প্রথম পাতা

উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে

শুভ্র দেব

৬ অক্টোবর ২০২১, বুধবার, ১০:০৩ অপরাহ্ন

ছুটিতে দেশে এসেছিলেন সৌদি প্রবাসী আবুল বাশার। ছুটি শেষে চলতি বছরের ১১ই মার্চ ফের সৌদির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ঢাকার বিমানবন্দরে এসে বোর্ডিং পাসের জন্য লাইনে দাঁড়ান। তখন বিমানবন্দরের এককর্মী এসে একটি প্যাকেট দিয়ে বলেন সেটি তার সঙ্গে নিতে হবে। অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু নিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান বাশার। এতে করে ওই ব্যক্তি তাকে ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেন। বিমানে উঠতে না দেয়ার হুমকিও দেন। তারপরও বাশার তার প্যাকেটটি নিয়ে যেতে পারবেন না বলে জানান। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি জোর করে বাশারের ব্যাগে প্যাকেটটি ঢুকিয়ে দিয়ে বলে আচারসহ কিছু খাবার আছে প্যাকেটে। জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে তার ভাই মো. সাঈদ গ্রহণ করবে। সময় স্বল্পতার জন্য বাশার আর তার সঙ্গে কথা বাড়াননি। ভয় পেয়ে প্যাকেটটি সঙ্গে নিয়ে যান। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে পড়ে। এটাই কাল হয় তার জীবনে। জেদ্দা বিমানবন্দরে যাওয়ার পর বাশার ধরা পড়েন। কারণ ওই প্যাকেটে ইয়াবা পাওয়া যায়। মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। ওই মামলায় রায়ে ২০ বছরের জেলও হয় বাশারের। বিনা অপরাধে জেলে থাকা বাশারের মুক্তির দাবিতে স্ত্রী রাবেয়া সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সন্তানদের নিয়ে তিনি এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।

এদিকে বিমানবন্দরে বিদায় দেয়ার পর বাশারের আর কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না স্ত্রী রাবেয়া। পরিচিত অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সন্ধান পাননি। স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছিলেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে ২০দিন পর হঠাৎ রাবেয়ার মোবাইলে ফোন করেন বাশার। খুলে বলেন সবকিছু। বাশার তখন তার স্ত্রীকে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন। ১৩ই এপ্রিল রাবেয়া বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের কাছে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে অভিযোগ করেন। পরে ১৪ই এপ্রিল আর্মড পুলিশ ঘটনার দিনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে খুঁজে বের করেন সেই কর্মীকে। তার নাম নূর মোহাম্মদ। সে বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত একে ট্রেডার্সের এসআর সুপারভাইজার। আটক করার পর জিজ্ঞাসাবাদ করলে আসল রহস্য বের হয়ে আসে। পরে বাশারের স্ত্রী রাবেয়া বাদী হয়ে ১৫ই এপ্রিল বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় নূর মোহাম্মদ ছাড়া তার সৌদিতে থাকা কথিত ভাই মো. সাঈদও অজ্ঞাতনামা আরেকজনকে আসামি করা হয়। নূর মোহাম্মদ পুলিশের কাছে জোর করে বাশারের কাছে প্যাকেট দেয়ার দ্বায় স্বীকার করেছে। বর্তমানে সে কারাগারে আছে।

বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক মানবজমিনকে বলেন, বাশার ঢাকা বিমানবন্দর হয়ে সৌদি আরব যাওয়ার পর মাদকদ্রব্য বহনের অভিযোগে আটক হন। পরে তার স্ত্রী এসে আমাদের কাছে অভিযোগ করেন তার স্বামীকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। বিমানবন্দরের এক কর্মী তার কাছে ইয়াবা দিয়ে দিছে। এখন তিনি জেলে আছেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করি। পরে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আমরা দেখতে পাই অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজ হাতে একটি প্যাকেট বাশারের ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়। তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর আমরা তাকে গ্রেপ্তার করি। তিনি আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন এই কাজ করেছেন। পরে তার স্ত্রী প্রচলিত আইনে মামলা করেন। আমরা আসামিকে থানায় সোপর্দ করি। তিনি বলেন, এই বিষয়ে আমরা মামলাসহ যে সকল তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি সেগুলো পুলিশের বিশেষ শাখা ও পুলিশ সদরদপ্তরের মাধ্যমে সৌদি আরবের বাংলাদেশি দূতাবাসকে জানানো হয়েছে। তারা এটি নিয়ে কাজ করছেন। এরমধ্যেই শুনেছি আদালত ২০ বছরের জেল দিয়েছেন।

