অনলাইন

হর্ষবর্ধনঃ ভবঘুরে বাণভট্টের কাব্যে মেলা এক দানবীরের গাঁথা

রিফাত আহমেদ

২০ অক্টোবর ২০২১, বুধবার, ১:২১ অপরাহ্ন

কোনো এক জ্যৈষ্ঠ মাসে কৃষ্ণপক্ষের ১২তম দিনে রাজা প্রভাকরবর্ধন ও রাণী যশোমতী দেবীর কোল জুড়ে এলো এক বিশেষ শিশু, যার আগমন নতুন দিনের বার্তা দেয়। মহাআনন্দে আতুর ঘর থেকে ধাত্রী নন্দিনী ‘সুযাত্রা’ বের হয়ে মহারাজকে তার দ্বিতীয় ছেলে সন্তানের সুখবর পৌঁছে দিলো। উল্লাসে ফেটে পড়লো সমগ্র রাজ্য। যদিও এটি রাজার প্রথম সন্তান নয়, তবুও এই শিশুর মাঝে এমন কিছু ছিলো, যা শুধু অনুভব করা সম্ভব। ঘটা করে করা হলো নতুন রাজকুমারের নামকরণ উৎসব। তার নাম রাখা হলো ‘হর্ষবর্ধন’।

ফুলের সুগন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ। বাজনাদারদের উদ্দাম বাজনায় একটি উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরী হয়েছে। দেয়ালগুলোকে নতুন আঙ্গিকে রাঙিয়ে তুলছে রংমিস্ত্রীরা। রাজকীয় আলপনায় সেজে উঠেছে রাজবাড়ির উঠোন। এতো এতো আয়োজন যে কারো অবসরের সময়টুকু নেই। কেনোই বা হবে না এতো আয়োজন? রাজকুমারীর বিয়ে বলে কথা। রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে থেকে আনানো হয়েছে দক্ষ কাঠমিস্ত্রী ও সোনার কারিগর। বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন জ্ঞানী-গুণী শিল্পীরা। চারণ কবিদের কবিগানে মুখরিত সমগ্র রাজবাড়ি। সাদা ফুল, সুগন্ধি এবং রংধনুর মতো রং ছড়ানো সিল্ক, লিনেন, তুলাবস্ত্র ও মসলিন কাপড় দিয়ে সাজানো হচ্ছে বিয়ের বেদী। প্রাসাদভর্তি আত্মীয়-স্বজন ও আমন্ত্রিত অতিথিরা। তাদের আপ্যায়নে ব্যতিব্যস্ত সবাই। পান ও মিষ্টি সুগন্ধি মসলা দিয়ে করা হচ্ছে আপ্যায়ন। রাজা, রাণী, রাজকুমার কেউ বসে নেই। সমস্ত সামন্ত রাজারা আছেন তদারকির দায়িত্বে। প্রাসাদের আঙিনায় সুন্দর সুন্দর রঙিন কাপড়ে সাজানো হাতি-ঘোড়ার খেলা দেখানো হচ্ছে, কৌতূহলী মানুষেরা ভিড় করে আছে সেখানে। নববধূর জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের রাজারা উপহারের ডালা ও শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছেন। সব মিলিয়ে এক হইহই রইরই পরিবেশ।

ঐদিকে অন্দরমহলের একটি ঘরে অবনত ও স্বপ্নবিভোর নয়নের এক তরুণীকে দেখা যাচ্ছে। তার সখীরা তাকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করছে। ঘন কালো গভীর চোখের সেই তরুণীর সৌন্দর্যের কাছে আজ সমস্ত কিছু যেনো হার মেনেছে। এই তরুণী আর কেউ নন, রাজকুমারী রাজ্যশ্রী। এমনিতেই রাজকুমারীর সৌন্দর্যের প্রশংসায় পুরো রাজ্য মুখর। তবে আজ বউ সাজে তার সৌন্দর্য আরো বহুগুণ বেড়ে গেছে। এই তো, কিছুক্ষণ পরই শুভলগ্নে বিয়ে হতে যাচ্ছে তার, তরুণ রাজকুমার গ্রহবর্মার সাথে। সখীদের হাসি-তামাশার মাঝেই হাজারটা স্বপ্ন এঁকে তাতে বুঁদ হয়ে আছেন রাজকুমারী, যেনো ঠিক এই মুহূর্তের অমূল্য এই অনুভূতিকে কিছুতেই হারিয়ে ফেলা যাবে না।

