প্রথম পাতা

৩ হাজার মোবাইল ফোন উদ্ধারের জাদুকর কাদের

শুভ্র দেব

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:২৯ অপরাহ্ন

২০১৫ থেকে ২০২১ সাল। সময়টা মাত্র ৬ বছর। আর এই সময়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা হারানো ও ছিনতাই হওয়া তিন হাজার মোবাইল ফোন উদ্ধারের রেকর্ড করেছেন। ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ১৬ বার পুলিশ কমিশনার পুরস্কার। একবার পেয়েছেন আইজিপি ব্যাচ। শুধু পুরস্কার আর ব্যাচ নয় উদ্ধারের রেকর্ড করে নিজের নামের পাশে যুক্ত করেছেন নানা বিশেষণ। এখন কেউ তাকে ডাকে মোবাইল যাদুকর। কেউ ডাকে মোবাইল দরবেশ হিসেবে। কেউবা মোবাইল কাদের। পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি দেশজুড়ে অর্জন করেছেন সুনাম। তিনি শুধু তার কর্মস্থলের আওতাধীন এলাকার মোবাইল উদ্ধার করেন না। দেশের বিভিন্ন স্থানে হারিয়ে যাওয়া মোবাইল উদ্ধারের জন্য তার দ্বারস্থ হন অনেকে। কাউকে হতাশ হতে হয়নি। সাধ্যমতো চেষ্টা করে নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তাদের মোবাইল উদ্ধার করে দিয়েছেন। মানবিক এই পুলিশ কর্মকর্তার নাম আব্দুল কাদের। তিনি ডিএমপির গুলশান থানায় এএসআই হিসেবে কর্মরত আছেন।
এএসআই আবদুল কাদের সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার বড় বেড়াখারুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। লেখাপড়া করেছেন বেলকুচি ডিগ্রি কলেজ থেকে। ২০০৫ সালে কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগদান করেন। ২০১৩ সালে ডিএমপিতে বদলি হন। ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে এএসআই হন। তখন তার পোস্টিং হয় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায়। এরপর তিনি গুলশান থানায় বদলি হয়ে এখন পর্যন্ত সেখানেই আছেন। পুলিশের গুলশান বিভাগে কর্মরত অনেকের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, মোবাইল ফোন উদ্ধার করা কাদেরের একটা নেশা। মোবাইল হারানোর জিডি হলেই তার ডাক পড়ে। তিনিও একটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে উদ্ধারে নেমে পড়েন। উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকেন। কর্মজীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় তিনি মোবাইল ফোন উদ্ধারের পেছনে কাটিয়েছেন। উদ্ধারের ক্ষেত্রে কোনটিতে তিনি দু’দিন থেকে শুরু করে দুই বছর পর্যন্ত সময় নিয়েছেন। শুধু মোবাইল ফোন উদ্ধারই নয়। কর্মস্থলের অন্য কাজগুলোও তিনি গুরুত্বসহকারে করেন।
আবদুল কাদের বলেন, মোবাইল ফোন উদ্ধারের ক্ষেত্রে আমি মোবাইলের দাম বা ব্যক্তির মূল্যায়ন করি না। যত কম দামের মোবাইল হোক বা গরিব রিকশাচালক বা শ্রমিকের হোক সমান গুরুত্ব দিয়ে উদ্ধার করি। কারণ মানুষের অনেক মূল্যবান জিনিস হারিয়ে গেলে সে ততটা কষ্ট পায় না। যতটা কষ্ট পায় একটি মোবাইল ফোন হারিয়ে গেলে। কারণ মোবাইলে অনেকের অনেক স্মৃতি, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে। যা হারিয়ে গেলে তার অনেক ক্ষতি ও কষ্ট হয়। জিডি করার পর ফোন উদ্ধার করে ভুক্তভোগীকে ফোন দিয়ে যখন বলি আপনি একটা জিডি করেছিলেন আপনার ফোনটি উদ্ধার হয়েছে। তখন তারা অনেকে বিশ্বাসই করতে চায় না। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার হারানো মোবাইল উদ্ধার করেছি। গত আড়াই বছরে শুধু গুলশান থানার জিডির বিপরীতেই ৬০০ মোবাইল উদ্ধার করে গ্রাহককে ফিরিয়ে দিয়েছি। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঁচ শতাধিক অভিযোগ আসে।  নিজ থানা ছাড়াও নানা স্থান থেকে হারানো মোবাইল খুঁজে পেতে ভুক্তভোগীরা আসেন গুলশান থানায়। অনেকে আমাকে ফোন দেয়। ব্যস্ততার কারণে ধরতে পারি না। কয়েক ঘণ্টা পরে নিজেই ফোন করে জানতে চাই সমস্যার কথা। সবারই একই সমস্যা ফোন হারিয়েছে। আমার কাছে যারাই ফোন দেয় তারা শুধু মোবাইল ফোন উদ্ধারের জন্য দেয়।
