মত-মতান্তর

কাওরান বাজারের চিঠি

প্লিজ, সোহেল, অপুদের কথাও একটু ভাবুন

সাজেদুল হক

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, মঙ্গলবার, ১১:৪১ পূর্বাহ্ন

একই বিভাগে পড়তাম আমরা। ছেলেটা আমার বেশ কয়েক বছর পর। পরিচয় ছিল না। ইত্তেফাকেও কাজ করেছে। কাওরান বাজারে, খোরশেদের দোকানে হয়তো কখনও দেখা হয়েছে, হয়তো হয়নি। গতকাল দিনে-রাতে ফেসবুকে তাকে নিয়ে কত লেখা পড়লাম। কত মানুষের কত স্মৃতি। এতো অল্প বয়সে কেন অনাকাঙ্ক্ষিত এক মৃত্যুর পথ বেছে নিলো ছেলেটি। কী গভীর দুঃখ বহন করে চলেছিল সে! আমরা তার খোঁজ নেইনি, নিতে পারিনি। নক্ষত্রের রাত নাটকে আবুল হায়াতের মৃত্যুর পর আসাদুজ্জামান নূর গভীর যন্ত্রণায় বলতে থাকেন, নক্ষত্রের পতন হলো। আজ রাতে একটা নক্ষত্র নিভে গেলো।
এমন নক্ষত্র পতন আমরা দেখছি প্রতিনিয়ত। অকালে ঝরে পড়া মাসুদ আল মাহাদীকে (অপু) নিয়ে যেমন তারই শিক্ষক অধ্যাপক ফাহমিদুল হক লিখেছেন, অপু মেধাবি ছাত্র ছিল, সত্যিকারের মেধাবি। ফলাফল ভালোও করতো। তবে গতানুগতিক ভালো ফলাফল করাদের মতো সে ক্লাসে খুব নিয়মিত ছিল না। সে প্রশ্ন করতো, প্রতিবাদ করতো। ষাটের দশক কিংবা নিদেনপক্ষে আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেসব শিক্ষার্থী নিয়ে গর্ব করতো, যাদের কারণে ছাত্র আন্দোলন বিষয়টা একটা স্বর্ণালী এক রোমান্টিসিজম এখন, অপু ছিল সেধরনের শিক্ষার্থী। অনার্সে সে থার্ড হয়েছিল। অনার্সের রেজাল্টের পর একদিন অপুকে বললাম, মাস্টার্সের এক বছর বাড়তি একটু মনোযোগ দিলেই তুমি প্রথম হতে পারবা। সে বললো, আমি তো প্রথমই হতাম অনার্সে। হিসেব করে দেখেছি, একজন মাত্র শিক্ষক সেই প্রথম বর্ষ থেকে যে পরিমাণ কম নম্বর দিয়ে আসছেন, ওনার কোর্সে এভারেজ নম্বর পেলেই প্রথম হতাম। দীর্ঘ লেখার শেষ দিকে তিনি আরও লিখেছেন, ‘অপু নিশ্চয় শিক্ষক হতে চাইতো। একাই ১০ জন শিক্ষকের কাজ করার মতো ক্ষমতা তার ছিল। কারণ সে পড়তো গভীরভাবে, শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে শেখাতে পারতো, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। কিন্তু সে বা আমি বা অনেকেই জানতো, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়া হবে না। এসময়ে এধরনের কাউকে বিশ্ববিদ্যালয় নেয় না। বিশ্ববিদ্যালয় চায় অনুগত গাধাদের। তবুও আমি চাইতাম তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকুক, তাকে কিছু পরামর্শ তো দেয়া যেত। কিন্তু খবর দিলেও সে আসতো না, ফেসবুকও ডিঅ্যাক্টিভেট করে রেখেছে বহুদিন। বলছিলাম সে সিস্টেমের বঞ্চনার শিকার। সাংবাদিকতার যে অবস্থা, সেখানেও নিশ্চয় সে হতাশ হয়েছে। নিরাপদ চাকরির জন্য সে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তা অপুর স্বভাববিরোধী। তার স্বভাব ধারণ করার একমাত্র জায়গা হতে পারতো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেখানে ঢোকার সুযোগ তার নেই। সে পৃথিবীকে তার নিজের যোগ্য মনে করেনি। তাই সে অন্য কোথাও চলে গেল।’
