মত-মতান্তর

মহালয়া এবং দূর্গাপূজার ক্ষণগণনা শুরু

সুব্রত বিশ্বাস (শুভ্র)

৬ অক্টোবর ২০২১, বুধবার, ১০:৪৪ পূর্বাহ্ন

মা দূর্গা যখন আমাদের মাঝে আসেন, প্রকৃতিই সবার আগে স্বাগত জানায়। আকাশে তুলো মেঘের রাশি, কাশফুল আর শিউলি ফুলের সমাহারে মা আসেন আমাদের কাছে শরতের আশ্বিন মাসে। কৃষ্ণপক্ষের অবসান এবং শুক্লপক্ষ বা দেবীপক্ষের সূচনায় অমাবস্যার একটি নির্দিষ্ট ক্ষণকে সনাতন ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেওয়া হয়েছে। পুরাণ এবং শাস্ত্রের বেশ কিছু তথ্য এবং ব্যাসদেব রচিত মহাভারতে এই দিনটিকে পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং দেবীপক্ষের সূচনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘মহালয়’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত উৎস মহৎ এবং আলয়। কিংবা মহত্ত্বের আলয়ও বলা যেতে পারে। এই মহালয় শব্দ থেকেই স্ত্রীবাচক পদটি এসেছে- ‘মহালয়া’। তবে এই মহালয়া শব্দের নানাবিধ অর্থ রয়েছে। যেমন, মহালয় প্রসঙ্গে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে, যে ক্ষণে পরমাত্মায় অর্থাৎ পরব্রহ্মে লয় প্রাপ্তি ঘটে সেটিই হলো মহালয়। কেননা, পরমাত্মাই পরব্রহ্ম। আর নিরাকার ব্রহ্মের আশ্রয়ই হল মহালয়।

সাধারনভাবে মহালয়া মানে দূর্গাপূজার দিন গোনা, মহালয়ার ৬ দিন পর মহাসপ্তমী, দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো ইত্যাদি। কিন্তু মহালয়ার তার চেয়ে বড় গুরুত্ব আছে। সেটা এখন আলোচনা করব।

মহালয়া মানে পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবীপক্ষের শুরু। পিতৃপক্ষ হলো পূর্বপুরুষদের তর্পাদির জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ। হিন্দু পুরান মতে জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যরে মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনি সদ্য মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিকে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের উর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে।

ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য। আসল দূর্গা পূজা হলো বসন্তে। সেটাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। শ্রীরামচন্দ্র অকালে- অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবীর অকাল-বোধন বলা হয়।

সনাতন ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে সমগ্র জীব জগতের জন্য তর্পন করতে হয়। কার্যাদি অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। তর্পন মানে খুশি করা। শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে এদিনে এমই করেছিলেন। সেই অনুসারে এই মহালয় তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করেন। পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলী প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্তে পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহলয় বলা হয়। এই মহালয় থেকে মহালয়া। পিতৃপক্ষেরও এটি শেষ দিন।

সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে একবার পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে পিন্ড দান করতে হয়, সেই তিথিতে করতে হয় যে তিথিতে উনারা প্রয়াত হয়েছেন।

মহালয়াতে যারা গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য, তাহারা শুধু পূর্বপুরুষদের নয় সৃষ্টির সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন।

পৌরানিক মতে, মহাভারতের মহা যুদ্ধে কর্ণ মারা যাওয়ার পর তাকে খাদ্য হিসাবে সোনার অলংকার দেওয়া হয়। বিস্মিত, বিমূঢ় কর্ণ এর কারণ জানতে চান মহারাজ ইন্দ্রের কাছে। ইন্দ্র তখন তাকে জানান যে, কর্ণ তার জীবদ্দশায় কখনও পূর্ব পুরুষদের খাবার এবং জল অর্পন করেননি। বরং তার দানের বিষয় ছিলো শুধুই সোনা। আর সেই কর্মফলেই তার এই দশা। পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে যে খাবার ও জল অপর্ন করতে হয় তা কর্ণ জানতেন না বলে তাকে ১৬ দিনের জন্য পৃথিবীতে ফিরে আসতে সুযোগ দেওয়া হয়। যাতে তিনি পিতৃ পুরুষদের জল এবং খাবার অর্পন করতে পারেন। এই সময় কালই পিতৃপক্ষ হিসেবে পরিচিত হয়। মহলয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্ঠমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও আমাবস্যা। এই জন্য মহালয়া মানেই আর ৬ দিনের প্রতিক্ষা মায়ের পূজা শুরু হওয়ার। এই দিনেই দেবীর চক্ষুদান করা হয়। মাহিষাসুরমর্দিণী দেবী দূর্গা সমস্ত অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক রুপে পূজিত। মহামায়া অসীম শক্তির উৎস। পুরান মতে, মহালয়ার দিনে দেবী দূর্গা মাহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। ব্রম্বার বর অনুযায়ী কোন মানুষ বা দেবতা কখনও মাহিষাসুর কে হত্যা করতে পারবে না। ফলত অসীম ক্ষমতাশালী মাহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন এবং বিশ্বব্রম্ভান্ডের অধীশ্বর হতে চান। ব্রম্বা, বিষ্ণু ও শিব ত্রয়ী সম্মিলিত ভাবে ‘মহামায়া’ এর রূপে অমোঘ নারী শক্তি সৃষ্টি করলেন এবং দেবতাদের দশটি অস্ত্রে সুসজ্জিত করলেন দেবী দূর্গাকে। দেবী দূর্গা নয় দিন ব্যাপী যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করলেন। হিন্দুশাস্ত্র মতে কথিত রয়েছে যে, মহালয়ার দিনই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়েছিলেন দেবী দূর্গা। এই বিশেষ দিনে মহিষাসুরকে বধ করে অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির সূচনা হয়। তাই মহালয়ার গুরুত্ব অপরিসীম


---
সমন্বয়ক, মিডিয়া সেল এবং
কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
শাহবাগ, ঢাকা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status