বাংলারজমিন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

পাল্টে যাচ্ছে কয়রার আদিবাসী মুণ্ডাদের জীবন-জীবিকা

রিয়াছাদ আলী, কয়রা (খুলনা) থেকে

১৯ অক্টোবর ২০২১, মঙ্গলবার, ৮:৫৩ অপরাহ্ন

খুলনার কয়রার  টেপাখালীতে সুন্দরবনের  কোলঘেঁষা বেড়িবাঁধে মুণ্ডাদের বাড়িঘর পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)  বেড়িবাঁধ। পাশেই কেওড়া কাটা খাল। ভাটার সময় তখন। খালের পানি কমে গিয়ে কাদা দেখা যাচ্ছে। এখানে ওখানে গোলপাতা, কেওড়া গাছের সারি। বাঁধের দু’ধারেই লম্বা ঘরের সারি। এক পাশের ঘরগুলো মজবুত ভিতের ওপর। তবে খালের দিকের ঘরগুলো জীর্ণ ছনের। খুলনার কয়রা উপজেলার ৬নং কয়রার  টেপাখালী গ্রামের এই এলাকায় আদিবাসী মুণ্ডাদের বাস। এখানে বাস করে ৪২ ঘর মুণ্ডা, যারা মূলত কৃষিজীবী। মাছ ধরতে ও বনে গিয়ে মধু সংগ্রহে খুব কমই যায় তারা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি জমি কমে যাওয়ায় বর্তমানে  টেপাখালীর মুণ্ডাদের পেশাতেও পরিবর্তন আসছে। ইটভাটা শ্রমিকের কষ্টকর কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। অনেকেই জমি-ভিটে বেচে এলাকা ছাড়ছে। হচ্ছে দেশান্তরী। শুধু  টেপাখালী গ্রামেই নয়, আশপাশের সব মুণ্ডা বসতিতেও দেখা মিলবে একই চিত্রের। খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলার ৩০টি গ্রামে মুণ্ডারা বসবাস করে। মুণ্ডারা নিজেদের ‘হোরোকো’ বলে থাকে, যার অর্থ মানুষ। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মুণ্ডা সম্প্রদায়ের বসবাস। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশে মুণ্ডাদের সংখ্যা ১৫ হাজারের মতো। তারা কখন কীভাবে বাংলাদেশে এসেছে, তার সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে অনেকের ধারণা, মোগল ও ব্রিটিশ আমলে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য মুণ্ডাদের এদেশে নিয়ে আসেন স্থানীয় জমিদাররা। ১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে মুণ্ডারা রাজশাহী জেলার আদিবাসী হিসেবে নথিভুক্ত হয়। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মুণ্ডাদের নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার ১২০টি পরিবার, শ্যামনগর উপজেলার ৩৫৩টিতে এক হাজার ৭৭০ জন ও খুলনার কয়রা উপজেলার ৩২০ পরিবারে এক হাজার ৫৩০ জন মুণ্ডার বসতি পাওয়া যায়। তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার কারণে দিন দিন তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গত রোববার দুপুরে  টেপাখালীর বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল গণেশ মুণ্ডার সঙ্গে। মাঠে ধান কাটার কাজ করছিলেন তিনি। হাত-পায়ে কাদা নিয়েই তিনি কথা বলছিলেন নিজেদের জীবন-যাপন নিয়ে। গণেশ জানান, তাদের পূর্ব-পুরুষ বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি বানিয়ে এই এলাকায় বসবাস শুরু করেন। এক সময় তাদের প্রায় পরিবারেরই পর্যাপ্ত জমি ছিল। কিন্তু প্রভাবশালীরা ছলচাতুরী করে সেসব জমি দখলে নিয়েছেন। অনেকে অভাবের কারণে জমি বেচে দিয়েছেন। এখন অধিকাংশ মুণ্ডা পরিবারই হয় ভূমিহীন অথবা শুধু মাথা  গোঁজার মতো বসতির অধিকারী। এক পুরুষ আগেও তাদের ১৬ বিঘা জমি ছিল। এখন আছে শুধুই ভিটে। গণেশ জানান, এখন তারা এক কুড়ি (২০টা) মুঠি ধানছড়া কাটলে বিনিময়ে দুই মুঠি ধানছড়া পান। একবেলায় কাটতে পারেন সাত কুড়ি ধানছড়া। এতে ১৪ মুঠি ধানছড়া মিলে, যাতে তাদের হিসাবে ৬/৭ পালি (মাপার পাত্র বিশেষ) ধান পাওয়া যায়। কেজি হিসাবে এর পরিমাণ ২০-২২  কেজি।
