মত-মতান্তর

শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিয়ে নয়, আদর দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করাই উত্তম

২১ অক্টোবর ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১২:৪৫ অপরাহ্ন

কোন দেশেই শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার আইনগত অধিকার নেই শিক্ষকের। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ২০১১ সালে। ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১১ শিরোনামে জারিকৃত সেই আদেশের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- শারীরিক শাস্তি বলতে বুঝাবে যে কোন ধরনের দৈহিক আঘাত করা। যেমন: শিক্ষার্থীকে হাত-পা বা কোন কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, চক বা ডাস্টার জাতীয় বস্তু ছুঁড়ে মারা, আছাড় দেয়া ও চিমটি কাটা, কামর দেয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেয়া, হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে পেন্সিল চাপা দিয়ে মোচড় দেয়া, ঘাড় ধাক্কা দেয়া, কান টানা বা ওঠা-বসা করানো, চেয়ার টেবিল বা কোনকিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করে রাখা, রোদে দাঁড় করিয়ে বা শুইয়ে রাখা, কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে এমন কোন কাজ করানো। আর মানসিক শাস্তি বলতে বুঝাবে- শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে এমন কোন মন্তব্য করা যেমন: মা-বাবা, বংশ পরিচয়, গোত্র বর্ণ ও ধর্ম সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করা, অশোভন অঙ্গভঙ্গি করা যা শিক্ষার্থীদের মনে বিরোপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।’

শাস্তিযোগ্য এই রাষ্ট্রীয় আইন/নীতিমালা মেনেই করা উচিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতা। কোন ধর্মেও অনুমোদন দেয় না শিক্ষার্থীদের শাস্তি প্রদান। তথাপি কেউ যদি শিক্ষার্থীকে ভালবাসার অধিকার দেখিয়ে শাসনের নামে নির্যাতন করতে চান তো তাকে অবশ্যই অর্জন করতে হবে তেমন শ্রদ্ধা এবং নিশ্চিত থাকতে হবে যে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মাথা পেতে নিবে সেই শাসন বা নির্যাতন এবং কখনো করবে না এর প্রতিবাদ।

উল্লিখিত নীতিমালা পড়ে কোন কোন শিক্ষক মন্তব্য করছেন যে, এ আইন মানতে গেলে কঠিন হয়ে পড়বে দুষ্টু শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ এবং অমনোযোগীদের পাঠদান। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, শাসন না থাকলে নিয়ন্ত্রণ থাকবে কী ভাবে? শাস্তি ব্যতীত শাসন করার উপায় কী? তারা মনে করেন, বিভিন্ন রকম জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে হাজার কথা বলে ও কৌশল করে আত্মনিয়ন্ত্রণ শিখানো/করানোর চেয়ে শত সহজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে বাধ্য করা! তারা বুঝতে চাচ্ছেন না যে, শাসন মানেই শাস্তি প্রদান নয়। শাসন মানে প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রণ। আধুনিক শিক্ষা মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রচন্ড অভাব থেকেই উৎপত্তি তাদের এ ধরনের প্রশ্ন ও মনোভাব। তাই তারা মনে করেন শাস্তি প্রদানই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। তারা এটিও মনে করেন যে, শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব পাওয়া মানেই শাস্তি প্রদানের অধিকার পাওয়া। এই ভ্রান্ত ধারনার কারণেই শিক্ষার্থীদের উপর নেমে আসে অধিকাংশ অমানবিক ও নিষ্ঠুর নির্যাতন। যার মাত্র দু’চারটি ব্যতীত প্রায় সবই থেকে যায় আমাদের জানার/ দেখার বাইরে। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে এমন শিক্ষক/ শিক্ষিকা/ প্রশিক্ষক/ হুজুরের সংখ্যা অনেক বেশি। কেননা, আমরা শিশু মনোবিজ্ঞান ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের উপর উচ্চতর ডিগ্রি না নিয়েই প্রায় সকল স্তরে শিক্ষক হতে পারি এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতা করতে পারি। আমি নিজেও তেমন একজন। অথচ উন্নত বিশ্বে তা মোটেও সম্ভব নয়। আমাদের এই দুর্বলতা স্বীকার করার মানসিকতাও নেই অনেকেরই।

