শেষের পাতা

ঝরে পড়বে কতো শতাংশ শিক্ষার্থী?

পিয়াস সরকার/ফাহিমা আক্তার সুমি

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, শনিবার, ৯:১৫ অপরাহ্ন

দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি ক্লাসে ফিরেছে শিক্ষার্থীরা। তবে ঝরে পড়া অনেক শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফিরবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে- ফাইল ছবি

নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার আদর্শ গার্লস হাইস্কুল। প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত এই স্কুলের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। স্কুলে মোট শিক্ষার্থী ৫৫৯ জন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪০ শতাংশই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। প্রধান শিক্ষক হামিদুর রহমান জানান, স্কুল খুললেও এখনো সবার ক্লাস শুরু হয়নি। সবাই যখন ক্লাসে আসবে তখন হয়তো ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। যাদের অধিকাংশই বিয়ে হয়ে গেছে কিংবা ঢুকে পড়েছে কাজে। কুড়িগ্রামের সারডোবা উচ্চ বিদ্যালয়ে এক ক্লাসে ৯ জন ছাত্রী। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন করোনায় বন্ধ হয় স্কুল। দেড় বছর পর খুলেছে স্কুল। কিন্তু ক্লাসে ফিরেছে মাত্র একজন। বাকি সবার বিয়ে হয়ে গেছে। শহরাঞ্চলে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হলেও গ্রামাঞ্চলে এই চিত্র প্রকট। লালমনিরহাটের আরেক স্কুল পাটগ্রাম পৌর জুনিয়র গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৩২৯ জন। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. রবিউল ইসলাম রবি বলেন, এক সপ্তাহ না গেলে বোঝা যাবে না কতো শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রথম তিনদিনের হিসাবে ১০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থীর বিয়ের খবর শুনেছি। ৩০ জনের ওপর হবে এই সংখ্যা। সবাই ক্লাসে আসার পরই জানা যাবে আসল চিত্র।

কাকনহাট গার্লস হাইস্কুলে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার আশঙ্কা করছেন প্রধান শিক্ষক মো. এজাজুল হক। বলেন, এখন পর্যন্ত ক্লাসে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আসছে। ঝরে পড়েছে কতো শিক্ষার্থী তা জানা নেই। এক সপ্তাহ ক্লাসের পর জানা যাবে। তিনি বলেন, আমরা স্কুল থেকে বাল্যবিবাহ ঠেকানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ফলে শিক্ষার্থীদের বিয়ে হলে আমরা জানতেও পারি না। স্কুল খোলার সপ্তাহখানেক আগেও ২/৩ জন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার এই শিক্ষক বলেন, আমরা বিবাহিত মেয়েদের স্কুলে আসার জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু সাড়া মিলছে না।
উত্তরাঞ্চলের এনজিওকর্মী সানজিদা ইসলাম কাজ করেন নারী শিক্ষা নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী তিন বছর ধরে কাজ করছেন এই এলাকায়। তিনি বলেন, এসব গ্রামে শুধুমাত্র উপবৃত্তির টাকার জন্য মেয়েরা লেখাপড়া করতো। করোনাকালীন সময়ে পারিবারিক আয় কমে যাওয়া ও মেয়েরা দীর্ঘ সময় ঘরে বসে থাকার ফলে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। তিনি বলেন, আগে শিক্ষার্থীদের বিয়ে বন্ধে প্রশাসনের ভালোই চাপ ছিল। কিন্তু করোনা মহামারিকালীন এসবের তোয়াক্কা করেনি কেউ। ফলে বেড়েছে বাল্য বিয়ে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাগাইছড়ি, রাঙ্গামাটির রূপালী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ব্রামা কুমার চাকমা বলেন, আমার স্কুলের উপস্থিতি ৯০ শতাংশের ওপরে। আশা করছি সকলেই ক্লাসে ফিরবে।

পটুয়াখালীর বগা উপজেলার বগা ইউনিয়ন সেকেন্ডারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলামও শতভাগ উপস্থিতির আশা করছেন। তিনি বলেন, আমি আশাবাদী আমার স্কুলের সবাই ফিরবে। এখন উপস্থিতি ৯৫ শতাংশ। যারা স্কুলে আসছে না তাদের খোঁজ নেয়া হচ্ছে প্রতিদিন।

