এক্সক্লুসিভ

মুরগি ও ডিমের চড়া দামেও দিশাহারা খামারিরা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১১ অক্টোবর ২০২১, সোমবার, ৮:২৩ অপরাহ্ন

দেশে সস্তায় প্রোটিন পেতে মুরগির ও ডিমের কোনো বিকল্প নেই। দেশের মানুষের প্রায় ৩৬ শতাংশ প্রোটিন আসে পোল্ট্রি খাত থেকে। কিন্তু হঠাৎ করেই সারা দেশে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে সব ধরনের মুরগি ও ডিমের দাম। সম্প্রতি নতুন করে আরও দাম বেড়েছে পণ্য দুটির। সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারগুলোতে কেজিতে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। আর সোনালি মুরগির বেড়েছে ২০ টাকা। ওদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর তথ্য মতে, গত ১০ বছরে দেশে ডিমের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ডিম ও মুরগির দাম অস্বাভাবিক বাড়লেও এর সুফল পাচ্ছেন না তৃণমূল পর্যায়ের খামারিরা। মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। খামারিরা জানান, আমরা পোল্ট্রি খামার করে বছরের পর বছর লোকসান গুনছি। অথচ দাম যখন বাড়ছে, তখন এর সুফল ঘরে তুলতে পারছি না। পাঁচ বছরে খামার বন্ধ হয়েছে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক। এদিকে দিন দিন দাম বাড়ায় বিপাকে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি করছেন ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা। আর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে ছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকার মধ্যে। এ হিসাবে মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৬০ টাকা বেড়েছে। আর আগস্টের শুরুতে বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা কেজি দরে। ব্রয়লার মুরগির মতো পাকিস্তানি কক বা সোনালি মুরগির দামও দফায় দফায় বেড়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে ২১০ থেকে ২৩০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া সোনালি মুরগির দাম কয়েক দফা বেড়ে এখন ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে এই মুরগির কেজি বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা। এ হিসাবে সপ্তাহের ব্যবধানে সোনালি মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। ব্যবসায়ীরা জানান, মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার কারণে খামারে সব ধরনের মুরগির উৎপাদন কম হচ্ছে। করোনাকালীন এমনিতেই অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এর পরও যেসব খামারি পুনরায় শুরু করতে চাইছেন, তাদের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মুরগির খাদ্যের দাম। চলতি বছর কয়েক দফায় খাদ্যের দাম বাড়ায় অনেকেই খামারে মুরগি উৎপাদন করছে না। এতে খুচরা ও পাইকারি বাজারে দেখা দিয়েছে মুরগির সংকট। মুরগির দামের বিষয়ে কাপ্তান বাজারের ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী বলেন, মাসখানেক আগেও ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম বেশ কম ছিল। ফলে ফার্ম মালিকরা মুরগির উৎপাদন কমিয়ে দেন। তাই এখন বাজারে মুরগি সরবরাহ কম। অন্যদিকে হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে। মাস দুয়েক আগে মুরগির যে চাহিদা ছিল, এখন তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আবার বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে। ফলে মুরগির চাহিদা বেড়েছে। সবমিলিয়ে মুরগির দাম বেড়ে গেছে। রাজধানীর বাজারগুলোতে লেয়ার মুরগির ডিম ৫-১০ টাকা কমে খুচরায় ডজন বিক্রি হচ্ছে ১০৫-১১০ টাকা দরে। অর্থাৎ হালিপ্রতি মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৩৬-৩৭ টাকায়। তবে দেশি মুরগির ডিমের ডজন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা এবং হাঁসের ডিম ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ৫৭৪.২৪ কোটি এবং ২০১৯-২০ সালে এ পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৩৬ কোটিতে। অর্থাৎ গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ডিমের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে বছরে ১০৪টি হারে ডিমের প্রাপ্যতা জনপ্রতি ১০৪.২৩টি। এ বছর ডিম দিবসের স্লোগান দেয়া হয়েছে ‘প্রতিদিন ডিম খাই, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াই’।
