মত-মতান্তর
বিবর্ণ নক্ষত্রপুঞ্জ হতে আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন
আশরাফ-উদ-দৌলা
২২ আগস্ট ২০২১, রবিবার, ৬:২৯ অপরাহ্ন
আল্লাহ যেমন জীবন দান করেন, তেমনি তিনি মৃত্যুও দেন যা শেষ পর্যন্ত জীবনকে ছায়ায় ঢেকে রাখে। দুয়ের মধ্যে সময়ের দূরত্ব চোখের পলকের চেয়েও কম। জন্মের মতো মৃত্যুও অনিবার্য। তবু, কখনো কখনো হৃদয়ের কাছের কারও মৃত্যুর খবর আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, যে খবর শুনতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বীরমুক্তিযোদ্ধা, আমার সহপাঠী মেজর (অব.) মুক্তাদির আলীর আকস্মিক মৃত্যুর (২০-০৮-২১) খবরে আমাদের অবস্থাও তাই হয়েছিল।
আমার বড় মেয়ে, তার স্বামী এবং তাদের সাড়ে ৭ বছরের ছেলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিন সপ্তাহের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বাধ্য হয়। মেয়ে একই বিল্ডিংয়ে আমাদের একতলা ওপরে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতি শুক্রবার ওরা আমাদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে আসছে। কিন্তু কোয়ারেন্টিনের সময় তাদের সামনাসামনি দেখতে পাইনি। শুধু হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে কথা বলতে পেরেছি।
তাই তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় পর তাদের সঙ্গে দেখা হওয়াটা ছিল আনন্দ উৎসবের মতো। দুপুরের খাবার খেয়ে নাতির সঙ্গে খেলা করছি তখন আমার আরেক কোর্সমেট মেজর জেনারেল (অব.) জীবন কানাই দাসের ফোন আসে। আমি স্বভাবসুলভ হালকা ভঙ্গিতে ফোনটা ধরি কিন্তু জীবন কথা বলতে পারছিল না। তার কণ্ঠ আটকে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে তিনি জানান যে, মুক্তাদিরের বড় ধরনের মস্তিষ্কে স্ট্রোক হয়েছে এবং তাকে দ্রুত ঢাকা সিএমএইচের জরুরি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি সতর্ক করেন যে, তার ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আমার মাথায় বাজ পড়লো। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। তাৎক্ষণিক ধাক্কা সামলে আমি সিএমএইচে ছুটে গেলাম। সিএমএইচ আমার বাড়ি থেকে কয়েক মিনিটের পথ। জরুরি কক্ষে মুক্তাদিরের স্ত্রী রানাকে দেখতে পেলাম। তিনি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছেন এবং তার বোন ও নিকটাত্মীয়রা হাসপাতালে জড়ো হয়ে তাকে সান্ত¡না দিচ্ছেন। আমার সহপাঠী, মেজর (অব.) আরেফিন, ব্রিগেডিয়ার (অব.) আকবর ইউসুফ এবং মেজর (অব.) সালাম আমার আগেই সিএমএইচে পৌঁছে ছিলেন। আমি তৎক্ষণাৎ জরুরি কক্ষের ভেতর সরাসরি মুক্তাদিরের বিছানার দিকে চলে গেলাম। কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন কিন্তু সবই বৃথা গেল।
কয়েক মিনিট পর রানাকে ডাক্তাররা মর্মান্তিক খবরটি জানান। দীর্ঘ ৪৫ বছরের প্রিয় স্বামীর মৃত্যুর খবরে বিধ্বস্ত রানা এবং সেখানে উপস্থিত অন্যদের শোক ও আর্তনাদের বর্ণনা দেয়ার মতো অবস্থা নেই।
বীরমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে পরিপূর্ণ সামরিক মর্যাদায় বনানী সেনা কবরস্থানে দাফন করা হয়। অন্তিম যাত্রায় তার সহপাঠী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পরিবারের সদস্য এবং শুভাকাক্সক্ষীরাসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির বিপুলসংখ্যক শোকাহত মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
সিলেটের বিয়ানীবাজারে জন্মগ্রহণকারী মুক্তাদির নিজ গ্রামের বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। এইচএসসি ভালো ফল করে তিনি ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (এখনকার বুয়েট)তে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে তার ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই মাসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ক্লাস স্থগিত করা হয়েছিল।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ব্যাপকভাবে ভোট দেয়। আওয়ামী লীগ ছিল নতুন সরকার গঠনের একমাত্র দাবিদার। যাই হোক, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার মনে অন্য পরিকল্পনা ছিল এবং তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা করতে থাকে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানি শাসকরা দেশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে শুরু করে। নতুন সরকার গঠনের বৈধ অধিকার হারিয়ে এবং জাতির দিগন্তে কালো মেঘের আসন্ন হুমকি অনুভব করে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ জাতির কাছে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য লড়াই করতে স্পষ্ট আহ্বান জানান।
