মত-মতান্তর

দেশে দেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয় কেন?

ড. মাহফুজ পারভেজ

২০ অক্টোবর ২০২১, বুধবার, ১:২৭ অপরাহ্ন

পৃথিবীর নানা প্রান্তে, বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘুরা আক্রমণের শিকার হয়। উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে প্রায়-সকল দেশেই এমন চিত্র দেখা যায়। বিশ্বের দেশে দেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয় কেন, তা সমাজবিজ্ঞানীদের সামনে এক জটিল প্রশ্ন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে ইহুদি সংখ্যালঘুরা। ইউরোপ-আমেরিকায় একটি দীর্ঘ সময়কাল বর্ণবাদী হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে কালো মানুষেরা। স্বাভাবিক ও সংঘাত, উভয় পরিস্থিতিতেই প্রথম ও প্রধান আক্রমণের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয় সংখ্যালঘুরা।

মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে কুর্দি, ইয়াজিদি জনগোষ্ঠী। আফ্রিকায় হুতো এবং তুসসি জাতিসত্তা। ককেশাসে আজারি ও আর্মেনিয়ানরা। আফগানিস্তান, পাকিস্তানে শিয়া মুসলিমরা। শ্রীলঙ্কায় সিংহলিদের দ্বারা তামিলরা। ভারতে দলিত ও মুসলিম সম্প্রদায়। আসামে বাংলাভাষী মানুষ। বাংলাদেশে হিন্দুরা আর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমরা।

ধর্মের নামে, ভাষার নামে, জাতিগত পরিচয়ের নামে, অঞ্চলের নামে বিশ্বের সর্বত্র সংখ্যাগুরুর হাতে সংখ্যালঘুর নির্যাতন একটি সাধারণ ঘটনায় রূপ নিয়েছে। এমনকি, অতি-উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপ-আমেরিকায় থেমে থেমে চলছে জাতি-ধর্ম-ভাষাগত বৈরিতা। অভিবাসী মানুষেরা নির্বিচারে আক্রান্ত হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা।

এইসব অমানবিক আক্রমণের পেছনে কাজ করে বহুমাত্রিক কারণ, যার মধ্যে প্রধান হলো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুরভিসন্ধি। রাজনৈতিকভাবে অবনত ও অধীনস্থ রাখার জন্য সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় ক্ষুদ্র সংখ্যককে চাপে রাখতে বল প্রয়োগ করে। আনুগত্য হাসিলের জন্য বিশ্বের দেশে এমনটিই করা হয়।

আরেকটি প্রধান কারণ হলো অর্থনৈতিক। সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে টিকে থাকতে কঠোর পরিশ্রম এবং শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করে। ফলে তাদের আর্থিক উন্নতি হয় তুলনামূলক বেশি। চোখে পড়ার মতো আর্থিক সাফল্য তখন অনেককেই উত্তেজিত, লোভি ও আক্রমণাত্মক করে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে হিংসা, অবিশ্বাস আর সন্দেহ কখনও কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়কে মুখোমুখি দাঁড় করায়। যার ফায়দা নেয় দাঙ্গাবাজ পেশিশক্তি। উভয় সম্প্রদায়ের মাথামোটা বহু মানুষকে গুজব, আবেগ ও উস্কানির ফাঁদে ফেলে মতলববাজ গোষ্ঠী নানা স্বার্থ হাসিল করে।

দৃশ্যত কোনও আন্তর্জাতিক আইন, রাষ্ট্রীয় নীতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থাই জাতিগত, ভাষাগত, ধর্ম, বর্ণ ও অঞ্চলগত সংখ্যালঘুর নিপীড়ন ও নির্যাতনের কথা বলে না। বরং বৈশ্বিক ও জাতীয় পরিসরে সকল আইনই বিভিন্ন ধরণের সংখ্যালঘুর স্বার্থ, অধিকার ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয়। সংখ্যালঘু বিরোধী আইন করতে চাইলে সবাই সেটার নিন্দা জানায় ও বিরোধিতা করে। যেমন করা হচ্ছে, ভারতের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিজেপি সরকারের প্রস্তাবিত আইনকে।

তথাপি উগ্রপন্ধি ও স্বার্থান্বেষী মহলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের কারণে বিশ্বের দেশে দেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়। দাঙ্গা, হাঙ্গামা, উস্কানি, উত্তেজনায় সংখ্যালঘুদের ক্ষতি করার চেষ্টা চলে, যা বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সুশাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সভ্য সমাজ ও সুশীল মানুষ এইসব বর্বরতা মেনে নেয় না। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ায়।

ফলে সংখ্যালঘুর স্বার্থে, নিরাপত্তা ও শান্তির প্রয়োজনে সকলের অংশগ্রহণমূলক বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সুশাসনের ধারা অব্যাহত রাখা অপরিহার্য। সর্বস্তরের মানুষ, সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৃহত্তর কল্যাণে যেকোনও ধরণের উগ্রপন্থা ও চরম মনোভাবের কঠোরতর চর্চা সামাজিক, রাজনৈতিক স্তর থেকে সম্পূর্ণভাবে বর্জনীয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু উভয় সম্প্রদায়কেও উগ্রপন্ধি ও স্বার্থান্বেষী মহলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শাঠ্য-ষড়যন্ত্র, গুজব, উস্কানি, উত্তেজনার ফাঁদ এড়িয়ে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের পথে অটল থাকা জরুরি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status