দেশ বিদেশ

প্রবাসী কল্যাণ ভবনে ভিড়

রুদ্র মিজান

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ৯:২৯ অপরাহ্ন

নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন তারা। সকাল গড়িয়ে দুপুর। প্রবাসী কল্যাণ ভবনের সামনে ফুটপাতে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন। কেউ কেউ চা, শিঙাড়া খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে। নানা দুর্ভোগের শিকার হয়ে এখানে এসেছেন তারা। কেউ কেউ স্বজনের খোঁজ করতে এসেছেন। ভিনদেশে কারাবন্দি স্বজন। কেউ এসেছেন বিদেশে মারা যাওয়া স্বজনের লাশ দেশে আনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। বিদেশের মাটিতে করুণ, কঠিন নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন অনেকে। তাছাড়া অনেকেই এসেছেন নিজেদের ভাগ্য বদল করতে।
গত ২রা আগস্ট সৌদি আরবে মারা যান হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জের মেয়ে সাজনা বেগম। স্বজনদের অভিযোগ সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন তিনি। গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন সাজনা। মৃত্যুর আগে দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। এজন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানি দাবি করেছিলো দুই লাখ টাকা। দরিদ্র পরিবারের পক্ষে সেই টাকা দেয়া সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে তাকে। সাজনার মৃত্যুর ২৪ দিন পর পরিবার জানতে পেরেছে সাজনা আর নেই। সাজনার লাশটি এখনো সৌদি আরবের হিমঘরে। মৃত্যুর খবর জানার পর থেকে প্রবাসী কল্যাণ ভবনসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আসা-যাওয়া করছেন সাজনার স্বজনরা। সাজনার স্বামী মিজানুর রহমান জানান, সরকারের কাছে কিচ্ছু চাই না। শুধু সাজনার লাশটি দেখতে চাই, দেশের মাটিতে দাফন করতে চাই। রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স কনকর্ড অ্যাপেক্সে (আর.এল-৯৮৪)’র মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবে যান হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার কুর্শি ইউনিয়নের এনাতাবাদ গ্রামের সাজনা বেগম।
অসুস্থ মালয়েশিয়াতে মারা যাওয়া স্বজনের লাশ দেশে আনতে চেষ্টা করছেন চাঁদপুরের আব্দুল্লাহ। যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করেছেন। গত এক সপ্তাহ যাবৎ প্রায় প্রতিদিনই আসা-যাওয়া করছেন প্রবাসী কল্যাণ ভবনে। কিন্তু এখনো ব্যবস্থা হয়নি। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন দ্রুতই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যথাযথ প্রক্রিয়ায় লাশ দেশে আনা হবে।
ভাগ্য বদল করতে যারা দিনভর ওই ভবনে ও আশপাশে ছিলেন তাদেরই একজন স্মৃতি বেগম। এসেছেন লালমনিরহাট থেকে। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে স্মৃতি দু’দিন ধরে রাজধানীস্থ পরীবাগের প্রবাসী কল্যাণ ভবনে আসা-যাওয়া করছেন। উদ্দেশ্য জর্ডানে যাবেন। সরকারিভাবে জর্ডানে যেতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। এখন ইন্টারভিউ’র জন্য অপেক্ষা। অবশেষে গতকাল ইন্টারভিউ দিতে পেরেছেন। স্মৃতি জানান, ইন্টারভিউ দিতে পেরে ভালো লাগছে। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। শিখেছেন ভাষাসহ নানা কিছু। ইন্টারভিউয়ে মূলত এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। স্মৃতি আশা করছেন শিগগিরই জর্ডানে যেতে পারবেন। কিন্তু আশাহত চাঁদপুরের তরুণী রাহিমা আক্তার। জর্ডানে দুই বছর ছিলেন তিনি। করোনার কারণে গত বছরে দেশে ফিরেছেন। গত মে মাসে যেতে চেয়েছেন। সবকিছু ঠিকটাক ছিল। ভিসা ছিল। বিমানের টিকিটও করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ভিসা বাতিল হয়ে যায় তার। কারণ হিসেবে জানতে পেরেছেন, পুরাতন নারী কর্মীদের নেবে না সেখানকার কোম্পানি। নতুন নারী কর্মী চান তারা। তাই বাতিল করা হয়েছে রাহিমার ভিসা। তবু রাহিমার চেষ্টার কমতি নেই। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। সকাল থেকে দুপুর। একপর্যায়ে বহুতল ভবনে বড় কর্তার রুম পর্যন্ত গিয়েছেন। অনুনয় করেছেন, কোনো সুযোগ আছে কি-না। না, কোনো সুযোগ নেই। বিমর্ষ চেহারা নিয়ে রাহিমা বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছেন যখন তখন ঘড়িতে প্রায় চারটা। দুপুরে চা, বিস্কুট খেয়েছেন। বললেন, অনেক আশায় ছিলাম ভাই। কিন্তু হলো না।