অনেক সহকর্মীর মতো, তরুণ মুক্তাদিরের বিবেকও জাগ্রত হয় এবং তিনি জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করতে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কাল রাত্রে বঙ্গবন্ধুকে
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। বাঙালি জাতির ওপর তারা গণহত্যা শুরু করে যা ৯ মাস ধরে চলতে থাকে। মুক্তাদির এর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের মে মাসের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতে পাড়ি জমান। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং মৌলিক অস্ত্র পরিচালনার কিছু প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পেয়ে তিনি মেজর সি আর দত্তের নেতৃত্বে চার নম্বর সেক্টরের অধীনে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন, যদিও তার বেল্টের উল্লেখযোগ্য অনেকেই পালিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তিনি ভারতের জলপাইগুড়ির পর্বতশৃঙ্গ মূর্তিতে একটি অস্থায়ী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে ‘সেকেন্ড বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স’ এর প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হন। প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো ভারতীয় সেনা অফিসার, জেসিও এবং এনসিও দ্বারা পরিচালিত হতো।
প্রশিক্ষণ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। যাই হোক, ক্যাডেটরা বাংলাদেশে ফেরার আগ পর্যন্ত (ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) প্রশিক্ষণ অব্যাহত ছিল। দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পদাতিক ইউনিটে তিন মাসের সংযুক্তির পর, ক্যাডেটদের আরও তিন মাসের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকা সেনানিবাসে আনা হয়। এরপর ১৯৭২ সালের ৫ই আগস্ট তাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রদান করা হয়। প্রত্যাশিতভাবেই মুক্তাদির শীর্ষ ১০ ক্যাডেটদের মধ্যে ছিলেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন তরুণ ও উদীয়মান কর্মকর্তা হিসেবে মুক্তাদিরের ক্যারিয়ার আশাব্যঞ্জক ছিল। তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে মেজর পদে উন্নীত হন। ১৯৮১ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকা-ের পর, মুক্তাদির সেনাবাহিনীর পরিবেশকে প্রতিকূল, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুকূল বলে মনে করেননি। তিনি তার প্রিয় সংগঠন থেকে তাড়াতাড়ি অবসর গ্রহণ করেন। এটা উল্লেখ্য যে, তার ভায়রা (স্ত্রীর বড় বোনের স্বামী) ব্রিগেডিয়ার মহসিন উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রমকে (বীরমুক্তিযোদ্ধা) প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যার অভিযোগে ১৯৮১ সালে ফাঁসি দেয়া হয়। মুক্তাদির এই অন্যায়কে নৈতিকভাবে মানতে পারেননি এবং ১৯৮২ সালের শুরুতে সেনাবাহিনী ছাড়েন।
কোনো চাকরি ছাড়াই কয়েক মাস কাটানোর পর ১৯৮২ সালে তিনি তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি উপরে ওঠেন, তিতাস গ্যাসের এমডি হন, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান (জাতীয় গ্যাস কোম্পানি) এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ২০১২ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একটি বেসরকারি এনার্জি কোম্পানির ‘সিনিয়র এডভাইজার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এ সময়কালে মুক্তাদির জ্বালানি খাতে বিদেশে বেশ কয়েকটি উচ্চতর প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন, বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি বিদেশি সরকার এবং বেসরকারি প্রতিপক্ষের সঙ্গে জ্বালানি খাত সম্পর্কিত আলোচনায় উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদলের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাকে দেশের অন্যতম প্রধান জ্বালানি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি জ্বালানি বিষয়ক বিভিন্ন নিবন্ধ রচনা করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অফিসার ট্রেনিংয়ের দুটি কোর্স ছিল- ১ম ওয়ার কোর্স এবং ২য় ওয়ার