প্রায় দেড় বছর পর খুলেছে স্কুল-কলেজ। উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অপেক্ষাটা একটু বেশি। এই দীর্ঘ বিরতিতে অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে গেছে শিক্ষাঙ্গন থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ২০ থেকে ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে। সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়ম অনুযায়ী সপ্তাহে একদিন করে আসছে শিক্ষার্থীরা। তাই এক সপ্তাহ যাওয়ার পরই জানা যাবে কতো শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঝরে পড়ার আশঙ্কা করা হলেও ভিন্ন চিত্র দেখা যায় রাজধানীর স্কুল-কলেজগুলোতে। ক্লাস শুরুর পঞ্চম দিনে এসেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম। অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সংখ্যা কম হওয়ায় দুশ্চিন্তায় প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা।

পশ্চিম তেঁজতুরী বাজারের অ্যাঞ্জেলস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক উপেন্দ্রনাথ বাড়ৈ বলেন, হয়তো আর এক সপ্তাহ ক্লাস করলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়তে পারে। স্কুল মাত্র খুলেছে এইজন্য অভিভাবকরা মনে হয় একটু আতঙ্কের মধ্যে আছেন যদি ছেলে-মেয়েরা করোনা সংক্রমিত হয়। ২৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি ছিল। এখন ৪০-৪৫ শতাংশ স্কুলে আসছে। তারপর এই বছর এমনিতে স্টুডেন্ট ভর্তি কম হয়েছে। ভর্তির সময়টা তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে মনে করছে এই তিন-চার মাস আর ক্লাস করার দরকার কি? প্রথমদিনে খুব একটা উপস্থিতি ছিল না। স্কুলে অনেকের বকেয়া জমা হয়ে আছে। অনেকে সমস্যার মধ্যে থেকে এগুলো পরিশোধ করবে কীভাবে এই মনে করে আসছে না। কেউ কেউ বলছেন আরও এক সপ্তাহ দেখি কি অবস্থা হয়।

মর্নিং গ্লোরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র হালদার বলেন, আমরা শুরু থেকেই খুব সমস্যার মধ্যে আছি। বছরের শুরুতে যখন নতুন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হবে তখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে আমরা কোনো ছাত্রছাত্রী পাইনি। যেটা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পেয়েছে। আমাদের সবমিলিয়ে ৫০ জনের মতো স্টুডেন্ট আছে। স্কুল খোলার প্রথমদিনে ১০-১২ জন শিক্ষার্থী আসছে স্কুলে। চতুর্থ দিনে ১০-১৫ জনের মতো শিক্ষার্থী আসছে। স্কুলের পক্ষ থেকে অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বিভিন্ন কারণ দেখান। কোনো শিক্ষার্থী আমার স্কুল থেকে যাতে ঝরে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখছি। আমরা খুব কষ্ট করে টিকে আছি। ঠিকমতো বাড়ির মালিককে ভাড়া পরিশোধ করতে পারিনি। শিক্ষকদের বেতন দেয়া হয়নি। তবুও তারা এই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাননি।

গভর্নমেন্ট সায়েন্স হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রহিমা আক্তার বলেন, প্রথম দিনে উপস্থিতি অনেক ভালো ছিল। দ্বিতীয় দিনে প্রথম দিনের তুলনায় কম ছিল। প্রথম দিন উপস্থিত ছিল ৮০ শতাংশ, দ্বিতীয় দিন ৭৯ শতাংশ এবং তৃতীয় দিনও ৭৯ শতাংশ। চতুর্থ দিনে এসে মনে হয় আরেকটু কম উপস্থিতি হবে। আমরা প্রতিটি শাখাতে দুইটি ভাগ করেছি। আমাদের প্রত্যেক শ্রেণিতে ৬০ জন করে স্টুডেন্ট আছে।
মিরপুর মেধা সিঁড়ি প্রি-স্কুলের কো-অর্ডিনেটর জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, সঞ্চয় যা ছিল সব শেষ। এখন লোন নিয়ে স্কুল টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। ৯ বছর হলো এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু করি। এরমধ্যে এত বিপদের সম্মুখীন কখনো হয়নি। চোখেমুখে শুধু হতাশা দেখছি। করোনার আগে ছাত্রছাত্রী ছিল প্রায় ১৫০-এর মতো। আর এখন সবমিলিয়ে ৩০-৪০ জন আছে। স্কুল খোলার প্রথম দিনে খুব একটা উপস্থিতি ছিল না। ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত হয়েছে। অভিভাবকদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেকে ভয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। কেউ কেউ চাকরি হারিয়ে অভাবে আছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status