মনে রাখতে হবে, বর্তমান শিক্ষার্থীরা আগের মত নয়। এখন তারা অনেক তথ্য সমৃদ্ধ, আবেগপ্রবণ, অধিকার সচেতন ও আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বময় বিস্তৃত তাদের দৃষ্টি। অভিভাবকগণও সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে অনেক আগ্রহী এবং আধুনিক আগের তুলনায়। অনেক বদলে গেছে তাদের পারিবারিক আচার-আচরণ। তারা এখন অনেক বেশি প্রশ্রয় দেয় ছেলেমেয়েদের। এমনও অভিভাবক আছেন যিনি নিজেই অবাধ্য ছিলেন মা-বাবা ও শিক্ষকের। আগের পন্ডিত বা শিক্ষকদের তুলনায় অনেক পাল্টেছে বর্তমান স্যার-ম্যাডামদের সাজপোশাক, চালচলন, আচার-আচরণ ও জীবনযাপন। পাল্টেছে চুলের ছাঁট, নখের কাট ও পোশাকের ধরণ। আগের দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতো না সবাই। হাতেগোনা যারা ভর্তি হতো তারাও টিকে থাকতো না লেখাপড়ায়। শিক্ষকদের মার খেয়ে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ না করলেও অধিকাংশরাই নিরব প্রতিবাদ করে, নিজেকে অযোগ্য মনে করে, পালিয়ে যেত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। তাদের আর কোনদিন ফিরে আসা হতো না শিক্ষায়! চিহ্নিত হতোনা মেধার ক্ষেত্র। লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত থেকে যেতো বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে। যারা টিকে থাকতো তারা জন্মগতভাবে অত্যন্ত মেধাবী ও ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে নম্র-ভদ্র এবং শিক্ষা লাভে বদ্ধপরিকর হাতেগোনা কয়েকজন। তখনকার প্রায় শতভাগ অভিভাবক ও শিক্ষক মনে করতেন যে, কঠিন শাস্তি দিয়েই শিক্ষা দিতে হয়। অভিভাবক শিক্ষককে বলেই দিতেন তার সন্তানকে বকাবকি ও মারধর করে মানুষ করার জন্য। তখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের সংখ্যাই ছিল কম। সেভাবে ভাবলে আর চলবে না এখন। পাল্টাতে হবে নিয়ন্ত্রণ কৌশল। শক্তি খাটিয়ে নয়, বুদ্ধি খাটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বর্তমান ছেলেমেয়েদের। শতভাগে উন্নীত করতে হবে শিক্ষার হার। সবাইকেই ধরে রাখতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। করে তুলতে হবে যুগের উপযোগী কর্মক্ষম নাগরিক। সেই অসাধ্য সাধন করার মতো হতে হবে শিক্ষকদের।

আমাদের দেশে প্রচলিত প্রশ্নোত্তর পদ্ধতির পরীক্ষায় এ+ গ্রেড এবং কর্ম জীবনে অধিক আর্থিক সুবিধা হাত করা মানেই যে এ+ মানুষ হওয়া নয়; তা আমরা অনেকেই বুঝিনা, বুঝতে চাইনা বলেই নিষ্ঠুরভাবে চালাই ‘মানব সন্তান’দের পিটিয়ে মানুষ করার প্রতিযোগিতা। ফলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানবিক গুণাবলি জাগ্রত করার পরিবর্তে আমরা প্রতিনিয়ত শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করে করে চিরতরে হটিয়ে দিই অনেকের ভিতরের অধিকাংশ জন্মগত মানবিক গুণাবলী। সাধিত হয় না তাদের আচরণের স্থায়ী অনুকূল পরিবর্তন। ফলে লেখাপড়া শিখেও তারা হয়ে উঠে আরো বেশি লোভি, নিষ্ঠুর ও আত্মকেন্দ্রিক। স্বপ্রনোদিত হয়ে এগিয়ে আসে না অপরের কল্যাণে। পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজে বৃদ্ধি পায় অনাচার এবং অস্থিতিশীলতা। বিশ্বের যেসকল দেশে শিক্ষার হার বেশি ও দুর্নীতির মাত্রা কম সেসকল দেশে শিক্ষার্থী নির্যাতন নেই বললেই চলে।

শাস্তি দেওয়া যত সহজ শিক্ষা দেওয়া তত সহজ নয়! শাস্তি দেওয়ার জন্য তেমন সময়, শ্রম, মেধা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সঠিক শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনীয় পরিচর্যার জন্য অনেক সময়, শ্রম, মেধা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োগ করতে হয়। যিনি শিক্ষার্থীদের শাস্তি না দিয়ে সঠিক শিক্ষা প্রদানে তথা আচরণের অনুকূল স্থায়ী পরিবর্তন সাধনে সক্ষম তিনি অবশ্যই উত্তম শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে নয়; বরং অনুকরণীয় অনুসরণীয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব দিয়ে, সত্যিকারের আদর দিয়ে, উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে, বিবেক জাগ্রত করে, মানব ও দেশ প্রেমে উদ্ভূদ্ধ করে, বাস্তবতাপূর্ণ উচ্চাশা দিয়ে, সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে দিয়ে, আর সবার মত সেও পারে এমন সৎসাহস দিয়ে, ভয়ভীতি হীন আনন্দঘন পরিবেশ দিয়েই সুনিশ্চিত করা যায় মেধানুযায়ী সুশিক্ষা। যার জন্য আমূল অনুকুল পরিবর্তন আনতে হবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়। সর্বোচ্চ বেতন-ভাতা দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে সর্বোচ্চ মেধাবী, প্রশিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক।


মো. রহমত উল্লাহ্
অধ্যক্ষ -কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status