মত-মতান্তর

দিন দিন হাসির খোরাক হচ্ছে পাকিস্তানি কূটনীতি

পলাশ আহসান

৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, সোমবার, ৭:০৯ অপরাহ্ন

গত জুলাই মাসে ঘটনা। ইসলামাবাদের কূটনীতিক পাড়ায় খুব কাছাকাছি সময়ের দূটো ঘটনা। প্রথম ঘটনায় একজন আফগান কূটনীতিকের মেয়ে অপহৃত হলো। মুক্তি পেলো ঘণ্টা চারেক পর। এর ঠিক পরের সপ্তাহে পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিকের মেয়ে অপহরণ হলো। তারপর তাকে গুলি করে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা। দুটোই কূটনীতিক পাড়ার নিরাপত্তা না দিতে পারার রাষ্টীয় ব্যর্থতা। দুটি ঘটনার শুরুতেই পাকিস্তানের খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতীয় গোয়েন্দাদের দায়ী করেছিলেন। কিন্ত যখন দেখলেন আফগান মেয়েটিকে পাওয়া গেলো, তখন বললেন সে অপহৃতই হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানি কুটনীতিকের মেয়ে হত্যার দায় চাপিয়ে রাখলেন ভারতের কাঁধেই। বিশ্বের বাঘা বাঘা কূটনীতিকরা হাসলেন। কারণ তারা আরো একবার দেখলেন ইসলামাবাদের `যা কিছু হারায় কেষ্টা বেটাই চোর' নীতির পুনরাবৃত্তি।

ইসলামাবাদে দুই কন্যার ওপর বিপর্যযের ঘটনা যখন চলছ, তখনো অনেকেই জানতেন না দিল্লি-ইসলামাবাদ কূটনীতিতে আরো চমক আসছে। ভারত ১০ম বারের মত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি হয়ে যায় গত পহেলা আগস্টে। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশির আচরণে মনে হলো, মাসব্যাপী মাস কান্নাকাটির কর্মসূচি দিচ্ছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তান যখন সভাপতি ছিলো, তখনকার কথা চিন্তা করেও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ধারে কাছে গেলেন না তারা। নিজের দেশে তো বটেই, বাইরেও নানা আতংক ছড়াতে লাগলেন। এসময় বেমালুম ভুলে গেলেন তাদের প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অনেক কেমব্রিজ গ্রাজুয়েড। বোঝাই গেলো না যে, তাদের ন্যূনতম রাজনৈতিক শিক্ষা আছে। ভারতকে শান্তির লুণ্ঠনকারী বলেই গেলেন। আসলেই কী তাই? প্রশ্ন উঠছে এখন। ভারতের নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিত্বের এক মাসের মেয়াদ শেষ। এপ্রশ্ন তোলাই যায়। শুরুর কথাই যদি ধরি, প্রথম বৈঠকেই তিনটি সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন সভাপতি। এগুলো হচ্ছে শান্তিরক্ষা, সন্ত্রাস দমন এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা। প্রতিটি বিষয় আজকের প্রেক্ষাপটে খুবই প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন তালিবান আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ যখন বিশ্বব্যাপী। কিন্ত সম্মেলনের এই তিন বিষয়কে স্বাগত জানালো না। এতে পাকিস্তান তার বিরুদ্ধে আনা, ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডের সব অভিযোগ সত্য প্রমাণ হলো। এটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, আফগানিস্তানে শান্তি আসতে পারে না, যতক্ষণ না পাকিস্তান হিন্দুকুশ পর্বতের কোলে তালিবানদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করবে।

এরইমধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তার কাউন্সিলের অধীনে একটি শান্তি সম্মেলন প্রস্তাব করেছে ভারত। যেটা বিশ্বব্যপী প্রশংশিত হয়েছে। সম্মেলনের দ্বিতীয় ইস্যু সন্ত্রাসবাদ বিরোধী শক্তিশালী প্রচেষ্টা গড়ে তোলা। সন্ত্রাস দমনের বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে আরও ২০ বছর আগে থেকে অপরিহার্য রয়ে গেছে। এটা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যে না করে পাকিস্তানি কূটনীতিকদের এর পাশে থাকা দরকার ছিল। কারণ শুধু ভারত নয় বরং অধিকাংশ দেশ বিশ্বাস করে যে পাকিস্তান জঙ্গিবাদি জিহাদের প্রবর্তক। দীর্ঘদিন ধরে এই জঙ্গিবাদি সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তার ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স, আইএসআই এখানেই সবচেয়ে সুরক্ষিত। সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে যেকোনো আন্তর্জাতিক আলোচনা খুবই সমসাময়িক। কারণ সমুদ্রের পানি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপর ভারত ও তার প্রতিবেশি বাংলাদেশ নেপাল ভুটান মালদ্বীপ শ্রীলঙ্কার নতুন অর্থৈনতিক সম্ভাবনা দাঁড়িয়ে আছে। এখানে স্থায়ী সদস্য চীনের স্বতস্ফূর্ততা খুব জরুরি। এরকম একটি পরিবেশ এবং মানুষ বান্ধব বিষয়ের ক্ষেত্রেও সমালোচনা মুখর পাকিস্তানি কূটনীতি। কারণ কোন আন্তর্জাতিক ফোরামে চীনের ন্যূনতম সমালোচনা চীনের চেয়ে পাকিস্তানকে বেশি বিব্রত করে। এখানে বলে রাখা ভালো, শি জিনপিং শাসন তালিবানকে কিছু সাহায্য দিচ্ছে। পাকিস্তানিরা ভাবছেন এটা বোধহয় পাকিস্তানের হয়ে তাদের সহায়তা করছে চীন। কিন্ত বিশ্ব কূটনীতিকরা বলছেন, এটা উইঘুর মুসলিম বিদ্রোহীদের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক কিছুটা সহজ করার চেষ্টা। কারণ উইঘুর গোষ্ঠীগুলো তালেবানদের সাথে যুক্ত।

এখন সেপ্টেম্বর। আগস্টে নিরাপত্তার পরিষদে ভারতের কূটনৈতিক সাফল্য জানার সুযোগ এখনো হয়নি গণমাধ্যমের। তবে না দেখেও মোটামুটি বলে দেয়া যায়, বরাবরের মত ইউএনএসসিতে চীনারা পাকিস্তানের ভারতবিরোধী কণ্ঠকে সহায়তা করেছে। যেকোন যুক্তি উপস্থাপনের চেয়ে বেশিবার বলেছে ‘কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না’ ‘কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না’ এটাই প্রকৃত অর্থে ‘বিরোধিতার জন্যেই বিরোধিতার’ উদাহরণ। একইভাবে গত ২০ বছর ধরে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গিদের প্রতিটি আক্রমণকে ভারতের সন্ত্রাসবাদের ‘প্রমাণ’ হিসেবে বর্ণনা করে ইসলামাবাদ। ভারত এখনো তালিবানদের স্বীকৃতি দেয়নি। আদৌ দেবে কী না সে নিশ্চয়তাও প্রকাশ করেনি কোথাও। অথচ তালিবানদের আগ্রহে ভারতীয় কূটনীতিকদের প্রথম বৈঠকের কথা প্রকাশ করেছেন তাঁদের অন্যতম শীর্ষ নেতা শের মোহাম্মদ আব্বাস স্টানিকজাই। গত সপ্তাহে কাতারের দোহায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর তিনি গণমাধ্যমে ভারতের সঙ্গে তার কূটনীতিক সম্পর্কে স্থাপনের সর্বোচ্চ আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়, কিছু না বলতেই স্টানিকজাই, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি কোন জঙ্গি গোষ্ঠীকে সহায়তা না করার অঙ্গীকার করেছেন।

ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এই বৈঠক ছিল আফগানিস্থানে আটকে পড়া ভারতীয়দের নিরাপদে ফিরিয়ে আনাদের জন্য। অথচ স্টানিকজাই নানা ভাবে প্রকাশ করছেন এই মুহূর্তে ভারতের স্বীকৃতি তার জন্যে কতটা জরুরি। জাতিসংঘের প্রধান হিসেবে, প্রথম বৈঠকে ভারত যে সম্মেলনগুলো প্রস্তাব করেছিল তা তালিবান-বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনবে। একথা আর কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক তালিবানরা করে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা এখন আর বলতে দ্বীধা নেই।
লেখক: যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status