মত-মতান্তর

অর্পা হাসানের আত্মহনন- মেয়েটাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি!

যুক্তরাজ্য থেকে ডা: আলী জাহান

১০ অক্টোবর ২০২১, রবিবার, ১০:২৮ পূর্বাহ্ন

১. আজ ১০ অক্টোবর, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। জ্ঞানী ব্যক্তিরা ইতিমধ্যে 'গুরুত্ব আরোপ', 'আহ্বান জানানো', 'করতে হবে', ' এগিয়ে আসতে হবে' ইত্যাদি শব্দ এবং বাক্য সম্বলিত কথামালা দেয়া শুরু করেছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে মাঝারি এবং ছোট পদের জ্ঞানের ভারে ন্যুব্জ ব্যক্তিরা যখন বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে সভা-সমাবেশ এবং বাণী দিচ্ছেন তখন ঠিক তার আগের দিন ০৯ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার উত্তর শাহজাহানপুর এলাকায় ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন কলেজ ছাত্রী অর্পা হাসান।

২. অর্পা হাসান আত্মহননের পথ বেছে নিলেন কেন? তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব অথবা বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করা কি কারো দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? এই অভাগা দেশে কেউ আত্মহত্যা করলে কাউকে জবাবদিহিতা করতে হয়? জবাবদিহিতা করার ইতিহাস আছে? রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা যখন নতুন নতুন ইতিহাস তৈরির দাবিতে ব্যস্ত, তখন আত্মহত্যায় মিলিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে কেন বাঁচানো যায়নি তা নিয়ে কোনো কাজ করার ইতিহাস আছে? উত্তরটা হচ্ছে, নেই। ওগুলো করার সময় নেই। জন্ম দিবস, মৃত্যু দিবস, ক্ষমতা দিবস, সম্বর্ধনা নিয়েই আমাদের ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। খয়রাতি করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষকে টিকা দিলেও দায়িত্বশীল পদে একজন দাবি করেছেন যে, বাংলাদেশে খুব শিগগিরই বিদেশে করোনা টিকা রপ্তানি করবে। এসব মানব সন্তানদের দিয়ে আত্মহত্যার কারণ বের করার কাজ করানো যাবে?

৩. আপনি হয়তো ভাবছেন, এই ভয়াবহতা আপনাকে ও আপনার পরিবারকে স্পর্শ করবে না। মারাত্মক ভ্রমে আছেন। অনেকের ধারণা, যারা ধর্মকর্ম পালন করেন তাদের ভেতর আত্মহত্যার সংখ্যা কম। কথাটি আংশিক সত্য, পুরোপুরি নয়। আত্মহত্যার তালিকায় আস্তিক-নাস্তিক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরীব সবার নাম রয়েছে।তার মানে হচ্ছে, আত্মহত্যার অনেকগুলো কারণ আছে। কারণ না জানলে আপনি চিকিৎসা করবেন কীভাবে? মৃত্যু ঠেকাবেন কীভাবে?যে দেশের কর্তাব্যক্তিরা মাঝেমধ্যে দাবি করেন, দেশ তুরস্ক-কানাডা-সিঙ্গাপুরের চাইতে এগিয়ে গেছে, তারা কখনো এই ছোট কাজটি করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন? না, তেমন কোন তৎপরতা আমার চোখে পড়ে না। কিন্তু আমরা ক্রমাগত 'গুরুত্ব আরোপ' করেই যাচ্ছি। আহ্বান জানিয়েই যাচ্ছি। সেই সুযোগে অর্পা হাসানরা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছে।

৪. বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: আব্দুস সালাম সেলিম ১৫ আগস্ট গলায় দড়ি দিয়ে নিজ বাসায় আত্মহত্যা করেছেন। এটি একটি ভয়াবহ ব্যাপার। যিনি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে চিকিৎসা করতেন তিনি কেন নিজেই আত্মহত্যা করলেন? বলা হচ্ছে যে, বদলির অর্ডার আসার কারণে উনি তা সহ্য করতে পারেননি। লাখ টাকার প্রশ্ন হচ্ছে যে, বদলির অর্ডার মনঃপুত হয়নি এ ধরনের মানুষের সংখ্যা হাজার হাজার। বাকিরা আত্মহত্যা না করলেও উনি কেন আত্মহত্যা করলেন? কোনো অ্যানালাইসিস হয়েছে? শুনলাম থানার এক ওসি নাকি তদন্ত করছেন! ধরণী দ্বিধা হও!

৫. করোনা ভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৫৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন মোট ১৩ জন। সারা দেশের অবস্থা বাদ দিলেও সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এত সংখ্যক শিক্ষার্থী মৃত্যুকে বেছে নিল কেন তার কোনো তদন্ত হয়েছে? তদন্ত হলে তার কোনো ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে? বাংলাদেশের এসবের তদন্ত করবেন কে? থানার ওসি? উনার কাজ তো চোর,ডাকাত আর খুনি ধরা, থানায় এনে ঠ্যাঙ্গানি দেয়া। উনারা এই কাজ করবেন কীভাবে? এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও পত্রিকায় দেখি উনাদের এই কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। উনারা এসবের কী বুঝবেন? তার মানে হচ্ছে কাজটি হচ্ছে না। তাহলে আপনি আমি জানবো কীভাবে যে, কেন এই ছাত্রছাত্রীরা মৃত্যুকে বেছে নিলেন? এদের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? কারও কোনো দায়িত্ব নেই? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো দায়দায়িত্ব নেই? হল প্রভোস্টের কোনো দায়িত্ব নেই? বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ডাক্তার সাহেবদের কোন জবাবদিহিতা নেই! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ১০ টাকায় চা, সিঙ্গারা আর সমুচা পাওয়া যায় এমন বক্তব্য যারা দেন তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন আত্মহত্যা করে তখন তারা কোথায়? তাদেরকে কেন বিচারের সম্মুখীন করা হবে না?

