শেষের পাতা

রানী ও ফাতেমার আত্মহত্যা

পরিবারে ঝগড়া লেগেই থাকতো

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:০৭ অপরাহ্ন

নিজ বাসায় নির্যাতিত হতেন সিলেটের গলায় ফাঁস দিয়ে মারা যাওয়া দুই বোন রানী ও ফাতেমা। দিন দিন নির্যাতনের মাত্রাও আরও বেড়ে গিয়েছিল। প্রায়ই তাদের ঘর থেকে ভেসে আসতো আর্তনাদের সুর। কিন্তু ভয়ে কেউ ওই বাসাতে যেতেন না। যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতো তখন কাউন্সিলরসহ এলাকার লোকজন গিয়ে হস্তক্ষেপ করতেন। মাসে দু’একবার পারিবারিক ঝগড়া ও দুই বোনকে নির্যাতন নিয়ে বিচার-সালিশ হতো তাদের বাসায়। মজুমদারী এলাকার স্থানীয় লোকজন ও এলাকার জনপ্রতিনিধারা জানিয়েছেন- তাদের পারিবারিক ঝগড়ার অন্ত ছিল না। সম্পত্তিসহ নানা কারণে তাদের মধ্যে বিরোধ লেগেই থাকতো। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় দা হাতে রানী ও ফাতেমাকে দৌড়ে চাচার বাসায় আশ্রয় নিতে দেখেছেন তারা। চাচার বাসাতে গিয়ে তারা এশার নামাজ আদায় করেছে। রাতে তারা চাচার বাসা থেকে নিজ বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়েও এসেছিলো।
সিলেটের মজুমদারী এলাকার ৩১ নম্বর বাসার মৃত কলিম উল্লাহর মেয়ে রানী বেগম ও ফাতেমা বেগম। বিয়ের বয়স অনেক আগে পেরিয়ে গেলেও পছন্দের বর না পাওয়ায় বিয়ের পিঁড়িতে বসেনি রানী বেগম। ফাতেমাও স্নাতক শেষ করলেও তার বিয়ে নিয়ে পরিবারের দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু পারিবারিক ভাবে মা ও দুই ভাই রাজন ও সুজনের সঙ্গে তাদের বিরোধ ছিল। প্রায় সময় মা ও ভাইদের সিদ্ধান্ত মানতেন না রানী ও ফাতেমা। এ নিয়ে তাদের পরিবারে ঝগড়া লেগেই থাকতো। এসব ঝগড়া নিয়ে এলাকার মানুষ ছিল ত্যক্ত-বিরক্ত। কারণ- বিচার সালিশে গিয়ে অনেক সময় তারাও হয়েছেন নাজেহাল। এ কারণে ভয়ে তাদের বাসায় বিচার-সালিশে কেউ যেতেন না। এমনকি এলাকায় বসবাস করলেও চাচা তাদের পারিবারিক বিষয়ে সম্পৃক্ত হতেন না। স্থানীয় ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী মানবজমিনকে জানিয়েছেন- রানী ও ফাতেমার পরিবারের মধ্যে বিরোধের শেষ ছিল না। তিনিও অনেক বার বিচার সালিশে গেছেন। তাদের সবাইকে বুঝিয়ে বিরোধ শেষ করার চেষ্টা চালিয়েছেন। বুঝিয়ে-শুনিয়ে সবাইকে এক করে এলেও শেষে ফের তাদের পুরনো বিরোধ আবার শুরু হতো। তিনি জানান- তাদের পারিবারিক ছাড়াও সম্পত্তি নিয়ে, বাড়ির বাউন্ডারি দেওয়াল নিয়ে নানা সময় বিরোধ ছিল। এসব বিরোধের নিষ্পত্তিও তিনিসহ এলাকার মানুষ বসে শেষ করে দিয়েছিলেন। এরপরও বিরোধ লেগেই থাকতো। ওই পরিবার এলাকার মধ্যে ‘আইসোলেটেড’ পরিবার ছিল বলে দাবি করেন তিনি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- মৃত কলিম উল্লাহর ৫ মেয়ে ও দুই ছেলে। এরমধ্যে বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। রানী, ফাতেমা ছাড়াও তাদের আরও এক বোন রয়েছে। দুই ভাই রাজন ও সুজন এখনো বিয়ে করেনি। বোনদের বিয়ে দিয়ে তাদের বিয়ে করার কথা। তাদের পরিবারের মধ্যে রানী ও ফাতেমা ছিল এক পক্ষ। অন্যরা সবাই ছিলেন এক পক্ষে। রাগ বেশি ছিল বড় বোন রানীর। বিয়ে নিয়ে পছন্দ, অপছন্দ ছিল তার। একমাত্র রানীর বিয়ে না হওয়ার কারণে অন্যদের বিয়ে দেয়া যাচ্ছিলো না। কিন্তু রানী বেশি রাগী হওয়ার কারণে তার সঙ্গে পেরে উঠতে পারছিলো না কেউ। গত সোমবার বিকাল থেকে রানীর বিয়ের কথাবার্তা নিয়ে ফের ঝগড়া শুরু হয়। আর এই ঝগড়ার জের ধরে তাদের মধ্যে মারামারি হয়। একপর্যায়ে চাচার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলো রানী ও ফাতেমা। রাতে তারা চাচার বাসা থেকে বেরিয়ে এলেও বাসায় ফেরেনি। পরদিন মঙ্গলবার সকালে বাড়ির ছাদের সঙ্গে তাদের দুই বোনের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- গত মঙ্গলবার বিকালে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে দুই বোনের মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। এরআগে পুলিশ লাশ দুটিকে পরীক্ষা করে। এতেও কোনো আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। কেবলমাত্র দুই বোনের গলায় ফাঁস লাগার চিহ্ন ছিল। সিলেটের এয়ারপোর্ট থানার সহকারী কমিশনার মো. মফিজুর রহমান মানবজমিনকে জানিয়েছেন- দুই বোনের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। এর থেকে ধারণা করা হচ্ছে; তারা আত্মহত্যাই করেছেন। পুলিশ এখন তাদের পারিবারিক বিষয় নিয়েও তদন্ত করছে। যদি সেখানে গলদ থাকে তাহলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি জানান- পরিবারের মানুষের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ আছে। তারা অনেকটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করে। সব বিষয় মাথায় নিয়ে পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে বলে জানান তিনি। এদিকে- মারা যাওয়া দুই বোনের ভাই শেখ রাজন আহমদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- ‘মায়ের সঙ্গে ওরা প্রায়ই ঝগড়া করে। গত সোমবার ঝগড়া করে তারা চাচার বাসায় চলে যায়। প্রায়ই ঝগড়া হলে এভাবে চাচার বাসায় চলে যায়, সেখানে থেকে আসে। আমরা ভেবেছি, চাচার বাসা থেকে তারা সকালে আসবে। এই পর্যন্ত আমাদের শেষ।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status