মত-মতান্তর

এশিয়ার পূর্বপ্রান্তে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা

ড. মাহফুজ পারভেজ

২২ সেপ্টেম্বর ২০২১, বুধবার, ১:৪১ অপরাহ্ন

নতুন নতুন জোট তৈরি ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের প্রসারের ফলে এশিয়ার পূর্বপ্রান্তে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা বাড়ছে। প্রশান্ত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের এসব নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে সামরিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং ভূ-কৌশলগত নানা মাত্রা।

আগে থেকেই চীন সেখানে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে চলছিল। যার প্রতিক্রিয়ায় গঠিত হয় 'কোয়াড'। এতে একজোট হয়েছিল আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান। কোয়াডভুক্ত দেশগুলো আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন ডিসিতে তাদের কৌশল নির্ধারণী আলোচনায় বসছে। এতোসব আয়েজনের মধ্যেই মধ্য সেপ্টেম্বরে গঠিত হয়েছে আরেক নতুন সামরিক জোট। আমেরিকা, বৃটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে নতুন নিরাপত্তা চুক্তিতে গঠিত জোটের নাম 'অকাস' (AUKUS), তিনদেশের অদ্যাক্ষর দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে নবগঠিত জোটের।

ত্রিদেশীয় এই 'অকাস' চুক্তির কারণে আসন্ন 'কোয়াড' জোটের আলোচনার গুরুত্ব যেমন বহুগুণে বেড়েছে, তেমনি এশিয়া-প্যাসিফিকের জিওপলিটিক্স বা ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্যও বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত, কাবুল থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিমত্তা নিয়ে যে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, তা এখন অনেকটাই দূরীভূত। বরং যুক্তরাষ্ট্র তার শক্তির খেলাটি এখন কোথায় দেখাবে, তা-ই অনেক বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমেরিকা, বৃটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে নতুন নিরাপত্তা চুক্তি 'অকাস' নিয়ে প্রতিক্রিয়া হয়েছে তীব্র। চীন রাখঢাক না করেই নিজের অসন্তুষ্টি জানিয়েছে। নিন্দা জানিয়েছে উত্তর কোরিয়াও। বলছে, 'এই চুক্তি পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা করবে।' উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, 'অকাস চুক্তি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর এলাকার কৌশলগত ভারসাম্য নষ্ট করবে।'

কেন 'অকাস' নিয়ে এই তীব্র প্রতিক্রিয়া ও বাদানুবাদ, তা চুক্তির বিষয়বস্তুর দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। কারণ, এই চুক্তির অধীনে আমেরিকা এবং বৃটেন অস্ট্রেলিয়াকে পরমাণু শক্তি চালিত সাবমেরিন তৈরির প্রযুক্তি দেবে। 'অকাস' চুক্তির ঘোষণায় আরও বলা হয়, 'এই চুক্তিতে ক্রুস ক্ষেপণাস্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং অন্যান্য প্রযুক্তিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।'

উল্লেখ্য, এই চুক্তির মাধ্যমে ৬০ বছরের মধ্যে প্রথম বারের মত আমেরিকা তাদের অগ্রসর ডুবোজাহাজ প্রযুক্তি অন্য দেশের সাথে শেয়ার করছে। এর আগে মাত্র একবার আমেরিকা এই প্রযুক্তি বৃটেনের সাথে শেয়ার করেছিল। ফলে এই 'অকাস' চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকার সাহায্যে অস্ট্রেলিয়া নিজেরা পরমাণু শক্তি চালিত সাবমেরিন তৈরি করতে পারবে, যা হবে অনেক দ্রুত গতিসম্পন্ন। এছাড়াও সাবেকী ধরনের সাবমেরিনের মত এগুলোর উপস্থিতি সহজে নির্ণয় করা যাবে না। এধরনের ডুবোজাহজ বহু মাস ধরে পানির নিচে ডুবে থাকতে পারবে এবং দূর-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে পারবে। তবে অস্ট্রেলিয়া বলছে এই সাবমেরিনে পারমাণবিক অস্ত্র বহন করার কোন আকাঙ্ক্ষা তাদের নেই।

