প্রথম পাতা

পীরগঞ্জে হামলা

উস্কানিমূলক পোস্ট দেয় সৈকত মণ্ডল

স্টাফ রিপোর্টার

২৪ অক্টোবর ২০২১, রবিবার, ৯:৪০ অপরাহ্ন

রংপুরের পীরগঞ্জের বড় করিমপুরের জেলে পল্লীতে সাম্প্রদায়িক হামলার রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছে র‌্যাব। একই সঙ্গে হামলার মূলহোতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার নাম সৈকত মণ্ডল (২৪)। সে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার নেতৃত্বেই হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করছে র‌্যাব। ফেসবুক ফলোয়ার বাড়ানো ও নিজের ইমেজকে প্রতিষ্ঠিত করতে হামলার পরিকল্পনা করে সৈকত। এজন্য সে ফেসবুকে উস্কানিমূলক মন্তব্য ও মিথ্যা পোস্টের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে। ঘটনার দিন ঘটনাস্থলের পাশের একটি মসজিদ থেকে মাইকিং করে উত্তেজনা ছড়িয়ে স্থানীয় লোকজনকে জড়ো করে রবিউল ইসলাম (৩৬)। সবাই একত্রিত হওয়ার পরপরই হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রবিউল ইসলামকেও গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। র‍্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-১৩ এর একটি আভিযানিক দল শুক্রবার রাতে টঙ্গী এলাকা থেকে সৈকত মণ্ডল ও রবিউল ইসলামকে (৩৬) গ্রেপ্তার করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পীরগঞ্জে ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব’র মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান- র‌্যাব’র গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব সৈকতের বাড়ি পীরগঞ্জে ও বাবা রাশেদুল হকের পরিচয় দিলেও তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য দেয়নি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। সে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। রংপুরের কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দর্শন বিভাগের কমিটির সহ-সভাপতি পদে ছিল। পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ার ঘটনার একদিন পর তাকে ছাত্রলীগের কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। রংপুরের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীসূত্রে চার বছর আগে ২০১৭ সালের ৮ মে দর্শন বিভাগের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে ছিল সৈকত মণ্ডল। সমপ্রতি তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কার্যকলাপের অভিযোগ পাওয়ার পর দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। আর গ্রেপ্তার রবিউলের বাড়িও পীরগঞ্জে। বাবার নাম মো. মোসলেম উদ্দীন।
গত ১৭ই অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্টকে কেন্দ্র করে রংপুরে পীরগঞ্জের বড় করিমপুর গ্রামে দুর্বত্তরা সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই ঘটনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের অভিযোগ এনে রংপুরে পীরগঞ্জ থানায় তিনটি মামলা দায়ের হয়। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে র‍্যাব-১৩ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসে। গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্যে হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া ও ঘটনা সংঘটিত করার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানা যায়। তারপর থেকে র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে মূলহোতা সৈকত ও রবিউলকে গ্রেপ্তার করে।
সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়, পীরগঞ্জের বড়করিমপুরে পরিতোষ সরকার ও উজ্জ্বল নামের দুই তরুণের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক ছিল। এর জের ধরে পরিতোষের ধর্ম নিয়ে উজ্জ্বল কটূক্তি করে। পরে পরিতোষ ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে উজ্জ্বলের ধর্ম নিয়ে পাল্টা মন্তব্য করে। পরিতোষের ওই মন্তব্য ফেসবুকে পোস্ট করে উজ্জ্বল। এ ঘটনায় পুলিশ তারা দু’জনকে গ্রেপ্তার করে। ওই পোস্ট সৈকত আবার তাঁর নিজের ফেসবুক পেজে ছড়ায়। একইভাবে কুমিল্লার ঘটনার পর থেকেই সৈকত নানা উস্কানিমূলক পোস্ট দিচ্ছিলো। পরিতোষ ও উজ্জ্বলের দ্বন্দ্বের ঘটনাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছিল সৈকত।
র‌্যাব জানায়, ‘এ মুহূর্তে গ্রাম পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদ, হিন্দুদের আক্রমণে এক মুসলিমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে’ মর্মে উস্কানিমূলক পোস্ট দেয় সৈকত। সেই পোস্টের সূত্র ধরে ঘটনাস্থলের ঠিক কাছাকাছি একটি মসজিদ থেকে মাইকিং করে রবিউল ইসলাম। তৌহিদী জনতাসহ ধর্মপ্রাণ মানুষকে প্রতিরোধের ডাক দেয়। পরে নিজে একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে হামলায় অংশ নেয় সৈকত। র‌্যাব জানায়, সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্ট করতে একটি ‘দুর্বল সময়ের’ জন্য অপেক্ষায় ছিল সৈকত। পরিতোষের বার্তাকে কেন্দ্র করে সৈকত উস্কানি ছড়ানোর পাশাপাশি নেতৃত্ব দিয়ে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সৈকতের পেছনে আর কেউ জড়িত কিনা, তার রাজনৈতিক কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে র‌্যাব সুনির্দিষ্ট তথ্য দেয়নি। তবে সংস্থাটি জানায় সৈকতের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। সে গ্রেপ্তার রবিউলকে মাইকিং করে লোকজন জড়ো করতে নির্দেশনা দিয়েছিল বলে জানায়। ঘটনার পরপর সে আত্মগোপনে চলে যায়।
গ্রেপ্তার রবিউল রংপুরের পীরগঞ্জের হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অন্যতম উস্কানিদাতা। সে স্থানীয় একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন। হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার আগে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মাইকিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন উস্কানিমূলক ও মিথ্যাচার করে গ্রামবাসীকে উত্তেজিত করে তোলে ও হামলায় অংশগ্রহণের জন্য জড়ো হতে বলে। সে মাইকিংয়ের দায়িত্ব তার আস্থাভাজনকে দিয়ে নিজে সশরীরে অংশগ্রহণ ও নির্দেশনা দেয়। সে জানায়- গ্রেপ্তার সৈকতের নির্দেশনায় ও প্ররোচনায় সে মাইকিং করাসহ হামলায় অংশগ্রহণ করে। ঘটনার পর সেও আত্মগোপনে চলে যায়। র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অরাজকতা সৃষ্টি এবং সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্টের লক্ষ্যে হামলা-অগ্নিসংযোগসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার ও মাইকিং করে হামলাকারীদের জড়ো করে বলে জানায়। ঠিক কি উদ্দেশ্যে উস্কানিমূলক পোস্ট দিয়েছিল সৈকত? জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, সৈকতের ফেসবুক পেজে তিন হাজারের মতো ফলোয়ার রয়েছে। এই ইস্যুকে কাজে লাগিয়েছে সে ফলোয়ার বাড়াতে চেয়েছিল। পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত ইমেজ বাড়বে বলেও মনে করেছিল।
সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়, সামপ্রতিক সময়ে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্টের চেষ্টায় কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ফেনী, রংপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতা লক্ষ করা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উস্কানিমূলক, বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টাও করছে চক্রান্তকারীরা। এ সংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব’র গোয়েন্দা শাখা ও বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন এখন পর্যন্ত ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status