বিশ্বজমিন

যেভাবে অনলাইন থেকে উধাও চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত তারকা

মানবজমিন ডেস্ক

২০২১-০৯-২৩

ঝাও ওয়েই ছিলেন চীনের রিজ উইদারস্পুন। পরিচালনা করেছেন একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র। পপ তারকা হিসেবে বিক্রি করেছেন লাখ লাখ এলবাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার অনুসারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৬০ লাখের বেশি। বেশকিছু প্রযুক্তি ও বিনোদন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের মাধ্যমে আয় করেছেন বিশাল সম্পদ। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির এক দমন অভিযানের শিকার হয়ে এখন চীনের ইন্টারনেট জগত থেকেই মুছে গেছে তার নাম। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে এমনটা বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, চীনের বড় বড় সব ভিডিও-স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে ঝাও ওয়েই-এর নাম দিয়ে অনুসন্ধান করলে ফলাফল আসে শূন্য। ‘মাই ফেয়ার প্রিন্সেস’ এর মতো জনপ্রিয় টিভি সিরিজ, চলচ্চিত্র ‘সো ইয়ং’ সহ তার করা কাজগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। চীনের ইন্টারনেট থেকে তিনি উধাও হন গত মাসের ২৬ তারিখ। ঠিক কী কারণে তার বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দেয়নি দেশটির সরকার। ঝাও ওয়েই সরকারকে অসন্তুষ্ট করার মতো কোনো কাজ করেছেন কিনা তাও এখনো রহস্যই রয়ে গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটির বিনোদন জগতে অস্বাস্থ্যকর তারকা সংস্কৃতির উত্থান ঠেকাতে কমিউনিস্ট পার্টি যে অভিযান শুরু করেছে, তিনি তারই শিকার হয়েছেন।
চীনা চলচ্চিত্র ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞ, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক স্ট্যানলি রজেন বলেন, ঝাও’কে চীনের তারকা সংস্কৃতিতে বিদ্যমান সমস্যার ‘পোস্টার চাইল্ড’ হিসেবে দেখে কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টি দেখাতে চায় যে, কেউ যত ধনশালী বা জনপ্রিয়ই হোক না কেন, সবার বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। ঝাও ওয়েই’র ঘটনায় সরকারের কাছ থেকে কোন ব্যাখ্যা না আসায়, অন্যান্য তারকারাও ব্যাপক তটস্থ হয়ে উঠবে ও সরকারের লক্ষ্য সাধনে কাজ করবে।
গত সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায় যে, একেবারে সাধারণ পোশাক পরে নিজের জন্মশহর উহু’তে একটি টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের শাখায় গেছেন ঝাও। এরপর থেকে তাকে ঘিরে জনগণের আগ্রহ আরো বেড়েছে। ছবিগুলোর সত্যতা যাচাই করতে পারেনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। ঝাও এবং চীনের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রক ‘’সাইবারস্পেস এডমিনিস্ট্রেশন’র সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া পায়নি পত্রিকাটি।
গত কয়েক সপ্তাহে ঝাও’র পাশাপাশি অন্যান্য আরো অনেক তারকাই কমিউনিস্ট পার্টির রোষানলের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে আছেন, ঝাং ঝেহান। জাপানে এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক বিতর্কিত মঠ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলটির একটি প্রধান পত্রিকা তার সমালোচনা করে।
এসব ছাড়াও, গত মাস থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারকাদের র্যাং কিং নিষিদ্ধ করে দিয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। দলটির রাজনৈতিক ও নৈতিক মানদণ্ডের বাইরে থাকা তারকাদের নিষিদ্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে টিভি, রেডিও ও স্ট্রিমিং চ্যানেলগুলোকে।
অনলাইন থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জনসম্মুখে এখনো কোনো বক্তব্য দেননি ঝাও নিজেও। গত ২৯শে আগস্ট অনলাইনে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন। এরপর ইন্সটাগ্রামে এক বার্তা পোস্ট করে ঝাও জানান যে, তিনি বেইজিংয়ে আছেন। কিন্তু ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই বার্তাটি সরিয়ে ফেলা হয়।
ঝাও’র পরিস্থিতি নিয়ে চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় আলোচনার ঝড় তৈরি হয়েছে। একদল তার বর্তমান অবস্থার সঙ্গে অভিনেতা ঝাং’র সম্পর্ক তুলে ধরেছে। ঝাও’র মালিকানাধীন এজেন্সিতে কাজ করতেন ঝাং। ওয়েইবুসহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম থেকে ঝাও’র নাম মুছে যাওয়ার পর তার ভক্তরা অন্যান্য মাইক্রোব্লগে তার পক্ষে পোস্ট করেছেন।