নূর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হলেও সৌদির আদালত সাত মাস পর ২৬শে সেপ্টেম্বর মাদক মামলায় বাশারের ২০ বছরের জেল দিয়েছেন। তার পরিবার অভিযোগ করে বলেছে, যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য-প্রমাণ না থাকায় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অসযোগিতার কারণে সৌদির আদালত বাশারের এত বড় শাস্তি দিয়েছেন। স্বামীর মুক্তির জন্য তিনি গতকাল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছেন। পালন করেছেন অবস্থান কর্মসূচিও। এছাড়া আর্মড পুলিশ ঘটনার সত্যতা পাওয়ার পরপরই পুলিশের বিশেষ শাখাকে (এসবি) তথ্য- প্রমাণ দিয়ে অবগত করে চিঠি দিয়েছে। এসবি থেকে বিষয়টি পুলিশ সদরদপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোকে (এনসিবি) জানিয়েছে। পরে এনসিবি ঢাকা এনসিবি রিয়াদকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানায়। দুই দফা চিঠি দেয়ার পরও এনসিবি রিয়াদ এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেয়নি। প্রবাসী সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন মানবিক দিক বিবেচনা করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে সৌদি আরবে বাংলাদেশি দূতাবাসকে অবহিত করলে বিষয়টির একটা সুরাহা হতে পারে।

বাশারের স্ত্রী রাবেয়া মানবজমিনকে বলেন, সপ্তাহ-পনেরো দিনে একবার আমার স্বামী ফোন দেয়। আড়াই তিন মিনিট কথা হয়। কান্নাকাটি করে সময় চলে যায়। তাকে জেল থেকে বের করার জন্য আকুতি-মিনতি জানায়। কান্নাকাটি করবে না কেন? বিনা দোষে ২০ বছরের জেল হলো। সাত মাস ধরে জেলও ঘাটছে। রায়ের ১০দিন পার হয়েছে। আপিল না করলে সাজা বহাল থাকবে। মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে চিঠি দিয়েছি। তিনি আমার সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন। কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করার কথা বলেছেন। তিনি সৌদি দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলেছেন। সৌদি আরবে বাংলাদেশি দূতাবাস কোনো ধরনের সহযোগিতা করেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু কাগজপত্র পাঠানো হয়েছিল বলে আর্মড পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাকে আদালতে তোলার সময় কোনো কাগজপত্র দেখানো বা সহযোগিতা করা হয়নি। বিমানবন্দর থেকে দূতাবাসের একটি মোবাইল নম্বর দেয়া হয়েছিল। ওই নম্বরে আমার স্বামী একদিন কথা বলেছিলেন। পরে আর ওই নম্বরে কেউ ফোন রিসিভ করেনি। বাংলাদেশ থেকে আমিও ওনাকে ফোন দিয়েছি তিনি রিসিভ করেননি। মেসেজও করেছি স্যার দয়া করে আমার ফোনটা রিসিভ করেন। তবুও তিনি করেননি। ওই নম্বরটা আমি আরেকজনকে দিয়েছিলাম। ওনার সঙ্গে একদিন কথা বলার পর তিনি আর ফোন ধরেননি।

রাবেয়া বলেন, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থানার আন্ধারমানিক গ্রামে বাশারের সঙ্গে সাত বছর আগে আমার বিয়ে হয়েছিল। ৯/১০ বছর ধরে তিনি সৌদি আরবে থাকেন। সেখানে একটি কোম্পানির খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ডিসেম্বরের ১২ তারিখ দেশে এসেছিলেন আর মার্চের ১২ তারিখ কাজে যোগদানের কথা ছিল। ফাইজা নামের চার বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। স্বামীর পরিবারে চার ভাই ও তিন বোন। শশুর নাই শাশুড়ি আছেন। ঘটনার পর থেকে আমি ঢাকায় কুড়িলে ভাইয়ের বাসায় থাকি। কোরবানি ঈদের সময় আমি বাড়িতে গিয়েছিলাম। স্বামীর কিছু ধারদেনা ছিল। সেগুলো পরিশোধ করেছি। মেয়েকে নিয়ে অর্থসংকটে পড়েছি। শ্বশুরবাড়ি থেকে কোনো সাহায্য করছে না। ভাই, মামাত বোনসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলছি। কে কতোদিন এভাবে আমাদের দেখবে? খুবই মানববেতর জীবন-যাপন করছি। মেয়েরও একটা ভবিষ্যৎ আছে।  তাই ঢাকায় এসে একটা চাকরি খুঁজছি।

পুলিশ সদরদপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো’র (এনসিবি) এআইজি মহিউল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, নিরপরাধ এক ব্যক্তি সৌদি আরবে জেল খাটছে এই বিষয়টি অফিসিয়ালি আর্মড পুলিশ আমাদেরকে জানিয়েছিল। তারপর ২৫শে এপ্রিল আমরা এনসিবি ঢাকার পক্ষ থেকে এনসিবি রিয়াদকে একটি চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম। চিঠিতে বলেছিলাম, আবুল বাশার নিরপরাধ। বিমানবন্দরে কেউ জোর করে তার ব্যাগে খাবারের প্যাকেটের সঙ্গে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়েছে। যে কাজটি করেছে তাকে দেশে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাই বাশারকে যেন আইনিভাবে সহযোগিতা করা হয়। চিঠি দেয়ার কয়েকমাস পরেও এনসিবি রিয়াদ কোনো সাড়া দেয়নি। পরে ২৪শে আগস্ট আবার তাদেরকে চিঠি দিয়েছি। সেই চিঠিরও কোনো রেসপন্স আসেনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status