শরীর ও মন
ফুসফুস ক্যান্সার: যে কারণে মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি
ডা. ভিসওয়াসভারান বালাসুব্রামানিয়ান
৭ অক্টোবর ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৬:৫০ অপরাহ্ন
উপসর্গসমূহ:
ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে কোন উপসর্গ থাকে না। তবে ক্যান্সারের অবস্থা অনুযায়ী ধীরে ধীরে উপসর্গগুলো পরিলক্ষিত হয়। ক্রমাগত কাশি যাকে স্মোকারস কফও বলা হয়, কাশির সাথে রক্ত যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, নিশ্বাসকালীন বুকে ব্যথা, গলা ভাঙ্গা, ওজন হ্রাস, হাড়ের ও মাথাব্যথা ইত্যাদি ফুসফুস ক্যান্সারের কিছু উপসর্গ। এসব উপসর্গ দেখা গেলে তৎক্ষণাৎ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়াই শ্রেয়। দৈনন্দিন ধূমপানের অভ্যাস সম্পর্কে চিকিৎসককে অবগত করা উচিৎ। সার্বিক পরিস্থিতি ও অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসক ঔষধ, প্রয়োজনে চিকিৎসা গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারে।
কারণসমূহ:
ধূমপানকে ফুসফুস ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ বলা হয়। বিশেষ করে সিগারেটের ধোঁয়ায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান কার্সিনোজেন থাকে। ফলে ধূমপায়ী এমনকি দীর্ঘ সময ধূমপায়ীদের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিরাও ক্যান্সার আক্রান্ত হতে পারেন। ধূমপানের ফলে ফুসফুসের আস্তরণের ব্যাপক ক্ষতি হয়, ফলে সৃষ্টি হয় ক্যান্সার। দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরে প্রবেশকৃত ধোঁয়া এবং ক্ষতিকারক পদার্থের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে ধূমপানের ফলে তা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে থাকে ফলে ফুসফুস সহজেই ক্যান্সার আক্রান্ত হতে পারে। ফুসফুসের ক্যান্সার দুই প্রকার, স্মল সেল লাং ক্যান্সার (এসসিএলসি) এবং নন-স্মল সেল লাং ক্যান্সার (এনএসসিএলসি)। মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা ক্যান্সারের অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।
যাবতীয় ঝুঁকিসমূহ:
ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপান, রেডন গ্যাস, অ্যাসবেস্টস ও কার্সিনোজেন এবং বংশগত ইত্যাদি ফুসফুস ক্যান্সারের উল্লেগযোগ্য কিছু কারণ। মাটি, পাথব এবং পানিতে ইউরেনিয়াম ভেঙে রেডন গ্যাস উৎপন্ন হয়। রেডন টেস্টিং কিট বাতাসে রেডনের উপস্থিতি সনাক্ত করে। রেডনের মাত্রা নির্ধারিত থাকে। যদি বাতাসে রেডনের উপস্থিতি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি থাকে তাহলে অবিলম্বে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ। অ্যাসবেস্টস ছাদযুক্ত বাড়িতে বসবাসকারীদের ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি হয়। অ্যাসবেস্টসে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম এবং নিকেল থাকে যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। ধূমপায়ীদের ক্যান্সার পরীক্ষার জন্য সিটি স্ক্যান করানো হয়। ৫৫ বা এর বেশি বয়সীদের ধূমপানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা উচিৎ কারণ তাদের ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে।
পরীক্ষা পদ্ধতি:
ডাক্তারকে ফুসফুসের অস্বাভাবিক এলাকা পরীক্ষা করতে সাহায্য করে লিম্ফ নোড থেকে টিস্যুর নমুনা সংগ্রহের জন্য ঘাড়ের গোড়ায় একটি ছেদ তৈরি করতে সাহায্য করে। সিটি স্ক্যান এবং এক্স-রে বুকের দেওয়াল দিয়ে সুই নির্দেশ করতে এবং সন্দেহজনক কোষ সংগ্রহ করতে ব্যবহৃত হয়। ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয়ে সিটি স্ক্যান করা হয়। ইমেজ টেস্ট এবং এক্স-রেও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ক্যান্সার কোষের উপস্থিতি বোঝার জন্য স্পুটাম সাইটোলজি পদ্ধতিতে মাইক্রোস্কোপ দ্বারা থুতু পরীক্ষা করা হয়। বায়োপসি’র মাধ্যমে ফুসফুসের কোষে ক্যান্সারের উপস্থিতি এবং অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। ব্রোকোস্কোপ দ্বারা ফুসফুসে ক্যান্সারের অবস্থান সনাক্ত করা হয় ও মিডিয়াস্টিনোস্কোপি দ্বারা লিম্ফ নোডস থেকে টিস্যুর নমুনা সংগ্রহের জন্য ঘাড়ের গোড়ায় ছিদ্র করা হয়। সিটি স্ক্যান এবং এক্স-রে দ্বারা বুকে ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কোষগুলো সংগ্রহ করা হয়।
ফুসফুসের ক্যান্সারের পর্যায় শুধুমাত্র ফুসফুসের ক্যান্সার কোষ অধ্যয়ন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রথম পর্যায়ে, ক্যান্সার কোষ শুধুমাত্র ফুসফুসে সীমাবদ্ধ। ফুসফুসের ক্যান্সারের দ্বিতীয় ধাপে দেখা যায় ক্যান্সার বুকের দেওয়ালে এবং ডায়াফ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। ফুসফুসের ক্যান্সারের চূড়ান্ত বা চতুর্থ পর্যায়ে ক্যান্সার ফুসফুস থেকে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। ফুসফুসের ক্যান্সারটি কোন পর্যায়ে আছে তা নির্ধারণে পিইটি সিটি স্ক্যান বা অন্যান্য রেডিওলজিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। দুর্ভাগ্যবশত সঠিক স্ক্রিনিং এবং সচেতনতার অভাবে বেশিরভাগ ফুসফুস ক্যান্সার চতুর্থ পর্যায়ে গিয়ে ধরা পড়ে। ফলস্বরূপ ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই, ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে বাড়তি সচেতনতা আবশ্যক।
চিকিৎসা:
ফুসফুস ক্যান্সারের চিকিৎসা এর পর্যায় বা অবস্থার উপর নির্ভর করে। কখনও কখনও এক বা একাধিক চিকিত্সার প্রয়োজনও হতে পারে। যার মধ্যে; কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি বা টার্গেটেড ড্রাগ থেরাপি উল্লেখযোগ্য। সার্জারি হলে ফুসফুসের ছোট, বড়, পুরো লোব এমনকি সম্পূর্ণ ফুসফুসও অপসারণের প্রয়োজন হতে পারে। সার্জারির ক্ষেত্রে রক্তপাত ও ইনফেকশনের ঝুঁকি থাকে, তাই অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা সার্জারি করাতে হবে। রিসপিরেটরি থেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মাধ্যমে প্রাথমিক সুস্থতা নিশ্চিত করা যেতে। সার্জারির আগে-পরে রোগীর যথাযথ যত্ন নিতে হয়। সঠিক যত্ন রোগীর উপসর্গ কমতে সাহায্য করে। সঠিক যত্নই পারে রোগীকে একটি স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে।
লেখক: কনসালটেন্ট অব ইন্টারভেনশনাল পালমোনোলজি অ্যান্ড স্লিপ মেডিসিন
ইয়াশোদা হসপিটালস, হায়দ্রাবাদ।