টাফ পি স্প্রাউট নামের এক একাউন্ট থেকে বলা হয়েছে, সরকার তার রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে যেকোনো নেটিজেনের চেয়ে বেশি অবগত। ওই পোস্টে ঝাও যোগ দিয়েছেন এমন বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অনুষ্ঠানের কথাও উল্লেখ করা হয়। যেমন, ২০১৩ সালে এক অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পার্ক গিয়ুন-হাই’র সঙ্গে ঝাও’কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
অনেকে আবার ঝাও’র পরিস্থিতির সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন ২০১৮ সালে বিখ্যাত তারকা ফ্যান বিংবিং’র উধাও হওয়ার ঘটনার। হলিউডের এক্স-মেন চলচ্চিত্র সিরিজে অভিনয় করা ফ্যান ২০১৪ সালে কর ফাঁকির অভিযোগের মুখে তিন মাসের জন্য জনসম্মুখ থেকে আড়াল হয়ে যান। এরপর আবার প্রকাশ্যে এসে ক্ষমা চান ও ৭ কোটি ডলার জরিমানা দেন।
বহুদিক দিয়েই ফ্যানের চেয়ে অনেক বড় মাপের তারকা ঝাও। ১৯৯৮ সালে মাই ফেয়ার প্রিন্সেস টিভি সিরিজে অভিনয় দিয়ে বিনোদন জগতে পা রাখেন তিনি। এরপর থেকে অসংখ্য টিভি সিরিজ, চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন এই চীনা তারকা। সঙ্গীতশিল্পী হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত রয়েছে তার। চলতি শতকের প্রথম দশকের শেষের দিকে আবাসন ব্যবসায়ী হুয়াং ইউলংকে বিয়ে করেন। এরপর ব্যবসা জগতেও পরিচিত হয়ে উঠেন ঝাও। বিভিন্ন প্রযুক্তি ও বিনোদন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেন। ২০১৫ সালে তার ও তার স্বামীর মোট সম্পদের পরিমাণ শ’ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।
বিভিন্ন সময়ে ঝাও’কে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা বিতর্কও। ২০০১ সালে এক ফ্যাশন শো’তে জাপানের যুদ্ধকালীন পতাকা সম্বলিত পোশাক পরে চীনা গণমাধ্যমের রোষানলে পড়েন। ২০১৬ সালে তার পরিচালিত এক চলচ্চিত্র থেকে বাদ দিতে হয় এক তাইওয়ানিজ অভিনেতাকে। ওই অভিনেতা চীন থেকে তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিলেন। এর পরের বছর বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে চীনের শেয়ার বাজার থেকে পাচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি ও তার স্বামী। যদিও ঝাও দাবি করেন যে, তিনি কোনো অপরাধ করেননি। তার স্বামীও জানান যে, সজ্ঞানে কোনো অবৈধ বা অনৈতিক উপায় অবলম্বন করেননি তিনি।
অনলাইন থেকে তার গুম হওয়ার পর বেশকিছু চীনা রাষ্ট্র-পরিচালিত গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে এক পত্রিকার সাবেক সম্পাদকের লেখা একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। ওই নিবন্ধের মাধ্যমে, ঝাও যে তারকাদের বিরুদ্ধে চীন সরকারের দমন অভিযানের শিকার হয়েছেন সে ধারণা আরো জোর পায়। নিবন্ধ অনুসারে, চীনের বাড়ন্ত আর্থিক বৈষম্য দূর করতে এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে শি সরকার।
নিবন্ধটিতে আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা’র সঙ্গে ঝাও’র সম্পর্ক টানা হয়েছে। প্রযুক্তি খাতে চীন সরকারের চলমান অভিযানের মুখ্য টার্গেট ছিলেন জ্যাক। নিবন্ধ অনুসারে, ঝাও’র সঙ্গে জ্যাকের বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি, ঝাও’র সম্পদের অনেকটাই এসেছে আলিবাবা-মালিকানাধীন একটি বিনোদন প্রতিষ্ঠান থেকে। চীনের প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের উপাত্ত অনুসারে, ২০১৬ থেকে ২০২০ এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে জ্যাক মা-সমর্থিত ইয়ুনফেং ক্যাপিটালের আওতায় থাকা এক তহবিলের শেয়ার কিনেছেন ঝাও। এছাড়া, জ্যাকের অর্থায়ন করা প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যান্ট গ্রুপেও শেয়ার রয়েছে ঝাও’র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এক পরিচালকের।
ঝ্যাং নামে ঝাও’র এক ভক্তের বিশ্বাস, ঝাও’র অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে ইন্টারনেট থেকে মুছে ফেলার মতো বড় শাস্তি দেওয়া হয়নি। গত বুধবার তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি দেখতে পেয়ে খুশিই হয়েছেন ওই ভক্ত।
ঝ্যাং বলেন, তিনি যেহেতু এখনো প্রকাশ্যে বের হতে পারছেন তার মানে তিনি বড় কোনো সমস্যায় পড়েননি। তবে ঠিক কী কারণে তাকে অনলাইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সে বিষয়ে ব্যাখ্যার অপেক্ষায় আছি।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status