'অকাস' নিরাপত্তা চুক্তি ঘোষণার সময় সরাসরি চীনের কোন উল্লেখ করা হয়নি। তবে চুক্তির অংশ তিনটি দেশের নেতারা আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা বারবার উল্লেখ করে বলেছেন, এই উদ্বেগ 'ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে', যা চীনকে ইঙ্গিত করে।

চীনও এই চুক্তির তীব্র সমালোচনা করেছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেছেন, এই জোট ওই এলাকায় 'আঞ্চলিক শান্তি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতা আরও তীব্র করার' ঝুঁকি তৈরি করেছে।

চীনের সাথে সুর মিলিয়ে পিয়ংইয়ং বলছে, 'এটা খুবই স্বাভাবিক যে চীনের মত প্রতিবেশি দেশগুলো এই পদক্ষেপের নিন্দা জানাচ্ছে, কারণ এই পদক্ষেপ এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা ধ্বংস করার জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন একটা সিদ্ধান্ত।' এই পদক্ষেপকে চীন দেখছে বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাব মোকাবেলার একটা প্রচেষ্টা হিসাবে। 'এটা অত্যন্ত অনভিপ্রেত এবং বিপদজনক একটা পদক্ষেপ, যা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার কৌশলগত ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং এর ফলে একটা ধারাবাহিক পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা হবে,' এই নিরাপত্তা চুক্তির বিষয়ে মন্তব্যকালে বলেন গণপ্রজাতন্ত্রী উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।

প্রসঙ্গত, আমেরিকার মিত্র ফ্রান্সও 'অকাস' চুক্তি নিয়ে সমালোচনা করেছে। কারণ এর ফলে ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত ৩৭ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি বাতিল হয়ে যায়, যে চুক্তি অনুযায়ী ফ্রান্স অস্ট্রেলিয়ার জন্য ১২টি সাবেকী ধরনের সাবমেরিন তৈরির কথা ছিল। ফ্রান্স বলছে, এই চুক্তির প্রকাশ্য ঘোষণা দেবার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তাদের বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হয়। ফ্রান্স এই চুক্তিকে 'পিঠে ছুরি মারা' বলে উল্লেখ করে বলেছে, 'এই চুক্তি মিত্র দেশগুলোর মধ্যে একটা গুরুতর সঙ্কট সৃষ্টি করবে।'

'কোয়াড', 'অকাস' ইত্যাদি পশ্চিমা সামরিক তৎপরতার মুখে মোটেও বসে নেই চীন। সমুদ্র ক্ষেত্রে নিজের সামর্থ্যের জানান দিতে চীন তার নৌবহর ও সামরিক শক্তিকে আরও গতিশীল করতে উদ্যোগ নিচ্ছে নিয়মিত মহড়া ও টহলের মাধ্যমে। এদিকে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে উত্তর কোরিয়া দুটি বড় ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালায়। এর একটি ছিল দূর-পাল্লার ক্রুস ক্ষেপণাস্ত্র এবং অন্যটি ছিল একটি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।

সামরিক তৎপরতা ও রাজনৈতিক মেরুকরণের একের পর এক প্রচেষ্টা স্বাভাবিকভাবেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় ও দক্ষিণ চীন সাগরে চাপা দ্বন্দ্বের আভাস দিচ্ছে। আমেরিকা ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক ও কর্তৃত্বের লড়াই ঘিরে যে সুপ্ত স্নায়ুযুদ্ধ বিরাজমান, সেটাও টানটান উত্তেজনাকর অবয়ব নিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর এবং সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবীর এ প্রসঙ্গে আলাপকালে বলেন, 'এটা ঠিক যে এশিয়ার পূর্বপ্রান্তে উত্তেজনা বাড়ছে। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে বিরাজমান সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির মতো দূরপ্রাচ্যেও তেমন অবস্থা তৈরি হয় কিনা সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে সেখানকার ঘটনাপ্রবাহের গতিধারা একটি স্পষ্ট মেরুকরণের ইঙ্গিতবাহী। সেখানে দ্রুত ঘটমান সামরিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রপঞ্চের গতি-প্রকৃতির নিরিখে অচিরেই পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র সামনে চলে আসবে। আমরা সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজের তরফে পুরো পরিস্থিতির বহুমাত্রিক দিকগুলোর উপর রাখছি।'
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status