 পেশায় গ্রাম পুলিশ গণেশ জানান, মাঠে এই কাজের সুযোগ মেলে বছরে পাঁচ-ছয় মাস। বাকি সময় তারা বলতে  গেলে বেকার থাকেন। জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন জীবিকার সন্ধানে নামছেন মুণ্ডারা। ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন অসংখ্য মুণ্ডা। গত রোববার টেপাখালীর মুণ্ডাপাড়া ঘুরে দেখা যায়, কর্মক্ষম সদস্যরা কাজে  গেছেন। পাড়ার বেশিরভাগ নারী মাঠের কাজে ব্যস্ত। বাড়ির পুরুষরা কয়েক মাসের জন্য চুক্তিতে ইটভাটার কাজে যাচ্ছেন। অনুসন্ধানে জানা  গেছে, ইটভাটার কাজ থাকলে মহাজনদের কাছ থেকে অগ্রিম ২০-৩০ হাজার টাকা নেয় মুণ্ডারা। পরে ভাটার মৌসুমে পাঁচ-ছয় মাসের জন্য শ্রমিক হিসেবে কাজ করে তা পরিশোধ করেন। অনেকে কিছু টাকা জমিয়ে বাড়িতে পাঠায়। উত্তর বেতকাশীর মাঝের আইট গ্রামের শ্যামসুন্দর মুণ্ডা জানান, ভাটার মৌসুম শুরুর আগে প্রায় এক মাস ধরে প্রতিদিন বাস ভরে শ্রমিকরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যান ইট বানানোর কাজ করতে। মুণ্ডাদের মধ্যে শিক্ষার হার খুব কম। ছেলেদের তুলনায়  মেয়েদের অংশগ্রহণ পড়াশোনায় বেশি। অধিকাংশ মুণ্ডা ছেলেমেয়েই পড়ে পঞ্চম  শ্রেণি পর্যন্ত। এ বিষয়ে কয়রা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সুমিলা মুণ্ডা বলেন, প্রথমত: সচেতনতার অভাবে শিক্ষার প্রসার কম। মনে করা হয়, পড়ার চেয়ে মাঠে কাজ করলে রোজগার বেশি হবে। এ ছাড়া পরিবারের বড় সদস্যরা বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকায় সন্তানদের পড়াশোনার খোঁজ  নেয়ার কেউ থাকে না। তারা ঠিকমতো বিদ্যালয়েও যায় না।
শিক্ষার হার কম হওয়ায় বিচিত্রমুখী পেশায় মুণ্ডাদের অংশগ্রহণ কম। অনেক মুণ্ডা পরিবারে কিছু জমি থাকলেও তাতে ধান ছাড়া অন্য ফসল হয় কম। এমনকি ভিটার জমিতে শাক-সবজি ফলানোও কষ্টকর। কারণ সেচের পানি  মেলে না। তাদের পক্ষে গবাদি পশু পালন করাও মুশকিল। কারণ পশুকে খাওয়ানোর মতো ঘাস নেই। তা ছাড়া পানির অভাবও প্রচণ্ড। স্থানীয়রা জানান, আইলা ও সিডরের পর পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। কয়রার উত্তর বেতকাশী গ্রামে এমন কয়েক ঘর মুণ্ডার খোঁজ মিলল, যারা সপরিবারে অন্যত্রে চলে গেছে। মুণ্ডাদের জীবন-জীবিকার এমন দুর্দশায়ও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের  তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাহায্য-সহযোগিতা মিললেও জীবনের  টেকসই উন্নয়নের জন্য কেউ  সেভাবে এগিয়ে আসছেন না। কয়েজজন মুণ্ডা জানান, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হাতে  গোনা কয়েকজন বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা পান। চাকরিতে  কোটা প্রথা থাকলেও অধিকাংশ সময় তাদের সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভূমিহীন হওয়ায় এনজিওগুলোও তাদের ঋণ দিতে চায় না। মুণ্ডাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে কয়রার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আইসিডি। এর প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান আশিক বলেন, মুণ্ডাদের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে খাদ্য, জীবিকা, পানি ও শিক্ষার সুযোগ। মুণ্ডারা কৃষিভিত্তিক কাজে অভ্যস্ত- এ কথা জানিয়ে আশিক আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের সে সুযোগ কমে আসছে। এজন্য এখন প্রয়োজন  টেকসই বিকল্প জীবিকার  খোঁজ। তিনি জানান, বিকল্প জীবিকায় সবাইকে উৎসাহিত করতে তারা কয়েকটি পরিবারকে  নৌকা দিয়ে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেন। তিনি বলেন, নৌকার বিকল্প গরু দেওয়ার কথা চিন্তা করছিলাম তবে গো-খাদ্যের সংকট রয়েছে। মুণ্ডাদের খাবার পানির সংকট রয়েছে। এর সমস্যা সমাধানে পানির ট্যাঙ্ক বসিয়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা পানি খেয়ে জীবন বাঁচাতে পারতো। এ ছাড়াও তাদের নিয়ে উদ্যোগ  নেওয়া হচ্ছে গরুর গোবর  থেকে কেঁচো সার তৈরির। কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, কয়রার আদিবাসী মুণ্ডা ও মাহাতো পরিবারের সদস্যদেরকে স্বাবলম্বী করার জন্য সরকারের পাশাপাশি বে-সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তাদেরকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status