বাজারে আসা রহিম মিয়া বলেন, আমরা সাধারণ মানুষ। মাসে এক-দুইদিন পরিবার নিয়ে মাংস-ভাত খাবো এখন তার উপায়ও নেই। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৮০ টাকা হয়ে গেছে। এত দাম দিয়ে মুরগি কিনে খাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। ডিমের দামও বাড়তি। তাই পাঙ্গাশ মাছ কিনেছি।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশ এসএমই ফোরামের সভাপতি চাষী মামুন বলেন, দেশের সিংহভাগ মাংসের চাহিদা পূরণ করছে পোল্ট্রি শিল্প। কিন্তু এ শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল সয়ামিলের দাম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে বাচ্চার দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু ডিম ও মাংসের দাম খামারি পর্যায়ে সেভাবে বাড়েনি। এ কারণে দেশের লাখ লাখ প্রান্তিক খামারিরা কোটি কোটি টাকা লোকসানে পড়েছেন। এমনকি লোকসান দিতে দিতে অনেক উদ্যোক্তা খামার বন্ধ করে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। বক্তারা বলেন, অতি দ্রুত লোকসান কমানোর পাশাপাশি এ খাতের উন্নয়নে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, ২০১০ সালে দেশের একজন মানুষ গড়ে আড়াই কেজি মুরগির মাংস খেতো। এখন তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ছয় কেজি।
এসোসিয়েশনগুলোর তথ্য মতে, ২০১৪ সালে ছোট-বড় খামার ছিল প্রায় এক লাখ ২০ হাজার। এখন চালু আছে প্রায় ৮০ হাজার। পাঁচ বছরে খামার বন্ধ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার। একসময় এ খাতে প্রায় ৪৩ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল। বর্তমানে বেকার হয়ে পড়েছে এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে জড়িত প্রায় ২৫ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের যুগ্ম মহাসচিব খন্দকার মো. মহসিন বলেন, এ সেক্টরে এসে বিনিয়োগকারীরা বারবারই হোঁচট খাচ্ছেন। করোনার ধাক্কায় খামারিরা বেকার হয়ে পথে বসে পড়ছেন। কিন্তু এই ক্ষতিগ্রস্ত খাতটির পুনর্গঠনে কোনো তাগিদ নেই উপর মহলের। ডিম ও মুরগির মাংসের উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে ভয়াবহ ধস নেমেছে। এতে পোল্ট্রি শিল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ৫০ ভাগ ডিম ও মুরগির জোগান দেন গাজীপুর জেলার খামারিরা। গাজীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ জেলায় ডিম উৎপাদনকারী বা লেয়ার মুরগির খামার ছিল ৪ হাজার ১০৬টি ও ব্রয়লার মুরগির খামার ছিল ২ হাজার ৫৬৫টি। কিন্তু ক্রমাগত লোকসানের কারণে ১০ বছরে প্রায় ৫০ ভাগ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা মহামারি সময়ে সবচেয়ে বেশি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এ সময় প্রায় ১০ ভাগ খামার বন্ধ করে দিয়েছেন খামারিরা। অন্যদিকে নতুন কোনো খামার তৈরি হয়নি এ জেলায়। খামার বন্ধ হয়ে যাওয়া বা উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে ঢাকাসহ সারা দেশে।
গাজীপুর জেলার বিভিন্ন বাজারে প্রতি হালি ডিম (লাল) বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকায়। সে হিসাবে ১০০ ডিমের খুচরা দাম পড়ে ৯৫০-১০০০ টাকা। কিন্তু খামারিরা ১০০ ডিম পাইকারি বিক্রি করছে ৭৪০-৮০০ টাকায়। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগি খুচরাপ্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকা। খামারিরা পাইকারি বিক্রি করছে ১৪৫ টাকা। সোনালি মুরগি খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি, যেখানে খামারিরা পাইকারি বিক্রি করছে ২৬০-২৭০ টাকায়। এ জেলার নিরাপদ পোল্ট্রি খামারের মালিক সাইফুল ইসলাম জানান, তিন মাস ধরে খাবারের দাম বাড়ছে। দুই মাস আগে এক বস্তা খাবার ছিল ২৪০০ টাকা, বর্তমানে কিনতে হচ্ছে ২৭৬০ টাকায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বেশি দামে ডিম বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমানে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম। করোনার সময় অনেক ফার্ম বন্ধ হয়ে গেছে বা অনেকে নতুন করে ফার্মে বাচ্চা ওঠাননি। ফলে বাজারে ডিমের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। করোনার সময় ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল মাত্র ৯০-৯৫ টাকা কেজি। এতে অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন খামার করার। ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার এটাই একটি কারণ।
জেলা প্রতিনিধিরা জানান, সরবরাহ না থাকায় বগুড়ার বাজারে মুরগির দাম এখন আকাশছোঁয়া। সোনালি জাতের মুরগির কেজি ৩০০ টাকা, ব্রয়লার ১৫৫ টাকা ও লেয়ার জাতের মুরগি ২৮০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। বাজারে মুরগির ডিমের হালি এখন ৩৪ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। ময়মনসিংহে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি মুরগির দাম বেড়েছে ৪০-৫০ টাকা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status