.৩ মিলিয়ন, ১০. WIPRO: ১৩২.৭ মিলিয়ন।

পরিসংখ্যান থেকে এটি স্পষ্ট যে ভারতে কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। আর প্রধানত যেসব ক্ষেত্রে টাকা খরচ হয়েছে, তা হলো: স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা: ৩১১৭ কোটি টাকা, শিক্ষা: ৩০৭৩ কোটি টাকা, গ্রামীণ উন্নয়ন: ১০৫১ কোটি টাকা, পরিবেশ: ৯২৩ কোটি টাকা, স্বচ্ছ ভারত তহবিল: ৩৫৫ কোটি টাকা। জরিপের তথ্যানুসারে ৯৯% ভারতীয় কোম্পানি কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির নিয়ম অনুসরণ করছে। তথাপি সেখানে রয়েছে বিরাট রকমের ফাঁকিবাজি।

বিশ্বায়ন ও কর্পোরেটের বিকাশ হওয়ার আগেও বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি মানুষ ও সমাজের হিতকর কাজে অংশ নিয়েছে। কারণ, ব্যবসা শুধু একচেটিয়া মুনাফা অর্জন নয়, সে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নানা পর্যায়ের মানুষ ও সমাজের কল্যাণ করাও বটে। ফলে আমেরিকায় ফোর্ড, রকফেলার ফাউন্ডেশন বৃত্তি দিয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণায় অকাতরে সাহায্য করেছে। ভারতে টাটা, বিড়ালা প্রভৃতি কোম্পানি ক্যান্সার হাসপাতাল, প্ল্যানেটোরিয়াম, জাদুঘর, সংগ্রহশালা গড়েছে। পাকিস্তান আমলেও আদমজি, ইস্পাহানি প্রমুখ স্কুল, কলেজ সহ নানাবিধ দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়েছে।

বিশ্বায়নের মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কর্পোরেটগুলো অনেক সুবিধাজনক ও লাভজনক অবস্থানে থাকলেও তারা সর্বাবস্থায় তাদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি পালন করে না। অধিকাংশ কর্পোরেট কোম্পানি কর্পোরেট ভিত্তিক নৈর্ব্যক্তিক আইন অনুসরণ করলেও অনেকেই ছদ্মবেশে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক স্বার্থে ব্যবসাকে পরিচালনা করে। প্রায়-সকলে জাতীয় পুঁজিকে পুষ্ট করলেও কোনও কোনও প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ বিদেশে সম্পদ পাচার করে। সুইস ব্যাংকে, কানাডায়, মালয়েশিয়ায় সেসব সম্পদ পুঞ্জিভূত করে দেশ ও জনগণকে বঞ্চিত করার শোষক মনোবৃত্তি রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের কর্পোরেট অসততার নামান্তর।

এমন বহু অসৎ ব্যবসায়ীর অন্যতম একজন ভারতের ফেরারি ও খেলাপি শিল্পপতি বিজয় মালিয়া। ভারতের বিপুল সম্পদ নিয়ে পলাতক শিল্পপতি বিজয় মালিয়াকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে বৃটেনের একটি আদালত। মালিয়ার বিরুদ্ধে দেউলিয়া অর্ডার ঘোষণা করার ফলে কিংফিশার এয়ারলাইন্সের মালিকের বিশ্বজুড়ে যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার পেয়ে গেল স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। মালিয়ার বিপুল ঋণের বোঝা মেটাতে একাধিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে এবার।

এদিকে বৃটিশ উচ্চ আদালতের চ্যান্সেরি ডিভিশনের মুখ্য দেউলিয়া ও কোম্পানি এজলাসের বিচারক মাইকেল ব্রিগস ভার্চুয়াল শুনানিতে বিজয় মালিয়াকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন। ভারতীয় ব্যাংকগুলোর তরফে আইন সংস্থা টিএলটি এলএলপি এবং আইনজীবী মার্সিয়া শেকের্ডমেইন আদালতে আবেদন করেন মালিয়াকে দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য।