হাতির পিঠে চেপে এলেন বর গ্রহবর্মা। অনন্যসাধারণ অনুষ্ঠান করে স্বাগত জানানো হলো তাকে। স্বয়ং মহারাজ বুকে জড়িয়ে ধরলেন হবু জামাতাকে। আনন্দোল্লাস করতে করতে ভাবী বরকে ভেতরে নিয়ে গেলো সবাই। উপহার প্রদান পর্ব শেষে মহিলা মহলে নিয়ে যাওয়া হলে হাসি-তামাশায় বরণ করে নেয়া হলো বরকে। সবশেষে বিয়ের লগ্ন এসে উপস্থিত হলো। প্রথম প্রহরে অগ্নিদেবতাকে সাক্ষী করে বিয়ে সম্পন্ন হলো রাজকুমার গ্রহবর্মা ও রাজকুমারী রাজ্যশ্রীর।

পুষ্যভূতি বংশের বর্ধন রাজ্যের একমাত্র রাজকন্যা রাজ্যশ্রীর বিয়ের এমনই চমৎকার চিত্র ফুটে উঠেছে ৭ম শতকে লেখা বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে। বাণভট্ট নিজের পরিচয় নিয়েও বেশ কিছু বলে গিয়েছেন ‘হর্ষচরিতে’। ব্রাহ্মণ বাৎস্য বংশীয় চিত্রভানু ও রাজদেবীর ছেলে বাণের জন্ম ৭ম শতকের শুরুর দিকে কনৌজের সোনা নদীর পাশে অবস্থিত প্রীতিকুটা গ্রামে। ছেলেবেলা থেকেই তার ঝোঁক ছিলো শাস্ত্রজ্ঞানার্জন ও পুরাণ পাঠের প্রতি। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবার মৃত্যু তাকে কিছুদিনের জন্য উচ্ছৃঙ্খল ও বিক্ষিপ্ত করে তোলে। এক ভবঘুরে জীবন পেয়ে বসে তাকে। বিভিন্ন প্রার্থনালয় ও শিক্ষা কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষের সান্নিধ্যে থেকে অবশেষে এক সময় কনৌজে ফিরে যান তিনি। রাজা হর্ষবর্ধন তখন উড়িষ্যায় অবস্থান করছেন। কোনো এক গ্রীষ্মের দিনে বাণকে ডেকে পাঠান তিনি নিজের দরবারে। কিছুদিন তাকে পর্যবেক্ষণ করেন রাজা এবং তার গুণে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। তাই নিজের সভাকবির দায়িত্ব তিনি বাণকেই দিয়েছিলেন, সেই সাথে দিয়েছিলেন রাজকীয় সম্মাননা। প্রথমে রাজসভায় সবার উপহাসের পাত্র হলেও পরে ঠিকই সাদরে গৃহীত হয়েছিলেন বাণভট্ট। তার লেখা ‘হর্ষচরিত’ শুধুমাত্র রাজার প্রশস্তিমূলক রচনাই নয়, এটি একই সাথে তার আত্মজীবনীও। সংস্কৃত সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে এই ‘হর্ষচরিত’, যা মূলত একটি ইতিহাস বিষয়ক কাব্যগ্রন্থ। একে ‘আখ্যায়িকা’ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।

‘হর্ষচরিত’ শুধু আমাদেরকে বাণভট্ট ও হর্ষবর্ধনের পরিচয়ই দেয় না; তখনকার ভারতবর্ষের সমাজচিত্র, আচার-আচরণ, রাজনীতি, ফসল, গৃহপালিত প্রাণী, উদ্ভিদ সবকিছুরই সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় ‘হর্ষচরিত’ থেকে; যার ফলে এতো বছর পরেও সেই সময়ে মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানা এতো সহজ হয়েছে। পুরুষ ও মহিলাদের পরিধানের কাপড়, সাজসজ্জা সবকিছুরই স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে। রাজধানী থানেশ্বর ছিলো এক সমৃদ্ধ নগরী, উন্নত ছিলো সেখানকার জীবনযাত্রা, কৃষি ছিলো খুবই সমৃদ্ধ। মোট কথা, ধান, গম, গাছগাছালি দিয়ে বেষ্টিত এক শহর ছিলো থানেশ্বর। উন্নত ছিলো নিষ্কাশন ব্যবস্থাও। হরিণরা তখন নির্ভয়ে এদিক=ওদিক ছুটে বেড়াতো। সম্ভব ছিলো তাজা ডালিমের রস ও আখের রস দিয়ে তৃষ্ণা মেটানো। একবার হর্ষবর্ধন যখন মালব অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মালববাসীরা তাকে মাঠা, দই, গুড়, চিনি উপহার হিসেবে দিয়েছিলো।

