মত-মতান্তর

মৃত্যুর পাশাপাশি করোনায় কমছে মানুষের গড় আয়ু!

ড. মাহফুজ পারভেজ

২ অক্টোবর ২০২১, শনিবার, ৯:৪৯ পূর্বাহ্ন

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে সূচিত করোনাভাইরাস এখন পর্যন্ত গোটা বিশ্বে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনা বদলে দিয়েছে সমাজ, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, জীবন-যাপন, সংস্কৃতি ও মানুষের চিরাচরিত আচরণ। এমনকি বিশ্বব্যাপী মানুষের গড় আয়ু উদ্বেগজনক ভাবে কমেছে করোনার কারণে।

করোনা মহামারির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্বে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের গবেষণা হচ্ছে। এর মধ্যে করোনার কারণে আর্থিক লাভ-ক্ষতির খতিয়ান যেমন আছে, তেমনিভাবে রয়েছে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন ইস্যু। গবেষকরা বলছেন, 'বিশ্বব্যাপী কোভিডের কারণে মানুষের গড় আয়ু উদ্বেগজনক ভাবে কমেছে।'

অতীতের বিভিন্ন বৈশ্বিক মহামারির মৃত্যু সংখ্যাকে এরই মধ্যে ছাড়িয়ে গেছে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হিসাব। আক্রান্ত হয়ে পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় ভুগছেন লক্ষ-কোটি মানুষ।
শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই প্রথম ব্যাপক হারে কমেছে মানুষের গড় আয়ু।

এসব তথ্য পাওয়া গেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায়। গবেষকরা জানাচ্ছেন, করোনায় বিশ্বে শীর্ষ আক্রান্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষদের গড় আয়ু কমেছে প্রায় দুই বছর। পাশাপাশি ইউরোপিয়ান দেশগুলো এবং দক্ষিণ আমেরিকার একাধিক দেশে কোভিডের প্রভাবে কমে গেছে গড় আয়ু।

মোট ২৯টি দেশে সমীক্ষা চালিয়েছিল অক্সফোর্ড। তাতে ২২টি দেশ থেকেই আয়ু হ্রাসের এই দাবির স্বপক্ষে হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষকগণ। ২০১৯ সালের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গিয়েছে, ২০২০ সালে করোনার প্রকোপে মানুষের গড় আয়ু উদ্বেগজনক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত করোনার কারণে গোটা বিশ্বে ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর খবর মিলেছে। সেই মৃত্যুকেও এই সমীক্ষার আওতাধীন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়।

এদিকে, প্রায় ২ বছর ধরে করোনার সঙ্গে লড়ছে গোটা বিশ্ব। ইউরোপ-আমেরিকার মতো দক্ষিণ এশিয়ায়ও করোনার জোরালো দাপট বিদ্যমান। মাঝে মাঝেই করেনার নতুন ঢেউ আর ভাইরাসের নতুন নতুন প্রজাতি থাবা বসাচ্ছে সারা বিশ্বেই।

তবে আশার কথা হলো, গত দু’বছর ধরে করোনার সঙ্গে লড়তে-লড়তে বহু মানুষের শরীরেই তৈরি হয়েছে অ্যান্টিবডি। সেই অ্যান্টিবডি করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। বড়দের পাশাপাশি ছোটদের শরীরেও তৈরি হয়েছে অ্যান্টিবডি। টিকা বিশেষ সহযোগিতামূলক ভূমিকা পালন করছে করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে।

এদিকে ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের ১২ টি জেলায় পরিচালিত সেরোলজিক্যাল সার্ভের ফলে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গিয়েছে যে, ৬-১০ বছর বয়সী ৭০ শতাংশ শিশুর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। ওই জেলাগুলোতে ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৭৪ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর শরীরেও অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।
আরসিএমআর-এর রিজিওনাল মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের উদ্যোগে ওই সেরো সার্ভে চালানো হয়েছিল। আরসিএমআর-এর সংশ্লিষ্টরা মিডিয়াকে জানান, '৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৭০ শতাংশ সেরো প্রিভিলেন্স পাওয়া গিয়েছে। ১১-১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে সেই পরিসংখ্যান ৭৪ শতাংশ। ৬-১০ বছর বয়সী বেশিরভাগ শিশুরা ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেনি। কারণ তারা ঘরের মধ্যেই ছিল। তবে তাদের মধ্যেও যারা আক্রান্ত হয়েছে, তার জন্য পরিবারের অন্য কেউ বা ঘনিষ্ঠ কেউ দায়ী।'

শতাব্দীর সবচেয়ে ব্যাপক ও হন্তারক বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে নাগরিক জীবনের গতিপ্রকৃতি। পরিবর্তিত হয়েছে মানুষের সামাজিকতার ধরন। হঠাৎ করেই সব মানুষ ঘরবন্দী হওয়ায় জনশূন্য পথঘাট যেমন হাহাকার করছে, তেমনি জীবন-যাপনেও এসেছে বহুবিধ সতর্কতা। মার্কেট প্লেস, মুখরিত থাকা ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে গুটিকয় লোকের আনাগোনায় ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। নিস্তব্ধ হয়ে আছে বহু নগরী। পেশা হারিয়েছেন বা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। বহু দেশেই শোনা গেছে আর্থিক মন্দার পদধ্বনি।

করোনা বিশ্ববাসীকে অনেক কিছু শিখতে বাধ্য করেছে। বদলে দিয়েছে চালচলন ও দৈনন্দিন জীবনের হালচাল। ইউরোপে ছেলেরা হ্যান্ডশেকের বদলে এখন পায়ে–পায়ে বাড়ি দিয়ে সম্ভাষণ জানায় একে অপরকে। নারীদের গালে গাল লাগিয়ে সম্ভাষণের যে রেওয়াজ চালু ছিল, তা-ও সম্ভবত একদমই বন্ধ হয়ে যাবে। সামাজিক মেলামেশা, আড্ডা, হৈচৈ, ভ্রমণ, পরিবহণ ইত্যাদিতেও এসেছে ব্যাপক রূপান্তর।

পৃথিবী থেকে করোনা একসময় বিদায় নেবে, কিন্তু সামাজিক অনেক প্রচলিত আচরণ হয়তো মানুষ একেবারেই ভুলে যাবে। মাস্ক ও স্যানিটাইজার হয়ে দাঁড়াবে নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর প্রধান আইটেম। করোনার জের টানবে বহু মানুষ। স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর হবে বহু পরিবার। ক্ষয়-ক্ষতি পোষাতে নাভিশ্বাস উঠবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের। সবচেয়ে বড় কথা, করোনায় স্থবির বন্দি বছরগুলো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। করোনায় কমে যাওয়া মানুষের গড় আয়ুও হয়তো খুব সহজে আবার বৃদ্ধি পাবে না। বস্তুতপক্ষে, পৃথিবী ও মানুষের জীবন স্পষ্টভাবে বিভাজিত ও পার্থক্যযুক্ত হয়ে যাবে 'করোনার আগে' এবং 'করোনার পরে' শিরোনামে!
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status