মোবাইল ফোন উদ্ধারের প্রতি কেন কাদেরের এত  মনোযোগ? কেন তিনি উদ্ধারে এত সফল। এর পেছনের রহস্যই বা কি? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বিস্তারিত। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় থাকালীন সময়ে রাতের বেলা এক নারী কাঁদতে কাঁদতে থানায় প্রবেশ করেন। তখন কাদের থানায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাকে ওই নারী জানান, মহাখালী থেকে ফেরার সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তার মূল্যবান মোবাইল ফোনটি হারিয়েছে। ওই নারী তার মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করে দেয়ার জন্য বেশ কান্নাকাটি ও আকুতি-মিনতি করছিলেন। ওই নারীর কাছে তখন কাদের জানতে চান তার মোবাইলে গুরুত্বপূর্ণ এমন কি আছে যার জন্য তিনি এমন মিনতি করছেন। তখন ওই নারী বলেন, হারিয়ে যাওয়া মোবাইলটি শুধু একটি মোবাইল নয়। সাধারণ কোনো মোবাইল হলে তিনি এমন করতেন না। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, ফোনটি তার বাবার দেয়া শেষ স্মৃতি। তার বাবা ওই ফোনটি কিনে দিয়েছেন। বাবার সঙ্গে অনেক ছবিও রয়েছে ফোনে। কিন্তু কিছুদিন আগে তার বাবা মারা গেছেন। বাবার শেষ স্মৃতিগুলো তিনি মোবাইলে বার বার দেখতেন। মোবাইলটি না পেলে তার বাবার সব স্মৃতি শেষ হয়ে যাবে। এসব কথা বলতে বলতে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কাদের ওই নারীর সেই রাতের কান্না সহ্য করতে পারেননি। মানবিক দিক বিবেচনায় আর এক সন্তানের বাবার স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করবেন। পরে তিনি জিডির কপি ও অন্যান্য ডকুমেন্টসহ যোগাযোগ করেন ডিবির সঙ্গে। তিন মাস চেষ্টা করার পর ওই নারীর হারিয়ে যাওয়া মোবাইলটি উদ্ধার করেছিলেন বরিশাল থেকে। তারপর ওই নারীকে ফোন করে জানান তার মোবাইলটি উদ্ধার হয়েছে। মোবাইল নিতে এসে অঝোর ধারায় কান্না করেছিলেন ওই নারী। ওই রাতে একটি মোবাইল ফোনের জন্য কান্নাকাটি দেখেই কাদের সিদ্ধান্ত নেন তিনি হারিয়ে যাওয়া মোবাইল উদ্ধার করবেন।
ডিএমপির গুলশান জোনের সহকারী পুলিশ সুপার নিউটন দাস মানবজমিনকে বলেন, এএসআই কাদের অসংখ্য হারানো বা ছিনতাই হওয়া মোবাইল উদ্ধার করে দিয়েছে। এটা একটা পজেটিভ বিষয়। তার এ কাজে মানুষ উপকৃত হচ্ছে। সে শুধু তার কর্মস্থলের আওতাধীন এলাকার মোবাইল উদ্ধার করছে না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ ফোন করে মোবাইল উদ্ধারের বিষয়ে তার সাহায্য নেয়। তিনি বলেন, মোবাইল উদ্ধারে তার একটা দক্ষতা আছে। তবে গুলশান থানায় এএসআই হিসেবে তার অন্য কাজও আছে। সেই কাজগুলো ঠিক রেখে মানুষের উপকার করতে হবে। কীভাবে এতগুলো মোবাইল উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সে হয়তো প্রথমদিকে কিছু মোবাইল উদ্ধার করতে গিয়ে কিছু টেকনিক শিখে গেছে। হারানো মোবাইল স্ট্রেচ করতে পারে।
আবদুল কাদেরের এমন কর্মকাণ্ডে তার সহকর্মীরাও তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সম্মান জানিয়েছেন তার কর্মের প্রতি ভালোবাসা, একাগ্রতা ও নিষ্ঠাকে। তার অনেক সহকর্মী বা তাদের আত্মীয়-স্বজনের মোবাইল ফোন হারিয়ে গেলেও তারা কাদেরের সহযোগিতা নেন। হাসিমুখে কাদের তাদের ফোনও উদ্ধার করে দেন।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. আসাদুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, একজন অফিসার যখন এরকম অর্জন করে তখন অবশ্যই আমরা আনন্দিত, গর্বিত হই। পুলিশ সদস্যরা যখন ভালো কিছু করে সেটা পুরো বাহিনীর সুনাম হয়। কাদেরের একাগ্রতা, নিষ্ঠা, চেষ্টা বা কাজের প্রতি যে ভালোবাসা এগুলো এই সময়ে সত্যিই বিরল। সেই দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে কাদের একজন ভালো অফিসার। ভালো কাজ করেছে। তার ওপর সকল অর্পিত দায়িত্ব পালন করেই এই কাজগুলো করছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status