প্রথম পাতা

ইউনিয়ন ব্যাংকের ভল্টে ১৯ কোটি টাকার গরমিল

৩ কর্মকর্তা প্রত্যাহার তদন্ত কমিটি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ৯:১৩ অপরাহ্ন

ইসলামী শরীয়াহভিত্তিতে পরিচালিত ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় সংলগ্ন গুলশান শাখার ভল্ট থেকে ১৯ কোটি টাকা উধাওয়ের ঘটনা নিয়ে ব্যাংকপাড়ায় তোলপাড় চলছে । বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বিষয়টি প্রকাশ হলেও ব্যাংকটি টাকা উধাওয়ের ঘটনাটি স্বীকার করছে। বলা হচ্ছে- একজন ভিআইপি গ্রাহক এই টাকা উত্তোলন করেছেন আগের দিন। সিস্টেম সার্ভার বন্ধ হওয়ার পর এই টাকা দেয়ায় তা হিসাবে নেই। তবে ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা ব্যাংকটির এই যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে করছেন না। তারা বলছেন, সিস্টেম বন্ধ হওয়ার পর কোনো গ্রাহককে টাকা দেয়ার সুযোগ নেই। আর অতো টাকা তো দেয়ার প্রশ্নই আসে না। এ ছাড়া সেই ভিআইপি গ্রাহকইবা কে যিনি একদিনে এত টাকা তুলেছেন। সিস্টেম বন্ধ হওয়ার পর তাকে কেন টাকা নিতে হয়েছে। এসব প্রশ্নের কোনোটির জবাব আসেনি ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যাখ্যায়।
গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল টাকা উধাওয়ের তথ্য উদ্‌ঘাটন করে। এ ঘটনায় ওই শাখার তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করেছে ব্যাংকটি। একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলেন, নথিতে থাকার হিসাব বা ঘোষণার এক পয়সাও ভল্টে কম থাকার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো গরমিল হয়, তাহলে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে অবহিত করতে হয়। যদি কোনো ব্যাংক সেটি না করে, তবে বুঝতে হবে সেখানে কোনো সমস্যা আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক সূত্র জানায়, গত সোমবার ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখায় পরিদর্শনে গিয়ে ব্যাংকটির ভল্টের হিসাবে গরমিল দেখতে পান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কাগজপত্রে ওই শাখার ভল্টে যে পরিমাণ টাকা থাকার তথ্য রয়েছে, বাস্তবে তারচেয়ে প্রায় ১৯ কোটি টাকা কম পাওয়া যায়। শাখাটির নথিপত্রে দেখানো হয়েছে, ভল্টে ৩১ কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে পেয়েছেন ১২ কোটি টাকা। বাকি ১৯ কোটি টাকার ঘাটতি সম্পর্কে শাখাটির কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলকে যথাযথ কোনো জবাব দিতে পারেননি তারা। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে নানা তৎপরতা শুরু করে শাখা কর্তৃপক্ষ।
নিয়ম অনুযায়ী, ভল্টের টাকার গরমিল থাকলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হয়। কিন্তু ব্যাংকটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ করেনি বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকেও বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হাসান ইকবাল গণমাধ্যমকে বলেন, ব্যাংকিং আওয়ারের পর এক ভিভিআইপি গ্রাহক আসেন। তাকে ভল্টের ওই টাকা দেয়া হয়েছিল, পরে সেই টাকা সমন্বয় করা হয়। তিনি বলেন, ব্যাংকিং রুলস ভায়োলেট হলেও এমন ঘটনা নতুন নয়। গ্রাহক-ব্যাংক সম্পর্কের খাতিরে এমন লেনদেন হয়। তবে সেই ভিভিআইপি গ্রাহক কে তা প্রকাশ করেননি তিনি। বলেন, এ ঘটনায় গুলশান শাখার তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই তিনজনের কাছে চাবি থাকে। এ ছাড়া এ ঘটনায় তিন থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলের উপস্থিতিতেই পরদিন ১৯ কোটি টাকার হিসাব সমন্বয় করা হয় বলে জানান তিনি। সবই যদি ঠিক থাকে তাহলে তিন কর্মকর্তাকে কেন প্রত্যাহার করা হয়েছে  সে প্রশ্নের জবাব অবশ্য ইউনিয়ন ব্যাংকের তরফে দেয়া হয়নি।