৬. একজন সুস্থ সবল মানুষের পক্ষে আত্মহত্যা করার সম্ভাবনা কতটুকু? খুবই সামান্য। শতকরা ৩৬-৯০ ভাগ আত্মহত্যাকারী বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশনে আক্রান্ত থাকেন। স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীর সংখ্যা ৩-১০ ভাগ। ড্রাগ বা অ্যালকোহল সংক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪০-৫০ ভাগ। খেয়াল করে দেখুন, এ হিসেব অনুসারে যারা আত্মহত্যা করছেন তাদের প্রায় সবাইকে চিকিৎসার মাধ্যমে আত্মহত্যা থেকে বিরত রাখা সম্ভব।

৭. কিন্তু বিরত রাখবেন কারা? কাদের দায়িত্ব  এই আত্মহননের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে সেই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার? বাংলাদেশে অনেক সিনিয়র চিকিৎসক বন্ধুকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি। তাদের জবাব হলো যে, যারা বাঁচতে চায় তাদেরকেই বাঁচাতে পারছি না, সেখানে যারা মারা যেতে চায় তাদের নিয়ে আমাদের কী করার আছে?

৮.আমরা সরকারকে ট্যাক্স দেই। অনেকগুলো কাজের ভেতর সরকারের একটি অন্যতম কাজ হচ্ছে যে, আপনি যখন অসুস্থ হবেন তখন সরকারের দায়িত্ব হলো আপনার চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা, আপনাকে বাঁচিয়ে রাখা। উন্নত বিশ্বে তাই হচ্ছে। প্রতিটি আত্মহত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ হবে Coroner's court-এ। বাংলাদেশে এই কোর্টের কোনো অস্তিত্ব নেই। 

 ৯.অর্পা হাসান যদি ইংল্যান্ডে আমার রোগী হতেন তাহলে তার মৃত্যু আমার জন্য একটি দুঃসময় হিসেবে আবির্ভূত হতো। আমাকে বিশেষ কোর্টে যেতে হতো। যে এলাকায় মেয়েটি থাকত সে এলাকার সরকারি/বেসরকারি হাসপাতালের যে ডাক্তারকে দেখিয়েছে তাকেও কোর্টে ডাকা হতো। ক্ষেত্রবিশেষে হাসপাতালের ডিরেক্টরের ডাক পড়তো। ডাক পড়তো সংশ্লিষ্ট নার্সের এবং সোশ্যাল ওয়ার্কারের । কোর্টের ভেতর আত্মহত্যাকারীর পক্ষে জাদরেল সব আইনজীবী থাকতেন। আমাদের সবাইকে প্রমাণ করতে হতো যে, অর্পা হাসানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যা যা করার দরকার তা আমরা করেছি। কোর্টের রায়ের উপর নির্ভর করত আমার বা অন্যের পরবর্তী পেশাজীবন। বিশাল অঙ্কের জরিমানার ব্যাপার তো আছেই। হাসপাতাল বা চেম্বার বন্ধ করার ইতিহাস ও আছে।

 ১০. প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনার পর কোর্টের রিপোর্ট তৈরি করা থেকে আদালতে হাজিরা দেয়া এবং শুনানিতে অংশ নেয়া ইংল্যান্ডে ডাক্তারদের জন্য একেকটি দুঃসহ স্মৃতি। এ পর্যন্ত আমার পেশা জীবনে দুবার কোর্টে ডাক পড়েছে। প্রতিবার শুনানির সময় মনে হয়েছে, এই বুঝি আমার ডাক্তারি লাইসেন্স চলে গেল!

 ১১. অবশ্য বাংলাদেশে থাকলে হয়তো আমাকে এই দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হতো না। আমার কলিগদের সেই কথাই বলি ' জীবিত মানুষকে আমরা চিকিৎসা দিতে পারছি না সেখানে যারা মারা যাচ্ছে তাদের নিয়ে কী করবো?' উনাদের হতাশার কারণ বুঝি। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা অবস্থান করছেন তারা কি তা বুঝেন?

 ১২. বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন দিবস আর উৎসব পালনে যে টাকা খরচ হয় তার একটি অংশ মানসিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় খরচ করলে অর্পা হাসানদের মতো আত্মহত্যার শিকার তরুণ-তরুণীদের অনেককেই বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হতো। কিন্তু এসব নিয়ে আপাতত চিন্তা করার তো আপনাদের সময় নেই! আপনি একদিন ঠিকই চিন্তা করবেন যখন আপনারই পরিচিত একজন হঠাৎ করে আত্মহত্যা করে বসবে। বলা যায় না সেই আত্মহত্যাকারীদের ভেতর আপনিও একজন হয়ে যেতে পারেন। নিকট অতীতে শোবিজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশায় ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত লোকজনের আত্মহত্যার ঘটনা তারই প্রমাণ। 

 
---

ডা: আলী জাহান

কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য।

[email protected]

 

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status