৬৫ বছর বয়সী শিল্পপতি ব্রিটেনে জামিনে রয়েছেন। ব্রিটিশ আদালতে তার ভারতে প্রত্যর্পণ মামলা এখনও বিচারাধীন। শুনানিতে মালিয়ার আইনজীবী দেউলিয়া ঘোষণা নির্দেশ স্থগিত রাখার আবেদন করেন। কিন্তু সেই আবেদন ধোপে টেকেনি।

দেউলিয়া মামলায় এসবিআইয়ের নেতৃত্বে ১৩টি ভারতীয় ব্যাংকের কনসোর্টিয়াম মামলা করে। ব্যাংক অফ বরোদা, করপোরেশন ব্যাংক, ফেডারাল ব্যাংক, আইডিবিআই ব্যাংক, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাংক, জম্মু-কাশ্মীর ব্যাংক, পাঞ্জাব-সিন্ধ ব্যাংক, পিএনবি, স্টেট ব্যাংক অফ মাইসোর, ইউকো ব্যাংক, ইউবিআইয়ের মতো ব্যাংকগুলি থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করেননি মালিয়া।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনও ব্যক্তি বা কোম্পানির পক্ষে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অকাতরে লুণ্ঠন করা সম্ভব হয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার অসৎ কোম্পানিগুলো স্ব স্ব দেশের সরকারের কর্তাব্যক্তিদের হাত করেই হাতিয়ে নিতে পারে অগাধ সম্পদ। এক্ষেত্রে তারা কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি প্রতি মোটেও ভ্রূক্ষেপ করে না।

ভারতে চলমান কৃষক আন্দোলনে এমন আরও অনেক কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, যারা সেখানকার সরকারের ঘনিষ্টতায় স্বল্প সময়ে বিপুল সম্পদ কব্জা করেছে। এদের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত হলো ‘আম্বানী’ এবং ‘আদানি’ গ্রুপ। বিশেষজ্ঞরা এই দুই বণিক গোষ্ঠীর অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তারের বিষয়টিকে ‘বিশ্বের ধনতন্ত্রের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই মুহূর্তে ভারতীয়দের কথাবার্তায় বার বার ঢুকে পড়েছে এই দু’টি নাম। এর কারণ বর্তমান সরকারের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠতা। তাদের এই ‘অনন্যতা’-র বিষয়টি বিতর্কের অবতারণা করেছে।

কোনও সন্দেহ নেই যে, অম্বানী এবং আদানী, এরা উভয়েই বাণিজ্য-দক্ষ। কিন্তু তেমন দক্ষতা তো অন্য অনেক গোষ্ঠীরই রয়েছে। তবে কোথায় এই দুই গোষ্ঠী আলাদা? যে জায়গায়গাটিতে এরা অন্যদের চাইতে পৃথক, সেটি হল দেশের অর্থনীতির উপর প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য এদের উদগ্র বাসনা। যে বাসনা, বা বলা ভালো ‘ক্ষুধা’কে ক্রমাগত ইন্ধন দিয়ে চলেছে এদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট সরকারি অবস্থান এবং তাকে ঘিরে বহমান বিভিন্ন বিতর্ক। আম্বানী গোষ্ঠী পেট্রো কেমিক্যালসের জগতে তাদের আধিপত্য চায়, সেই সঙ্গে চায় পেট্রোলিয়ায়ম, টেলিকম, অনলাইন মঞ্চসমূহ, সুবিন্যস্ত খুচরো ব্যবসা, এমনকি, বিনোদন জগতের উপরেও ছড়ি ঘোরাতে।

আর অতি দ্রুত গতিতে উঠে আসা আদানি গোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরেই ভারতের কয়লা রফতানিকারক হিসেবে শীর্ষস্থানে রয়েছে। তারা সৌরশক্তি-সহ দেশের অন্যান্য শক্তি উৎপাদনক্ষেত্রে সব থেকে বড় বেসরকারি উদ্যোগ। সেই সঙ্গে তারা দেশের প্রবেশদ্বারগুলো, অর্থাৎ বৃহৎ বন্দর ও বিমানবন্দরগুলোরও মালিক।

