মত-মতান্তর

অশনি সঙ্কেত!

ড. মাহফুজ পারভেজ

১৮ অক্টোবর ২০২১, সোমবার, ১:০১ অপরাহ্ন

প্রতীকী ছবি

আফগানিস্তানে শিয়া মতাবলম্বী সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদে উপর্যুপরি হামলায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু ও অসংখ্য লোক আহত হয়েছেন। ভারতে সংখ্যালঘু দলিত ও মুসলিমরা উগ্রপন্থীদের হাতে প্রায়ই আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা নিগৃহীত হয়েছেন। তাবৎ দক্ষিণ এশিয়ায় উগ্রপন্থার বিস্তার ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের অশনি সঙ্কেতে শুভবোধ, বহুত্ববাদ, গণতান্ত্রিক সহনশীলতা হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে প্রায়শই। কিন্তু কেন বারবার এমন উত্তেজক ও সহিংস পরিস্থিতির তৈরি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়?

এসব পরিস্থিতি কি বিচ্ছিন্ন ও তাৎক্ষণিক নাকি কোনও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল, এমন সন্দেহ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, বস্তুতপক্ষে দক্ষিণ এশিয়ার কোনও দেশেই সংখ্যালঘুরা নিরঙ্কুশ নিরাপত্তায় নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারছেন না। থেমে থেমে হামলা ও অরাজকতা হচ্ছেই। উগ্রপন্থার তাণ্ডবে ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত হচ্ছে মানুষ ও মানবতা।

শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই শান্তি মানুষের প্রধান কাম্য বিষয় হলেও সেই শান্তির অভাব মাঝে মাঝে দেখা দেয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যমূলক পদক্ষেপ ও আচরণের কারণে। তখন শান্তির পৃথিবীতে অশান্তির ছায়া নেমে আসে। মানবিক, বিবেকসম্পন্ন মানুষ তখন হাতে হাত রেখে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল নির্বিশেষে শান্তির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করাই মানুষের চিরায়ত মানবিক অঙ্গীকার।

বিশ্বের ও আমাদের দেশে প্রায়ই শান্তি বিঘ্নিত হয়ে অমানবিক ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে অসৎ গোষ্ঠীর মতলববাজির কারণে। কারা এই অসৎ মতলববাজ গোষ্ঠী, যারা ধর্মের নামে, জাত, পাত ও ভাষার নামে উগ্রতা ঘটায়?

আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর কোনও কোনও মহল দক্ষিণ এশিয়ায় উগ্রতা ও সহিংসা বিস্তারের আশঙ্কার কথা প্রচার করেছিল। এসব উগ্র ঘটনা যদি বিচ্ছিন্ন ঘটনা না হয়, তাহলে এর যোগসূত্র কোথায়? কারা পেছন থেকে এ অঞ্চলের দেশে দেশে অশান্তি সৃষ্টির পায়তারা করছে?

ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে, স্বার্থের নামে স্বল্প সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন সময়ে নানা দেশে উগ্রতা ও হিংসা প্রদর্শন করে। তাদের অন্তরে, নীতিতে ও পরিকল্পনায় থাকে শত্রুতা, প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষভাব। সভ্যতার ইতিহাসে এরা সব সময়ই পশুর সঙ্গে আস্তাবলে স্থান পেয়েছে। মানুষের সমাজে এদের জায়গা হয় না। কারণ মানুষ শান্তি চায়। হাঙ্গামা, সন্ত্রাস, প্রতিহিংসা, ধ্বংস, রক্ত, তাণ্ডব মানুষ চায় না। মানুষ চায়, শান্তির পৃথিবীতে অশান্তির ছায়া দূর হোক। তবুও শান্তির দেখা পাওয়া কঠিন হয় চক্রান্তকারীদের ঘৃণ্য অপতৎপরতার কারণে।

ফলে এটাই মানুষ, সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার দায়িত্ব যে, সর্বাবস্থায় ও সকল অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষ ও সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অশান্তি সৃষ্টিকারী অপরাধীদের নির্মূল করতে হবে। কারণ, পৃথিবীর কোথাও এমন কোনও প্রকৃত মানুষ নেই, যিনি অশান্তি, হিংসা, সন্ত্রাস, সহিংসতা, নাশকতা, বর্বরতা, হানাহানি, উগ্রতা, দ্বন্দ্ব-কলহ, সংঘাত-সংঘর্ষ, ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধবিগ্রহ ও হত্যাযজ্ঞকে উপকারী বা উত্তম মনে করেন বা সমর্থন করেন।

তথাপি ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, মানবতার ঐক্য, সামাজিক সংহতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম-কর্ম ভুলে বিপথগামী লোকেরা বিভিন্ন দলমত, উপদল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করেই চলে উগ্র আবেগে বা মহল বিশেষের উস্কানির কারণে। যার কারণে, দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, সংঘাত-সংঘর্ষ, অন্তঃকোন্দলের নৈরাজ্যময় ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ অব্যাহত থাকে।