এতো সমৃদ্ধ পরিবেশ-পরিস্থিতি ও জ্ঞানার্জনের উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও গুপ্ত যুগের ঠিক পরেই পুষ্যভূতিদের শাসন চালু হবার কারণে সেই সময়ে নারীর অধিকারে সামঞ্জস্য ছিলো না। সব ক্ষেত্রেই নারীর অধিকারকে খর্ব করা হতো। সম্পদ ও শিক্ষা উভয় ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হতো নারীরা। এমনকি সতীদাহ প্রথাও তখন চলমান। স্বয়ং হর্ষবর্ধনের মা রাণী যশোমতী দেবীই তো সতী হয়েছিলেন, স্বামীকে হত্যা করা হলে হর্ষবর্ধনের বোন রাজ্যশ্রীও আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ দিতে চেয়েছিলেন।

এবার তবে ঘুরে আসা যাক ‘হর্ষচরিত’ এর সেই প্রাচীন সময় থেকে, সূচনালগ্ন থেকেই জানা যাক হর্ষবর্ধনের কাহিনী। ৬ষ্ঠ শতকের শুরুর দিকে যখন গুপ্ত রাজবংশের পতন হলো, তখন উত্তর ভারতবর্ষের সামন্তরাজরা নিজেদেরকে স্বাধীন ঘোষণা করে বসলেন। আর এরই মাধ্যমে কতগুলো ছোট ছোট রাজ্যের উৎপত্তি হলো। এই নতুন শাসকদের মধ্যে ক্রমাগত যুদ্ধ ও কলহ চলতে চলতে এক পর্যায়ে থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশ প্রাধান্য বিস্তার করা শুরু করলো। নরপতি পুষ্যভূতির মাধ্যমেই নতুন এই অধ্যায়ের (৫০০-৬৪৭ সাল) শুরু হয়েছিলো। এই বংশের প্রথম দুইজন শাসক নিজেদেরকে ‘মহারাজা’ ঘোষণা করেছিলেন, আর এরা ছিলেন সূর্যের উপাসক। পুষ্যভূতি বংশের তৃতীয় শাসক প্রভাকরবর্ধনের (৫৮৫-৬০৬ সাল) তত্ত্বাবধানেই গঠিত হয় বর্ধন সাম্রাজ্য। তিনি ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে একত্রিত করেন এবং ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন।

প্রভাকরবর্ধন উত্তর ভারতবর্ষের প্রধান অঞ্চলে আক্রমণকারী হুণ উপজাতিদেরকে প্রতিহত করেন এবং নিজের সাম্রাজ্যসীমা আরও বিস্তৃত করেন। বর্ধন সাম্রাজ্যকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তিনি নিজের একমাত্র মেয়ে রাজ্যশ্রীর বিয়ে দেন কনৌজের মৌখরীরাজ ঈশানবর্মণের ছেলে গ্রহবর্মার সাথে। তবে এদিকে আবারো গঙ্গা ভ্যালীতে আক্রমণ করে বসে হুণরা। তাই এবার হুণদের প্রতিহত করতে বড় ছেলে রাজ্যবর্ধনকে হিমালয়ের পাদদেশে পাঠালেন প্রভাকরবর্ধন। রাজ্যবর্ধনের বয়স তখন ১৯ বছর। ভাগ্যের কি এক নির্মম খেলা! যুদ্ধে জয়ী হয়ে রাজকুমার রাজ্যবর্ধন বিজয়োল্লাস করতে করতে ফিরে এসে যা দেখলেন, তার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। বাবা প্রভাকরবর্ধন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছেন এবং ধর্মের ওপর অগাধ বিশ্বাসের কারণে মা যশোমতী দেবী সতী হয়েছেন। বাধ্য হয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে রাজ্যভার নিতে হলো রাজ্যবর্ধনকে।