লক্ষণীয়, এই দুই গোষ্ঠী কিন্তু পরস্পরের জমিতে পা বাড়ায় না। কিন্তু ‘গ্রিন এনার্জি’ বা প্রাকৃতিক উপাদান থেকে আহৃত শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে দু’পক্ষেরই প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা হয়তো সঙ্ঘাতেরর পথে যেতে পারে। উভয়েরই সরকার-ঘনিষ্ঠতার কাহিনি সর্বজনবিদিত। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে একাধিক প্রতিযোগী ছিটকে গিয়েছে।

ভারতের মতো পরিস্থিতি অন্যান্য দেশেও দেখা গিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার চেবোল (ব্যক্তি বা পরিবার কেন্দ্রিক শিল্পপতি গোষ্ঠী) বা জাপানের পরিবার-নিয়ন্ত্রিত জাইবাৎসু (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠান-নির্ধারিত কেইরেৎসু ব্যবস্থা এসে জাইবাৎসু প্রথাকে সরিয়ে দেয়) প্রথার সঙ্গে আম্বানী ও আদানিদের তুলনা করা চলে। তবে, জাইবাৎসু/কেইরেৎসু প্রথা দু’টি মাত্র পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। অন্তত পক্ষে আধ ডজন জাইবাৎসু/কেইরেৎসুকে একই সময়ে প্রাধান্যে থাকতে দেখা গিয়েছে। সেই সব দেশের শিল্পপুঁজিতে এই গোষ্ঠীগুলির অংশীদারিত্ব, তাদের স্থাবর সম্পত্তি প্রভৃতি এই ভারতীয় গোষ্ঠী দু’টির তুলনায় অনেক বেশি ছিল। তুলনায় তাদের ব্যবসার বিস্তৃতিও ছিল অনেক বেশি। আর রাজনৈতিক যোগাযোগের দিক থেকে দেখতে গেলে জাপানি ও কোরিয়ান গোষ্ঠীগুলো তাদের দেশের রাজনীতিবিদ এবং সরকারের সঙ্গে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। কোরিয়ার চেবোলরা ছিল সরকার দ্বারা পৃষ্ঠপোষিত জাতীয় উদ্যোগের মুখপাত্র। আবার চেবোল ও কেইরেৎসুরা রাজনৈতিক দলগুলোর পিছনে গুরুত্বপূর্ণ অর্থসরবরাহকারীর ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছিল।

ভারতে এমন উদাহরণ ছিল টাটা। কিন্তু টাটা গোষ্ঠীর কর্তৃত্বপূর্ণ জায়গা দখল করেছে আম্বানী-আদানিরা। তবে টাটা কখনওই আম্বানী বা আদানিদের মতো ‘ক্রাউডিং আউট’ (সেই অবস্থা, যখন বাজার অর্থনীতির কোনও একটি ক্ষেত্রে সরকারের অতিরিক্ত মাত্রায় জড়িত থাকার ফলে অন্য ক্ষেত্রগুলোও প্রভাবিত হতে থাকে। বিশেষত চাহিদা ও যোগানের উপরে তার প্রভাব গিয়ে পড়ে) প্রাধান্য বিস্তারে অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতার খেলায় লিপ্ত হতে চায়নি।

প্রশ্ন হলো, বিশ্বের দেশে দেশে, বিশেষত ভঙ্গুর গণতন্ত্রের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কর্পোরেট ব্যবসার ঘনীভূত আধিপত্য কি আদৌ কমবে কোনও দিন? স্বচ্ছ বাণিজ্য পরিকাঠামোয় সবকিছু আইনানুগভাবে পরিচালিত হয়ে কর্পোরেটের আর্থিক একচেটিয়াত্ব ও রাজনৈতিক প্রভুত্ব নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? এবং কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সামাজিক দায়বদ্ধতা নামক বিষয়টি যথাযথভাবে মানতে তাদেরকে বাধ্য করা সম্ভব হবে?
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status