এদিকে ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৯-০৯-২০২১ তারিখে লেনদেন শেষে সন্ধ্যার পরে শাখায় একজন গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহক নগদ টাকা নেয়ার জন্য উপস্থিত হন। গ্রাহকের গুরুত্ব এবং ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক বিবেচনায় তার কাছ থেকে চেক জমা রেখে নগদ টাকা প্রদান করা হয়। পরের দিন বাংলাদেশ ব্যাংক অডিট টিমের উপস্থিতিতে গ্রাহকের চেক ডেবিট করে ওই টাকা সমন্বয় করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের অর্থ হারানোর মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তারপরও বিষয়টি তদন্ত করার জন্য ইতিমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, একজন ভিআইপি গ্রাহক ব্যাংকিং আওয়ারের পর গেলে তার লেনদেন করতে ওই টাকা নেয়া হয়েছে। পরের দিন সেই টাকা সমন্বয় করে ব্যাংকটি। তবে তাদের সান্ধ্যকালীন ব্যাংকিং না থাকার পরও ব্যাংক আওয়ার পর লেনদেন আইনবহির্ভূত। এ বিষয়ে আমরা তাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছি। পরে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হবে। অবশ্য ভল্টে কম-বেশি হয়ে গেছে বা হয়ে থাকলে সেটাও ফল্ট। তাই এ ফল্ট যদি কোনো ব্যাংক করে তাহলে রুলস অ্যান্ড রেগুলেটরি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইউনিয়ন ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা জানাতে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাদের জবাব পেলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভল্টের হিসাবে গরমিল বিষয়ে এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিশ্বের কোথাও ভল্ট থেকে টাকা কমে যাওয়া বা বের করে নেয়া সম্ভব নয়। যদি ব্যাংক ডাকাতি হয়, সেটা আলাদা বিষয়। বাংলাদেশের ভল্টে টাকা কমে যাওয়ার ঘটনায় আমানতকারীর আস্থায় চিড় ধরবে। ব্যাংকটি এভাবে টাকা কমে যাওয়ার জন্য যৌক্তিক কোনো কারণ দেখাতে পারবে না। যখন টাকা কমে যাওয়ার ঘটনা ধরা পড়ে, তখনই শাখাটি বন্ধ করে জড়িত ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া উচিত ছিল। তাহলে আমানতকারীরা ভাবতো ব্যবস্থা হচ্ছে। যার হাতে ভল্টের চাবি, সে কেন বিষয়টি আগেই জানালো না। তিনি বলেন, ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের নিচেই গুলশান শাখা। এমন একটি শাখায় যখন এই ঘটনা, তখন বুঝতে হবে প্রধান কার্যালয়ও বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিল। তাই বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখলে হবে না। ইউনিয়ন ব্যাংক প্রচলিত ধারার চতুর্থ প্রজন্মের একটি ব্যাংক। ব্যাংকটি কিছুদিন আগে ইসলামী ধারায় রূপান্তর করা হলো। তাহলে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার নীতিনৈতিকতা কোথায় গেল, এটা বড় প্রশ্ন। মোহাম্মদ নুরুল আমিন আরও বলেন, আগে ভুয়া ঋণ, ভুয়া ঋণপত্রের মাধ্যমে টাকা বের করার ঘটনা অনেক শোনা গেছে, কিন্তু ভল্ট খালি করে ফেলার কথা শোনা যায়নি। এটা মনে রাখতে হবে, চোর ধরতে গিয়ে নিরপরাধ কেউ যেন শাস্তি না পায়। খুঁজে বের করতে হবে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের।
ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড ২০১৩ সালের ১লা এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাংকটির ২০২০ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতই ৪ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। ওই বছর শেষে ব্যাংকটির বিনিয়োগ (ঋণ) ছিল ১৬ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। গত বছর ব্যাংকটি ৯৮ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। গত বছর ব্যাংকটির শাখা ছিল ৯৫টি। এদিকে ব্যাংকটি শেয়ারবাজার থেকে ৪২৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও অনুমোদন পেয়েছে।
এর আগে চলতি বছর ১৭ই জুন ঢাকা ব্যাংকের বংশাল শাখার ভল্ট থেকে চার কোটি টাকা লুট হয়েছিল। কয়েক মাস আগে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক থেকে ব্যাংকটির একজন আইটি অফিসার এক হাজার ৩৬৩টি লেনদেনের মাধ্যমে দুই কোটি ৫৭ লাখ টাকা সরিয়ে নিয়েছিলেন। ঘটনাটি ব্যাংকের অডিটে ধরা পড়ে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status