প্রথম পাতা

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে কেন এত বিতর্ক?

স্টাফ রিপোর্টার

১৬ অক্টোবর ২০২১, শনিবার, ৯:২৭ অপরাহ্ন

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। প্রায় সবসময়ই সরব মিডিয়ায়। সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে তার কিছু মন্তব্য ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি করে। সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, অবাক লাগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা শিক্ষার মূল দায়িত্বে আছেন, তারা সেখানকার প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের কথায় ওঠেন আর বসেন। এই ব্যক্তিত্বহীনতা শিক্ষকতার মর্যাদাকে ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন করে। প্রভাবশালীদের তদবিরে শিক্ষক নিয়োগ হয়। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে, মেধা, যোগ্যতাকে পাশ কাটিয়ে নিয়োগ হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। ইদানীং সে বিতর্ক আরও জোরদার হয়েছে। কিসের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে শিক্ষক। মেধাই কি প্রধান বিবেচ্য হচ্ছে? নাকি দলীয় আদর্শ ও সম্পর্ককে দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। এমনকি এমনও অভিযোগ আছে, পছন্দের কাউকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম বর্ষ থেকেই দেয়া হয় বিশেষ নজর। নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে দেয়া হয় বিশেষ বিবেচনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেয়া হয় বিশেষ কৌশল। বাদ দেয়া হয় সর্বোচ্চ মেধাবীদের।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বহুক্ষেত্রেই দলীয় আনুগত্যকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখা হয়। অনেক শিক্ষাবিদই মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে পিএইচডি ডিগ্রি বাধ্যতামূলক থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, আামাদের শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা বিশ্বমানের নয়। গ্রাজুয়েট ও মাস্টার্স দিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। যা বিশ্বের অনেক দেশেই সম্ভব নয়। বিশ্বের নানা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে পিএইচডি ডিগ্রি লাগে। আমারও যদি পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ দিতে পারতাম তবে এই সমালোচনাগুলো হতো না।

শিক্ষক নিয়োগে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি। বিভাগ ভেদে প্রভাষক নিয়োগে প্রার্থীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষার ফল সিজিপিএ- ৩ দশমিক ২৫ থেকে ৩ দশমিক ৫০ থাকতেই হবে। এই পদে নিয়োগে প্রয়োজনে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীদের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে সেখান থেকে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করা যাবে।

শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম বিপর্যয় ডেকে আনছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, এখন তো আর শিক্ষক নিয়োগ হয় না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় না হয় ভোটার নিয়োগ। শিক্ষকরা সারা বছর নির্বাচন করেন কিন্তু ছাত্রদের কোনো নির্বাচন হয় না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পয়সা গুণে নিয়োগ দেয়া হয় কাজেই শিক্ষা কোথাও হচ্ছে না। রাজনীতি হচ্ছে, হচ্ছে ব্যবসা। বাংলাদেশের শিক্ষার হাল হকিকত খুবই করুণ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে গ্রেড দেয়া হয় সিংহভাগ বিভাগেই শিক্ষার্থীদের মেধার প্রতিফলন পাওয়া যায় না। সবদিকেই একটা নৈরাজ্য চলছে। আমি মনে করি শিক্ষক যদি ভালো না হয় শিক্ষার্থীও ভালো হয় না। বড় সমস্যাটা হচ্ছে ভালো গ্রেড পাওয়া শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বাংলা কিছুই জানে না। যার ভাষা জ্ঞান নেই তার বিষয় জ্ঞান আছে আমি শিক্ষক হিসেবে তা ভাবতে নারাজ।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় খুশি নন বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী। মানবজমিনকে তিনি বলেন, প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপারিশে নিয়োগ হয় কম। তবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে আসলে আমি খুশি না। যদি একটা কাজ করা যেতো যে, ইউজিসি অথবা একটা সার্চ কমিটি করে একটা শর্ট লিস্ট তৈরি করে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দিতো তাহলে বিতর্কিত ব্যক্তির নিয়োগের সম্ভাবনা কম হতো।
উন্নত দেশ এবং বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবধান তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসানের দেয়া একটি স্ট্যাটাস ব্যাপক আলোচিত হয়। তিনি লিখেছিলেন, উন্নত দেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য কি কি চায় আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক নিয়োগে কি কি চায় তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দিলাম। এই তুলনা চিত্র দেখলেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কি চায় এইটা মোটামুটি ইউনিভার্সাল; কারণ চীন ভারত থেকে শুরু করে ইউরোপ আমেরিকায় সব জায়গায় দরখাস্তের সঙ্গে যা যা থাকতে হবে সেগুলো নিম্নরূপ:

১. প্রার্থীর অবশ্যই পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে এবং ন্যূনতম একটি পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতা কাঙ্ক্ষিত।
২. কোনো prescribed বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কোনো নির্ধারিত ফরম পূরণ করার বাধ্যবাধকতা নেই। এর পরিবর্তে একটি কভার লেটার দিতে বলে।
৩. একটি সংক্ষিপ্ত রচনা যেখানে থাকবে একাডেমিক ও প্রফেশনাল অভিজ্ঞতার বিবরণ, কীভাবে প্রার্থী প্রতিষ্ঠানের মান বাড়াতে সাহায্য করতে পারেন তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ, এবং কীভাবে প্রার্থী বিভাগের বিদ্যমান গবেষণার উন্নতি ঘটাবেন তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এ ছাড়া প্রার্থী ভবিষ্যতে কি ধরনের গবেষণা করতে ইচ্ছুক তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
৪. শিক্ষকতার একটি সংক্ষিপ্ত স্টেটমেন্ট যেখানে থাকবে প্রার্থীর নিজস্ব টিচিং এপ্রোচ এবং শিক্ষকতার নিজস্ব দর্শনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
৫. এই পর্যন্ত যতগুলো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ লিস্ট।
৬. ন্যূনতম তিনজন রেফারির নাম ও ই-মেইল এড্রেস।
এইবার দেখা যাক বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার জন্য কি কি চায়:
১. বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রণীত একটি prescribed ফরম পূরণ করতে হবে।
২. প্রার্থীর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা বা সমমানের পরীক্ষার উভয়টিতে ১ম বিভাগ/জিপিএ ৪ (৫ স্কেলে), স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার কমপক্ষে একটিতে ১ম শ্রেণি থাকতে হবে। তবে সিজিপিএ এর ক্ষেত্রে উভয়টিতে কমপক্ষে ৩.৫ থাকতে হবে।
৩. প্রার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অথবা সমমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ৩ বছরের শিক্ষকতা বা গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
৪. স্বীকৃত জার্নালে কমপক্ষে ১টি মৌলিক প্রকাশনা থাকতে হবে। (সেটা দেশীয় গার্বেজ হলেও হবে)!
৫. পিএইচডি থাকলে অন্যান্য যোগ্যতার যেকোনো একটি শিথিল করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তির পার্থক্য প্রায় নেই বললেই চলে। আর বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের সঙ্গে পার্থক্য আকাশ আর পাতাল। তাহলে আমরা কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সত্যি সত্যি বিশ্ববিদ্যালয় বলতে পারি? এইভাবেই আমরা দেশের আনাচে-কানাচে কলেজ খুলে বিশ্ববিদ্যালয় নামে চালিয়ে দিচ্ছি। বিশ্বের কোথাও দেখছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে এসএসসি-এইচএসসি রেজাল্ট জানতে চায়। এসএসসি এইচএসসি কেন, অনার্স মাস্টার্সের রেজাল্টই জানতে চায় না। তারা দেখে পিএইচডি, গবেষণা পত্রের সংখ্যা, পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা আছে কিনা ইত্যাদি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status