এটা সবসময়ই আমরা বলি মৃত্যু কোনো সমাধান নয়। একেকটি মানুষের জীবনতো কেবল একার তার জীবন নয়। এ জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও কতগুলো জীবন। অপু হয়তো জীবনের লড়াইয়ে, চাকরির লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ওরা যেন ক্লান্ত না হয়, ইনসাফপূর্ণ একটি প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থার মধ্যে যেন ওরা জীবনের পথ বেছে নিতে পারে সে ব্যাপারে আমরা কী যথেষ্ট কিছু করতে পেরেছি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের একমাত্র যোগ্যতা হওয়া উচিত ছিল মেধা, আমরা কি সেটা করতে পেরেছি। রাজনৈতিক আনুগত্য যে শিক্ষক নিয়োগে প্রধান ভূমিকা রাখছে অনেকদিন ধরে সে ব্যাপারে আমরা কি যথেষ্ট কথা বলছি? অন্যান্য চাকরির ক্ষেত্রেও লিঙ্গ এবং লেনদেন যে ভূমিকা রাখছে তাও কি অস্বীকার করা যাবে।
অপুর মৃত্যুর দিনেই আরেকটি খবর ভাইরাল হয়েছে। রাগে-ক্ষোভে শওকত আলী সোহেল নামে এক ব্যক্তি নিজের মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছেন। স্যানিটারি ব্যবসা ছিল তার। কিন্তু করোনার আঘাত সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়। নয় লাখ টাকা দেনায় পড়ে যান তিনি। একপর্যায়ে মাস দেড়েক আগে মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা শুরু করেন। পাঁচ সদস্যের পরিবারের এটাই ছিল ‘চলার’ বাহন। কিন্তু এখানেও বিপত্তি। অ্যাপে চালালে কোম্পানির বিল দিতে হয় ২৫ পারসেন্ট। তার দাবি, অ্যাপে না চালালে হয় মামলা। অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজকে তিনি বলেছেন, সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাসা থেকে নিজের পুরনো টিভিএস ফ্লেম মোটরসাইকেলটি নিয়ে বের হয়ে যাত্রী নিয়ে গুলশানে যান। লিংক রোডের মোড়ে আরেক যাত্রী তোলার জন্য কথা বলছিলেন। সেই সময়ই পুলিশ এসে তার মোটরসাইকেলের কাগজ চায়। দুই সপ্তাহ আগে মামলা খাওয়ার কথা জানিয়ে আর মামলা না দিতে অনুরোধ করলেও ‘রাইড শেয়ারিং অ্যাপ’ এর পরিবর্তে সরাসরি যাত্রী তোলার অভিযোগে পুলিশ কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে মামলা করতে উদ্যত হন।
পুলিশের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। এটা সত্য, বাইকাররা রাস্তায় বহুক্ষেত্রেই আইন মানতে চান না। বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনাও ঘটে অনেক। কিন্তু আবার করোনাকালে সোহেলের মতো জীবন তছনছ হয়ে যাওয়া বহুমানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য এই মোটরসাইকেলের ওপরই নির্ভর করছেন। এই রাষ্ট্র, সমাজ আমাদের সবারই মানবিক দিক থেকেও এদের বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। শাস্তি না দিয়েও কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় নিয়ম মনযোগী হওয়া উচিত সেদিকে। দেখা প্রয়োজন আইনের প্রয়োগে কোনো অপপ্রয়োগ হচ্ছে কি-না? আমাদের কি উচিত নয় সোহেলের মতো মানুষদের পাশে দাঁড়ানো।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত মানবিক মর্যাদা শব্দযুগল কেবল কথার কথা নয়। যেসমাজে মানবিক মর্যাদা নেই সেটিতো সভ্য সমাজ নয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ঘোষণা করেছে এক মহান জাতির কথাই। আমরা কি সেটা কার্যকর করতে পেরেছি, পারছি?
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status