বিশ্বজমিন

ইকোনমিস্ট-এর পর্যবেক্ষণ: শরীয়া আইন আসলে কী?

মানবজমিন ডেস্ক

২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:০২ পূর্বাহ্ন

সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে শরীয়া আইন অনুযায়ী আফগানিস্তান শাসনের পরিকল্পনা করছে তালেবান। শেষবার যখন এই সংগঠনটি আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল, তখনও ইসলামি আইনের কঠোর প্রয়োগ করেছিল দলটি। গান শোনা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, নারীদের জনসম্মুখে বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। অপরদিকে সৌদি আরব, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া সহ বিভিন্ন দেশেও শরিয়া আইনের বিধান আছে। কিন্তু সেই দেশগুলোতে এত কঠোর বিধিনিষেধ দেখা যায় না। তাহলে প্রশ্ন জাগে, শরীয়া আইন আসলে কী? এটা কিভাবে প্রয়োগ করা হয়?
আরবি ভাষায় শরীয়া বলতে পথ বোঝায়—সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করার আচরণবিধি। এর আওতায় অপরাধ, বাণিজ্য, পারিবারিক আইন সহ সবই রয়েছে। কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ আইনের চেয়ে এই আইনগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে বেশি সংযুক্ত। এছাড়া, মুসলিমদের জন্য নৈতিক নিয়মও ঠিক করে দেয় শরীয়া আইন।
শরীয়া আইন কোরান, হাদিস ও ইসলামি আইনি পণ্ডিতদের কাজের উপর ভিত্তি করে তৈরি। আইনগুলোয় বেশ কিছু কঠোর সাজার বিধান রয়েছে। যেমন, সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধে (হুদুদ) পাথর ছুড়ে মৃত্যু, ব্যভিচারের অপরাধে ১০০ বার কষাঘাত। কিন্তু সাজা কঠোর হলেও, শরীয়া আইনে অপরাধ প্রমাণ করার মানদণ্ড অনেক কঠোর।
এ কারণে সাধারণত এ ধরণের শাস্তি দেখা যায় না। যেমন, ব্যভিচারের ক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার জন্য অন্তত চার জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য প্রয়োজন, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসম্ভব। ‘চোখের বদলে চোখ’ নীতির উপর ভিত্তি করে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের শাস্তিও কঠোর হতে পারে। কিন্তু ইসলাম অনুসারীদের দয়াশীল হতে উৎসাহিত করে। হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে, তাকে খুন হওয়া ব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে উৎসাহিত করে।
শরীয়ার অধীনে পারিবারিক আইনে, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সীমা ও বিয়ের নিয়ম নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত এই আইনের আওতায়, পুরুষরা সর্বোচ্চ চার জন নারীকে বিয়ে করতে পারে। যদিও বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোয় এমন বহুগামিতা অনেকটাই কমে গেছে। এমনকি তিউনেশিয়ার মতো কিছু দেশে এই বিধানই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ব্যভিচার, বিয়ে বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক, পতিতাবৃত্তি এবং পুরুষদের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে শরীয়া আইনে ‘জিনা’ (অবৈধ) হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ধর্মীয় বিয়ে, বা ‘নিকাহ’র ক্ষেত্রে, স্বামী চাইলে একপাক্ষিকভাবেই সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরাও বিচ্ছেদের পদক্ষেপ নিতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের আগে আদালতে পিটিশন দায়ের করতে হয়।
পশ্চিমাদের কাছে শরীয়ার সবচেয়ে অপরিচিত শাখাটি সম্ভবত ব্যবসা করার আইন। আইনগুলো তৈরি করা হয়েছে কোনো ব্যবসার সকল অংশীদারদের মধ্যে ন্যায্যতা ও আস্থার উপর ভিত্তি করে। ইসলামি আইন মোতাবেক, অর্থ ঋণ দেওয়া নিষিদ্ধ। বীমাও নিষিদ্ধ (যদিও সমান ঝুঁকি আছে এমন কিছু তহবিলের অনুমোদন রয়েছে)। অর্থ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই এমন চুক্তি নিষিদ্ধ। জুয়া, শূকর বা মদ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসাও নিষিদ্ধ।
সাধারণত ইসলামি ব্যাংকগুলো কোনো সুদ দেয় না। কিন্তু তাদের কাছে জমা রাখা অর্থ ব্যবহার করে তারা যে লাভ করে, তার কিছু একটি অংশ জমাকারীদের দেওয়া হয় (ঘুরেফিরে অবশ্য তা সুদ দেওয়ার মতোই)। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোয় ব্যাংকিং সংশ্লিষ্ট আইনগুলো কিছুটা শিথিল হয়েছে। কম ঝুঁকিপূর্ণ কিছু বিশেষ চুক্তির আওতায় বিনিয়োগ ও বন্ধকী পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রায় সব ব্যাংকেই একটি করে শরীয়া বোর্ড থাকে যারা ব্যাংকের কার্যক্রম শরীয়া আইনের অধীনে হচ্ছে কিনা তা দেখভাল করে থাকে।
শরীয়া আইনের কিছু অংশ কোরান থেকে নেওয়া হলেও, পুরো ব্যবস্থাটির বেশিরভাগ অংশ, অন্যান্য আইনি কাঠামোগুলোর মতো পরিবর্তনযোগ্য। কিছু দেশ ইসলামি আইনের প্রদর্শনীমূলক কঠোর প্রয়োগ করে থাকে: যেমন, নাইজেরিয়ার কানো রাজ্যে ইসলামি পুলিশ বাহিনী দোকানে মাথাসম্পন্ন মানেকুইন নিষিদ্ধ করেছে, যাতে করে পুতুলগুলো দেখে কারো মনে অযাচিত চিন্তা না আসে। আবার মালয়েশিয়ার মতো কিছু দেশে শরীয়া আইনের প্রভাব আরো নমনীয়।
সবচেয়ে কঠোর ইসলামি সরকারগুলোর ক্ষেত্রে, —যেমন সিরিয়া ও ইরাকে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস, সোমালিয়ায় আল শাবাব, আফগানিস্তানে তালেবানের পূর্ববর্তী সরকার— প্রায়ই শরীয়া আইনের সবচেয়ে কঠোর প্রয়োগ দেখা গেছে।
নতুন তালেবান সরকার অবশ্য আগের চেয়ে কিছুটা সংযমী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে সে প্রতিশ্রুতি কতটা সত্য তা দেখা যাবে তাদের শরীয়া আইন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। তবে আগে এই আইনের অধীনে ছবি তোলা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল তালেবান। এখন অবশ্য তালেবান যোদ্ধারা নিজেরাই ছবি তোলেন। অনেক সময় তা অনলাইনেও পোস্ট করেন।

(দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনূদিত)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status