প্রথম পাতা

আফগান সংকট

খাদের কিনারায় সার্ক

মিজানুর রহমান

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, বুধবার, ৯:৩৪ অপরাহ্ন

পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে ৩৬ বছর আগে সার্ক নামে দক্ষিণ এশীয় যে জোটের জন্ম হয়েছিল নানা কারণে আজ তা অকার্যকর, মৃতপ্রায়। প্রায় পাঁচ বছর ধরে সার্কের শীর্ষ সম্মেলন হচ্ছে না। সর্বশেষ বিশ্ব রাজনীতির সদর দপ্তরখ্যাত নিউ ইয়র্কের নিরপেক্ষ ভেন্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি রুটিন বৈঠক আহ্বান করা হয়েছিল, কিন্তু মতভিন্নতায় গত সপ্তাহের সেই বৈঠকও বাতিল হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘সহযোগিতা’ দূরে থাক, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পারস্পরিক বৈরিতা আর অবিশ্বাস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আদতে ওই জোট টিকে কি-না? তা নিয়ে উৎকণ্ঠা চরমে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত, বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের ৪ সদস্য রাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পারদে ওঠানামা আছে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তালেবানের ক্ষমতা দখলের কারণে সৃষ্ট আফগান সংকট ৮ জাতি রাষ্ট্রের ওই জোটকে কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, সার্ক জোট ভেঙে যাওয়ার জন্য এটা একটা উপলক্ষ হতে পারে! এমনিতেই বিকল্প সার্ক গড়ার জন্য বহুদিন ধরে নানা কৌশলে এগুচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় বহুমুখী স্বার্থ থাকা দূরপ্রাচ্যের প্রভাবশালী রাষ্ট্র চীন। বাংলাদেশসহ সার্ক জোটের অন্তত ৫টি রাষ্ট্রকে তারা এরইমধ্যে বেশ কাছে নিয়ে নিয়েছে। চীনের লক্ষ্য অবিকল সার্ক গড়া নয়, বরং উন্নয়নের নামে বিকল্প একটি জোট গঠন যা হবে ভারতকে বাদ দিয়ে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ভুটানের সঙ্গে যেহেতু চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এবং থিম্পু অনেকটা দিল্লির ঘনিষ্ঠ ফলে ভুটানের ওই জোটে থাকার সম্ভাবনা নেই। দক্ষিণ এশিয়ার যে সব দেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এ যোগ দিয়েছে তাদেরকে নিয়েই ওই বিকল্প সার্ক গঠনে উদ্যোগী হয়েছে চীন। গত এপ্রিলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও আফগানিস্তান- দক্ষিণ এশিয়ার ওই ৫ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে এক বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই প্রথম এই জোট গঠনের ধারণাটি তুলে ধরেন। সেই ধারণার আলোকে সিরিজ বৈঠকের পর জুলাইতে চীনের চংকিং শহরে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর দারিদ্র্যবিমোচন ও সমবায় উন্নয়ন কেন্দ্র চালু করে চীন। যাকে বিকল্প সার্ক গড়ার প্রথম পদক্ষেপ বলেই মনে করা হচ্ছে। এটাকে এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। যদিও ভারতকে বাদ দিয়ে ওই উদ্যোগ কতোটা সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্যতা নিরসন সংক্রান্ত চীনের উন্নয়ন সেন্টার প্রতিষ্ঠা, যাকে বিশ্লেষকরা সার্কের বিকল্প হিসেবে ভাবছেন- সে সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন অবশ্য মানবজমিনকে বলেছেন, বাংলাদেশ এটাকে চীনের একটি নির্ভেজাল উদ্যোগ হিসেবেই দেখছে। দারিদ্র্যতা থেকে দেশের মানুষকে বের করে আনার ক্ষেত্রে চীন গোটা বিশ্বে অনন্য মডেল- এমন মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপাতত ভারত বাইরে থাকলেও বেইজিং আশা করে শেষ পর্যন্ত তারা এতে যুক্ত হবে। মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে বিশ্লেষকদের মতামতে ভিন্নতা রয়েছে। বাংলাদেশের একাধিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলেছেন দারিদ্র্য দূর করা যদি চীনের ওই উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে ভারত এর বাইরে কেন? তাদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ থাকেন ভারতে। নেপালের চায়না স্টাডি সেন্টারের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত সুন্দর নাথ ভট্টরাই মনে করেন, এটি যে চীনের নেতৃত্বে ‘মাইনাস ইন্ডিয়া’ এতে কোনো সন্দেহ নেই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের বিকল্প সার্ক গড়ার চাপ তো আছেই, জটিল সব সমীকরণে সার্ক সদস্যরা জোটের ভবিষ্যৎকে এতটাই গাঢ় অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে যে মিরাকল কিছু না ঘটলে সেখানে আলোর দেখা পাওয়া অসম্ভব! আফগান সংকট এবং সার্কের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগাম মন্তব্য করতে গিয়ে ঢাকার একাধিক কূটনীতিক বলেন, তালেবানের আচরণে দৃশ্যমান পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করছে তাদের রাজনীতি তথা ক্ষমতার ভবিষ্যৎ। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, এখন পর্যন্ত তালেবানের আচরণে মৌলিক কোনো পরিবর্তন এখনো আসেনি। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান ছাড়া জোটের বাকি ৬ সদস্য তাদের মেনে নেয়ার কোনো কারণ নেই। ফলে সার্কের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আফগানিস্তানকে নিয়ে যে দিনে দিনে সংকট বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সদ্য সমাপ্ত জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনে আফগানিস্তানের কোনো প্রতিনিধি অংশ নেয়ার সুযোগ পাননি। নিউ ইয়র্কে প্রস্তাবিত সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকেও তাদের চেয়ার খালি রাখার পক্ষেই ছিলেন ৬ সদস্য। কিন্তু পাকিস্তান তাতে রাজি হয়নি। তারা তালেবান সরকারের প্রতিনিধির ভার্চ্যুয়াল অংশ চেয়েছিল। আর এতেই বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের কমিটির বর্তমান চেয়ার নেপালকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রায় কোমায় থাকা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা সার্ক-এর আট সদস্য রাষ্ট্রের পাঁচটি আচমকা বেইজিংয়ের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়নি। ভারত-পাকিস্তান বৈরিতায় সার্ক প্রক্রিয়া স্তিমিত হয়ে পড়া সুযোগটি এখানে কাজে লাগিয়েছে বেইজিং। তাদের মতে, বিকল্প সার্ক ধারণা থেকেই বিমসটেকের যাত্রা। নয়াদিল্লিভিত্তিক মনোহর পারিকার ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস-এর রিসার্চ ফেলো নিহার নায়ক মনে করেন- চীন দক্ষিণ এশিয়াকে টার্গেট করেছে বহু আগেই। তারা সার্কের পাল্টা সংস্থা গড়ে তুলতে চাইছে। তাই দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন উদ্যোগের নামে তারা সংযুক্ত হচ্ছে। পাকিস্তান বরাবরই চীনের বন্ধু। যেকোনো উদ্যোগে তারা ইসলামাবাদকে পাশে পাবে- এটা ধরে নেয়াই যায়। কিন্তু যেভাবে চীন প্রথমে আফগানিস্তান এবং পরে বাংলাদেশকে নিশানায় রেখেছে- সেটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ওই দুই দেশের পরেই নেপালের পালা আসবে বলে মনে করে ওই বিশ্লেষক। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট মতে, চীন ২০০৫ সালে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হয়। তারপর থেকে তারা ওই আঞ্চলিক সংগঠনের পূর্ণ সদস্য হওয়ার জন্য চেষ্টা করে। সার্ক উন্নয়ন তহবিলে বেইজিং ৩ লাখ  ডলার অনুদানও  দিয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক ফোরামে চীনের সদস্যপদ নিয়ে ভারতের দীর্ঘ এবং ক্রমাগত আপত্তি বেইজিং তা অর্জন করতে পারেনি। বিশ্লেষকদের মতে, সেই বাধা মেনে নিতে পারেনি চীন। তারা উঠেপড়ে লেগেছে এটা প্রমাণ করতে যে, দক্ষিণ এশিয়া আর ভারতের প্রভাবের ক্ষেত্র নয়। এ জন্য বেইজিং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতার আকর্ষণীয় সব অফার নিয়ে হাজির হয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে সার্কেও। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক আফগান পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, আফগানিস্তানের মতো দেশে জাতিরাষ্ট্র গঠনের ভাবনা এবং যে রাষ্ট্রব্যবস্থা বর্তমানে দেখছি, সেটি অনেক বিচ্ছিন্ন। এখানে নেশন স্টেটস ডেভেলপ করা খুব জটিল। জাতি গঠনের যে ধারণায় যুক্তরাষ্ট্র অভ্যস্ত, এমন উদার একটি কাঠামো সেখানে গঠন করা সম্ভব ছিল না-এটা অনেকেই জানতেন। এটা জহির শাহ পারেননি, আমানুল্লাহ পারেননি, সোভিয়েত আমলে রুশরাও পারেনি। প্রতিবেশী পাকিস্তানের সব সময় একটি বড় ভূমিকা রয়েছে আফগানিস্তানে। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র বুঝে গিয়েছিল, তালেবানের হাতে তাদের ক্ষমতা দিয়ে যেতে হবে। তবে তারা চাইছিল ‘ভালো তালেবানের’ হাতে ক্ষমতা দিয়ে যাবে। কিন্তু এখানেও তারা ভুল করেছে। তালেবানের মধ্যে ভালো-মন্দ বিচারের সুযোগটা কোথায়? সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, যুগ যুগ ধরে তালেবান নিজেদের বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করেছে। মিস্টার হক বলেন, তালেবান যে আদর্শকে আঁকড়ে চার দশক ধরে লড়াই করছে তা থেকে সরে এলে দুর্বল হয়ে পড়বে এই ভাবনা আছে তাদের মাঝে। ফলে মতাদর্শের ভিত্তিতে যে তালেবান গড়ে উঠেছে, তা বদলাবে না বরং বদলালে তা ভেঙে পড়বে। শহীদুল হক মনে করেন ভৌগোলিক ও ভূরাজনৈতিক তিনটি কেন্দ্রের নিরিখে বিষয়টি দেখা যেতে পারে। এর মধ্যে- একটি হতে পারে আফগানকেন্দ্রিক মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া। যেখানে আছে ভারত ও পাকিস্তান। অন্যটি মিয়ানমার, তার প্রতিবেশী চীন, ভারত ও বাংলাদেশ মিলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। শেষটি হচ্ছে বঙ্গোপসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে। এখন প্রথম কেন্দ্রে যদি ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতা বাড়ে এবং আফগানিস্তানে তালেবান স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয়, এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বাড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তার মতে, তালেবানের প্রত্যাবর্তন ভারতের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই তারা চেষ্টা করছে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে। নিরাপত্তা পরিষদে আগস্ট মাসের সভাপতি ভারত ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিয়েছে। তালেবানবিরোধী কোনো ভূমিকায় যায়নি। যেকোনো দেশে ধর্মভিত্তিক কোনো মতাদর্শের প্রত্যাবর্তন বা পুনর্জাগরণ সেটা ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশ যেখানেই হোক- তা প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে, তালেবান রাজনৈতিক কোনো আন্দোলন নয়। এটা আদর্শিক লড়াই। তালেবান রাজনৈতিক দল নয়, এটা একটি আদর্শ, যার হাত ধরে তালেবান ক্ষমতায় এসেছে, এর একধরনের বৈশ্বিক আবেদন আছে। তালেবান প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পর্যন্ত ঠিক আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আগামী দিনে বড় আকারের ঝামেলার জায়গা হচ্ছে আফগানিস্তান। সেই হিসেবে বলা যায়, এটি হচ্ছে ভূ-রাজনীতির একটি নতুন থিয়েটার। যার প্রভাব সার্কসহ সর্বত্র পড়বে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status