বিশেষত, দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশ এক ধর্ম, এক জাতি বা এক ভাষার অঞ্চল নয়। বহুবিচিত্র মানুষের বাস এখনে। এখানে দলীয়, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক উগ্রতা ও কঠোরতার বদলে বহুত্ববাদী সমন্বয়ের কথাই বলেছেন অতীতের অগ্রণী নেতৃবৃন্দ। গণতান্ত্রিক উদারতাই এখানকার ঐক্য, সংহতি, শান্তি ও উন্নয়নের মূলমন্ত্র। উগ্রপন্থিরা এই মহত্তম মতাদর্শকে বারবার নস্যাৎ করতে উদ্ধত। এতে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি ক্রমেই বিনষ্ট হচ্ছে এ অঞ্চলে। বিশেষত, ভারতে মুসলিমরা কিছু উগ্রপন্থী হিন্দুর হাতে অত্যাচারিত হচ্ছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এসব মুসলিমকে হত্যা করছে তারা। কখনো রাস্তাঘাটে নারীদের প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য করা হচ্ছে। একটি ঘটনায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া একজন মুসলিম শিক্ষার্থীকে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়েছে। ফেরিওয়ালাদের প্রহার করা হয়েছে। তাদেরকে হিন্দুদের গ্রামে যেতে বারণ করে দিয়েছে তারা। এসব নিয়ে প্রায়ই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আফগানিস্তানে বিরোধী পক্ষ ও বাংলাদেশেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছে।

পরিস্থিতির পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ভারতের কেন্দ্রে ও বিশেষ কিছু রাজ্যে উগ্রপন্থার বিস্তারের কারণে বহু নৃশংসতার নজির গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজকে স্তম্ভিত করছে। উত্তর প্রদেশে প্রায়ই ধর্ম ও জাত-পাতের নামে হত্যা-নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। গণপিটুনি ও প্রকাশ্যে দলবদ্ধভাবে বিরোধী মত, পথ ও ধর্মের মানুষকে নির্যাতনের উগ্রতা মানবতাকে লজ্জিত করেছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে হামলা চলছে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে।

করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে আগে ভারতে নাগরিকতা আইন বিরোধী আন্দোলন চলার সময় খোদ দিল্লিতে দাঙ্গা হয়েছে। বহিরাগত উগ্রপন্থীরা লাগাতার কয়েকদিন হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে মুসলিম এলাকায়। তারও আগে গুজরাট জ্বলেছে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার আগুনে। বাড়িঘর ধ্বংস করে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা ও বাস্তুহীন করা হয়েছে।

উত্তর ও পশ্চিম ভারতের উগ্রপন্থার উন্মত্ততা পূর্ব ও দক্ষিণ দিকেও ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ গতিতে। আসামও উদার গণতন্ত্রীদের হাতছাড়া। সেখানে নব্য ক্ষমতাসীন বিজেপি অভিবাসী অ-অসমিয়াদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক আসামবাসী বাঙালির ভবিষ্যৎ সেখানে অন্ধকারের মুখে। তাদের বের করে দেয়া হবে আসাম থেকে। তাদের বিরুদ্ধে চলছে হত্যা ও নির্যাতন। আসামের পাশের ত্রিপুরা আর পশ্চিমবঙ্গে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে উগ্রতার হুঙ্কার।

ভারতের মতো আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে, বাংলাদেশে উগ্রতার উল্লাস ও বিরোধী-সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে শুভবাদী ব্যক্তি, সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্বেগের শেষ নেই। বিচ্ছিন্ন কিংবা সুপরিকল্পিত, যেভাবেই হোক, এসব উগ্রতার ইঙ্গিত মানবতা, সহনশীলতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য মোটেও ভালো নয়। গণতন্ত্র, শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশের বিরুদ্ধে এসব ন্যক্কারজনক ঘটনা অশনি সঙ্কেত স্বরূপ।

দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্কুল পরিস্থিতিতে মানুষের পারস্পরিক ঐক্য, সামাজিক সংহতি ও শান্তি-সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়ার বিষয়ে দেশে দেশে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। হিংসা, অশান্তি, মতবিরোধ, বিভেদ-বিভক্তি, তিক্ততা-রেষারেষি, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-ঘৃণা প্রভৃতি দূরীভূতের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে এবং আঞ্চলিক পরিসরে সুসম্পর্ক ও সম্প্রীতি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। হিংসাকে হিংসা দিয়ে নয়, বরং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, আস্থা ও সৌহার্দ্যের মাধ্যমে সমঝোতা ও সহযোগিতার পথে সমাজে, দেশে আঞ্চলিক স্তরে শান্তি, অধিকার ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে সাধারণ মানুষকে নিয়ে নেতৃবৃন্দকেও একযোগে কাজ করতে হবে। সবাইকে মিলেই রক্ষা করতে হবে মানুষের নিরাপত্তা ও মর্যাদা এবং থামাতে হবে ঘৃণ্য চক্রান্তের অশনি সঙ্কেত।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status