অন্যদিকে, বর্ধন রাজপরিবারের এমন দুঃসময়ে মালবের রাজা দেবগুপ্ত কনৌজ আক্রমণ করে বসলেন। মৌখরীদের সাথে অনেক আগে থেকেই শত্রুতা ছিলো দেবগুপ্তের। দেবগুপ্ত গ্রহবর্মাকে হত্যা করলেন এবং তার স্ত্রী রাজ্যশ্রীকে বন্দী করে নিজের সাথে নিয়ে গেলেন। মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে আবার গৌড়রাজ শশাঙ্কের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। ভগ্নিপতি গ্রহবর্মার মৃত্যু ও বোন রাজ্যশ্রীর অপহরণের খবর শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন রাজ্যবর্ধন। ১৬ বছর বয়সের ছোট ভাই হর্ষবর্ধনের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সেনাপতি ভান্ডির তত্ত্বাবধানে দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে রাজ্যবর্ধন রওয়ানা হলেন বোনকে উদ্ধার করার জন্য। পথে মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে দেখা হয়ে গেলে তাকে হত্যা করলেন রাজ্যবর্ধন। কিন্তু গৌড়রাজ শশাঙ্ক খেললেন আরেক খেলা। তিনি নিজের মেয়ের সাথে রাজ্যবর্ধনের বিয়ের জন্য প্রস্তাব করেন, যা ছিলো মূলত একটি প্রতারণা এবং এতে রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের সাথে মৈত্রী স্থাপনে রাজি হন। এই সুযোগে রাজ্যবর্ধনকে দুর্বল ও একাকী অবস্থায় হত্যা করেন শশাঙ্ক। তবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে শশাঙ্কের হাতে রাজ্যবর্ধনের হত্যার কাহিনী আমরা শুধুমাত্র বাণভট্ট ও চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর লেখা থেকেই পেয়েছি। আর তাদের দুজনের লেখাতেই ছিলো হর্ষবর্ধনের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি হর্ষবর্ধনের অনুরাগের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই হিউয়েন সাং-ও শুধু পুষ্যভূতি বংশের গুণগানই গেয়ে গেছেন। এ কারণেই শশাঙ্কের ছল-চাতুরী ও রাজ্যবর্ধনকে হত্যার ঘটনা সম্পর্কে কোনো বিশ্বাসযোগ্য দলিল মেলে নি।

সে যা-ই হোক, পরবর্তীতে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর খবর শুনে ক্ষুব্ধ হর্ষবর্ধন শশাঙ্ককে পরাস্ত ও বোন রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করার জন্য রওয়ানা দিলে পথে গঙ্গার তীরে তার ভান্ডির সাথে দেখা হয়। ভান্ডি হর্ষবর্ধনকে জানান যে, রাজ্যশ্রী কোনোভাবে কারাগার থেকে পালিয়ে বিন্ধ্য পর্বতের পাদদেশে একটি জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এই খবর শুনে শশাঙ্ককে পরাস্ত করার দায়িত্ব ভান্ডির উপর দিয়ে হর্ষবর্ধন বিন্ধ্য পর্বতের দিকে রওয়ানা হন। কিন্তু পরবর্তীতে ভান্ডির মাধ্যমে শশাঙ্কের কোনোরকম ক্ষতি হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি।

বোনকে উদ্ধার করার পর মাত্র ১৬ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন হর্ষবর্ধন। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, শশাঙ্কের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ তিনি নিবেনই। বোনের অনুমতি নিয়ে কনৌজকে নিজের রাজধানী বানান হর্ষবর্ধন।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে রাজা হলেও হর্ষবর্ধন ছিলেন ভীষণ রকমের শান্ত, স্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন ও রাজ্যপরিচালনায় পারদর্শী। তিনি প্রথমে শিবের উপাসক ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে এক পর্যায়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি ভীষণ অনুরাগী হয়ে ওঠেন তিনি। তার শাসনকালে প্রজারা ছিলো খুবই সুখী। হর্ষবর্ধন সবসময় সত্য, ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতেন।

