মত-মতান্তর

কাশ্মীর: আফগানিস্তান প্রসঙ্গ টেনে 'নিঃসঙ্গ' মোদিকে হুশিয়ারি

ড. মাহফুজ পারভেজ

২৩ আগস্ট ২০২১, সোমবার, ১১:৪৫ পূর্বাহ্ন

কাশ্মীরের জন্যেই আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখলে ভারতের যত মাথাব্যথা। স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরি জনতা যদি আফগানিস্তানের নিকট-প্রতিবেশীদের দ্বারা উৎসাহিত হয়, সেজন্য সব সময়ই ভয়ে ভয়ে থাকে দিল্লি। এবার তালেবানদের কাবুল দখলের পর আফগানিস্তান প্রসঙ্গ টেনে মোদিকে হুশিয়ারি দিয়েছেন কাশ্মীরের শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রী। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আফগানিস্তান ইস্যুতে ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

কাশ্মীরের ভূ-কৌশলগত অবস্থানও মারাত্মক। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত ছাড়া আফগানিস্তানে যাওয়া-আসার সহজ সুযোগ রয়েছে কাশ্মীরের। ঐতিহাসিক 'সিল্ক রোড' আমল থেকেই হিমালয়ের পশ্চিম ঢালের জনপদগুলো বিভিন্ন পার্বত্য পথের মাধ্যমে সংযুক্ত। কাশ্মীর থেকে চীন ও মধ্য এশিয়ায় যাতায়াতের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে আফগানিস্তান।

সেই আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহের আঁচ ভারতে, বিশেষত কাশ্মীর ইস্যুতে পড়তে বাধ্য। তালেবানদের কব্জায় কাবুল আসার পর দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে কড়া বার্তা দিয়েছে ভারত, যদিও প্রতিবেশী চীন, পাকিস্তান, ইরান, এমনকি, রাশিয়াও তালেবানদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করে চলেছে।

তবে, ভারত সরকারের বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়েছে কাশ্মীরি জনতার মধ্যে। 'জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ ধৈর্য্য হারালে আপনারা উবে যাবেন' মর্মে আফগানিস্তান প্রসঙ্গ টেনে মোদি সরকারকে হুশিয়ারিও দিয়েছেন কাশ্মীরি নেত্রী মেহবুবা মুফতি। 'মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ছাড়তেই সে দেশের কী অবস্থা হয়েছে, তার থেকে শিক্ষা নিতে'ও কেন্দ্রকে বার্তা দিয়েছেন কাশ্মীর রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি।

নিজের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আফগান তালেবানদের উদ্দেশ্যে মেহবুবা মুফতি বলেছেন, 'বন্দুকের ভূমিকা আর নেই।' পিডিপির সভানেত্রী প্রকাশ্য জনসভাতে ভারত, কাশ্মীর ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি রাজ্যের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বার্থে জম্মু-কাশ্মীর থেকে সংবিধানের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করার জোরালো দাবি পুনরুচ্চারণ করেন।

মোদি সরকারের প্রতি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে মেহবুবা মুফতি বলেন, ‘আমি আপনাদের বারবার বলছি ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেবেন না। পরিস্থিতি বুঝুন এবং নিজেদের শুধরে নিন।’

এদিকে, গোটা আফগান-মুলুক তালেবানদের দখলে চলে যাওয়ার পর থেকে নাগরিকদের সরাতে শুরু করেছে ভারত৷ দফায় দফায় বিশেষ বিমান পাঠিয়ে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে ভারতীয় কর্মকর্তা ও নাগরিকদের। যাদের সরাসরি আনা যাচ্ছে না, তাদের মধ্য এশীয় দেশ ও আফগানিস্তানের প্রতিবেশী তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে হয়ে দিল্লিতে আনা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, তালেবানরা ক্ষমতায় এসে ভারতীয় দূতাবাসের কোনো ক্ষতি করা হবে না মর্মে আশ্বস্ত করেছিল। দূতাবাস খালি না করার জন্যেও ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল তারা। কাতারে অবস্থিত তালেবান সমন্বয় অফিস থেকে মুখপাত্র আব্বাস জাই এর বরাতে ভারতকে আশ্বাস বাণী শোনানো হলেও এবং কাবুল দখলের পর কোনো বিরূপ পদক্ষেপ না নেওয়া হলেও ভারত অতি দ্রুততার সঙ্গে দূতাবাসের কর্মী ও ভারতীয় নাগরিকদের সরিয়ে নিতে থাকে।

ধারণা করা হচ্ছে যে, তালেবান কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত আফগানিস্তানের পলাতক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি ছিলেন ভারতের সমর্থক। ভারত সেই সরকারকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছিল। তালেবানরা ক্ষমতায় এসে প্রতিশোধ নিতে পারে মনে করেই ভারত তড়িঘড়ি নিজের লোকজনকে সরিয়ে নিয়েছে এবং তালেবানদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিচ্ছে।

কিন্তু বাস্তবে আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের মনোভাবের সঙ্গে দৃশ্যত কোনো দেশই একমত হয় নি। বরং দিনে দিনে বাড়ছে ভারতের নিঃসঙ্গতা। এদিকে, 'আফগানিস্তানের সমস্যা কূটনৈতিক ভাবেই মেটানোর চেষ্টা করা হবে। প্রয়োজনে তালেবানের সঙ্গে কাজ করতেও রাজি' বলে জানিয়েছেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।

আফগানিস্তানে তালেবান কর্তৃত্বকে আগেই প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়ে রেখেছে রাশিয়া এবং চীন। সমর্থন করেছে পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক। প্রথম কোনো বিদেশী মন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরাইশি তালেবান শাসিত কাবুলে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে তিনি তালেবান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বিষয়ে আলোচনা করবেন।

তালেবানদের প্রতি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো 'নরম’ সুর'-এর বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির 'গরম সুর'কে নিঃসঙ্গ বলে মনে করছেন ভূ-রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা। এসব বাস্তবতা এখন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, যা বিব্রত করছে দিল্লির নীতিপ্রণেতাদের কেন্দ্র 'সাউথ ব্লক'কে। কারণ, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথাতেই স্পষ্ট হয়েছে যে, 'উপমহাদেশের শক্তিধরেরা নিজেদের মধ্যে যুযুধান হলেও কিছু যাবে আসবে না বাইডেন প্রশাসনের, যত ক্ষণ না তার আঁচ আমেরিকায় এসে পড়ছে।' আমেরিকার এই পশ্চাদপসরণ আফগানিস্তান ইস্যুতে ভারতকে আরো 'একলা', 'একাকী' ও 'নিঃসঙ্গ' করেছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status