সরকারি খরচে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার দক্ষ জনশক্তি যায় দক্ষিণ কোরিয়ায়। বৈধ উপায়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় দক্ষ কর্মী পাঠানোর একমাত্র মাধ্যম হলো সরকারি প্রতিষ্ঠান বোয়েসেল। এজন্য ভাষাজ্ঞান থাকতে হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার ভাষা শিখে অনলাইনে প্রি-রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন অনেকে। রেজিস্ট্রেশন করা প্রার্থীদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে নির্ধারিত সংখ্যক প্রার্থীকে বাছাই করেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মহামারি করোনার (কোভিড-১৯)’র কারণে আটকে যায় কার্যক্রম। সম্প্রতি আবার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সকাল থেকেই শত শত যুবক ভিড় করেন প্রবাসী কল্যাণ ভবনে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে এসেছেন তারা। ভবনের ছয়তলায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। সারিবদ্ধ লাইনের শৃঙ্খলা রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো নিরাপত্তারক্ষীকে। এক এক করে ডেকে নেয়া হচ্ছিলো তাদের। তাদেরই একজন আরমান আলী। ইন্টারভিউয়ে অংশ নিতে পারছেন এতেই খুশি তিনি। আশা করছেন দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়া হবে তার। সারিবদ্ধ লাইনে দাঁড়ানো আশরাফ নামে এক যুবক বলেন, কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে লাইনে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছি। সেবা দিতে আরও সুযোগ বাড়ানো উচিত। ডেস্ক বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে এসেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের নয়ন মিয়া। কিন্তু দিতে পারেননি। নয়ন মিয়া জানান, দুইদিন হলো এই অফিসে আসা-যাওয়া করছেন। অবশেষে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে তিনদিনের প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেটের আসল কপি নিয়ে আসতে হবে। এবার আগামী রোববারে সার্টিফিকেটের আসল কপি নিয়ে আসবেন বলে জানান নয়ন মিয়া।
ভিন্ন রকম সমস্যা নিয়েও প্রবাসী কল্যাণ ভবনে ধরনা দিচ্ছেন অনেকে। তাদের একজন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের জামাল ভূঁইয়া। তিনি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। ২০১৬ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে পাঁচ কাঠা জমি ক্রয় করেছিলেন। জমিতে একটি দোকান ঘরও নির্মাণ করেন। জামাল ভূঁইয়ার অভিযোগ, দুই কাঠা জমিসহ ঘর দখল করেছে প্রভাবশালীরা। জমির সকল বৈধ কাগজ থাকলেও তা উদ্ধার করতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিভিন্নস্থানে দৌড়াচ্ছেন। চিঠি চালাচালি হচ্ছে, মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে জামাল ভূঁইয়া বলেন, লেখালেখি করেও কিচ্ছু হবে না। ওরা প্রভাবশালী। তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশায় আশায় প্রবাসী কল্যাণ ভবনে আসা-যাওয়া করছি।
এভাবেই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভিড় করছেন প্রবাসী কল্যাণ ভবনে। ছুটে যাচ্ছেন বহুতল ভবনের বিভিন্ন কক্ষে। ঘাম ঝরাচ্ছেন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত। অনেক পরিশ্রমের পর কেউ কেউ হাসি মুখে বাড়ি ফিরছেন। কেউ কেউ ফিরছেন হতাশা আর বিষণœতা নিয়ে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status