হর্ষবর্ধন ছিলেন একজন জ্ঞানী ও শিক্ষিত রাজা। দরবারের লেখক ও শিল্পীদের তিনি প্রচন্ড সম্মান করতেন। এমনকি তিনি নিজেও একজন কবি ও নাট্যকার ছিলেন। ‘রত্নাবলী’, ‘নাগানন্দ’ ও ‘প্রিয়দর্শিকা’ নামের সংস্কৃত ভাষার তিনটি বই লিখেছেন তিনি। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন যোগ্য ক্যালিগ্রাফার। বাঁশখেরা তাম্রশাসনে হর্ষবর্ধনের একটি স্বাক্ষর থেকে এর প্রমাণ মেলে। নিজের রাজধানী থানেশ্বর থেকে পরিবর্তন করে কনৌজে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি ‘পরম মহেশ্বর রাজচক্রবর্তী’ উপাধি গ্রহণ করেন।

হর্ষবর্ধন ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে দানশীল রাজা। জ্ঞানের পূজারী হওয়ার কারণে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করেন তিনি। একশটি গ্রাম থেকে যে কর পাওয়া যেতো, তার সবটাই সেখানকার ছাত্রদের থাকা, খাওয়া ও পড়ালেখার খরচ বহন করবার জন্য দিয়ে দিতেন তিনি। গুপ্ত যুগে এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হলেও এতে হর্ষবর্ধনের অবদান অনেক বেশি। পরবর্তীতে তিনি এখানে বিনা বেতনেও পড়ার সুযোগ তৈরী করে দিয়েছিলেন। সবসময় দান-ধ্যানে মগ্ন হর্ষবর্ধন চার ভাগের এক ভাগ রাজস্ব শুধুমাত্র শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য ব্যয় করতেন। রাজ্যশাসন, ধর্মীয় কাজ, কর্মচারীদের বেতন ও ভরণপোষণ, বুদ্ধিজীবীদের বৃত্তি, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দান –এ সমস্তও তিনি আদায়কৃত রাজস্ব থেকেই করতেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজেও একদম সাধারণ কাপড়-চোপড় পরা শুরু করেছিলেন।

হর্ষবর্ধনের সময়ে প্রতি পাঁচ বছর পর পর গঙ্গা ও যমুনা নদীর মোহনায় একটি মেলার আয়োজন হতো, প্রয়াগ বা মোহনার দান মেলা। মেলার নাম ছিলো ‘মহামোক্ষ পরিষদ’। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব ও কনৌজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ আসতো এই মেলায়। অসহায়, এতিম, নাবালক ও দরিদ্র মানুষদের নিজ হাতে দান করতেন হর্ষবর্ধন। টানা চার দিন ধরে এভাবেই দানের কাজ চলতো। শুরু হতো বুদ্ধের উপাসনা দিয়ে এবং শেষ হতো বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে দানের মাধ্যমে। ব্রাহ্মণ, শ্রমণ, সন্ন্যাসী –সবাই আসতো এ মেলায় দান গ্রহণ করতে। এভাবে চলতে চলতে এক পর্যায়ে (হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের শেষ ৫ বছর) রাজকোষের সমস্ত অর্থ শেষ হয়ে গেলো। তাই এবার নিজের সব অলঙ্কার দান করে দিলেন তিনি। এমনকি শেষ সম্বল হিসেবে নিজের পোশাকটাও বিলিয়ে দিলেন দানশীল রাজা হর্ষবর্ধন। অবশেষে বোনের দেয়া সাধারণ একটি কাপড় পরে ঘরে ফিরে আসেন তিনি।

রাজা হর্ষবর্ধনের চরিত্রে গভীরভাবে মিশে আছে সমুদ্রগুপ্তের সমরকুশলতা এবং অশোকের প্রজাপ্রেমের সমাবেশ। প্রায় ৪০ বছর রাজত্ব করার পর ৬৪৭ সালে ইতিহাসে বিরল এই শাসকের মৃত্যু হয়। দান ও জ্ঞান অর্জনে তিনি এতোটাই নিমগ্ন থাকতেন যে, বর্ধন সাম্রাজ্যের যোগ্য উত্তরাধিকারী তৈরীতে তিনি মনোযোগ দিতে পারেন নি। আর তাই তেমন সুযোগ্য উত্তরাধিকারী না থাকায় হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর সাথে সাথে সাম্রাজ্যের শেষ প্রদীপও নিভে যায়।

ভারতীয় উপমহাদেশের ৫০০০ বছরের ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবরণীর এটি একটি অংশমাত্র। এই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

[লেখকঃ চেয়ারপার্সন, সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’স এসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশন। ইতিহাস, বিজ্ঞান নিয়ে লেখা staycurioussis.com (বাংলা এবং ইংলিশ) ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status