কোর্স, যেখানে সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৮১ সালের মর্মান্তিক ঘটনায় প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর, এই দুটি কোর্সের প্রচুর কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়, অন্যদের অনেকেই স্বেচ্ছায় অবসর নেন। কিছুদিন পর তারা বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সেস ফাউন্ডেশন (BWCF) নামে একটি সামাজিক সংগঠন গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফাউন্ডেশনের গোড়া থেকেই মুক্তাদির স্বেচ্ছায় এর ফ্রন্টলাইন অফিসারদের একজনই ছিলেন না, তিনি ছিলেন BWCF- এর অপরিহার্য প্রাণভোমরা।
আমাদের বন্ধু লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুদাসসির তাকে ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’ বলে ডাকতেন। প্রকৃতপক্ষে মুক্তাদিরের কারণেই ফাউন্ডেশনটি এখনো জীবিত রয়েছে। এখন, তার মৃত্যুতে আমি বিডব্লিউসিএফের ভাগ্য নিয়ে শঙ্কিত। ফাউন্ডেশনে তিনি কেবল প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকাই রাখতেন না বরং এর সদস্যদের সুখ-দুঃখে, প্রয়োজনে কাছে থাকতেন। তিনি বিশেষ করে সংবেদনশীল এবং মৃত সদস্যদের পরিবারের কল্যাণের চেষ্টা করতেন। তিনি ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিনে এবং বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তহবিল সংগ্রহ এবং অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখতেন। ব্যক্তিগত জীবনে, মুক্তাদির একজন ভালো মানুষের সমস্ত সেরা গুণাবলী অর্জন করেছিলেন। তিনি খুব ধার্মিক ছিলেন এবং পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত না করে কখনো ঘর থেকে বের হননি। তিনি সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি সদয়, সহায়ক এবং ভালো আচরণ করতেন। এভাবে তিনি সবার কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। করোনা সংক্রমণের ঝুঁঁকি থাকা সত্ত্বেও তার জানাজায় বিশাল জনতার উপস্থিতি সেটাই প্রমাণ করে।
মহামারি আমাদের স্বাভাবিক জীবন আকস্মিক থমকে দিলে, বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে মুক্তাদির সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফাউন্ডেশনের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানিয়ে জুমে বেশ কয়েকটি সভার আয়োজন করেন। এটি মিনি স্ক্রিনে একে অপরের মুখ দেখার এবং চলমান ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মতবিনিময় করার একটি সুযোগ প্রদান করে। এ ধরনের সর্বশেষ জুম মিটিংটি হয়েছিল ৫ই আগস্ট ২০২১ সালে, আমাদের ৪৯তম কমিশন দিবসে। সকল অংশগ্রহণকারী আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, তিনি যেন ৫০তম বার্ষিকীটি শারীরিক উপস্থিতিতে দুর্দান্তভাবে পালন করার সুযোগ দেন। মুক্তাদিরকে এখন থেকে তার জন্য প্রস্তুতি শুরু করতে বলা হয়। কিন্তু হায়, তা আর হলো না। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে, যখন বিরতিহীন লকডাউন থেকে কিছুটা অবকাশ ছিল, তখন মুক্তাদির পরামর্শ দেন যে, আমাদের কোর্সমেটদের কয়েকজন কক্সবাজারে একটি ছুটির দিন কাটাবো। প্রত্যেকেই উৎসাহের সঙ্গে প্রস্তাবে সায় দিলো এবং আমরা গেলাম। বিমানের টিকিট থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং পর্যন্ত, স্থানীয় পরিবহন থেকে শুরু করে খাবারের মেনু এবং টেকনাফ ভ্রমণ ইত্যাদি সবই বিনাবাক্য ব্যয়ে মুক্তাদির নিজ উদ্যোগে করেন। চমৎকার এক পুনর্মিলনী ছিল যেখানে আমাদের স্ত্রীরাও ছিলেন।
মুক্তাদির এবং আমি প্রায়ই মুঠোফোনে কথা বলতাম। মাত্র কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল যে, একমাত্র আল্লাহই জানেন আমাদের আবার কবে দেখা হবে বা এই জীবনে আমাদের আর দেখা হবে কিনা। আমি কি জানতাম যে, এত অল্প সময়েই এমন নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঘটে যাবে! আমি তাকে বললাম, আমি আমার স্ত্রীকে আমার মৃত্যুর পর দু-তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে খবরটা জানাতে বলেছি, তিনি তাদেরই একজন। তিনি আমাকে জানান যে, তিনিও তার স্ত্রীকে বলেছিলেন এমন কিছু ঘটলে অবিলম্বে আমাকে জানাতে। সুতরাং, আমার মৃত্যুর পর মুক্তাদির তার দোয়া থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেন। দুঃখজনকভাবে আমাকেই তার শেষ বিদায় জানাতে হলো।
আমরা আল্লাহকে প্রশ্ন করতে পারি না তিনি কেন করেন বা তিনি কি করেন। তিনিই জীবনদাতা এবং তিনিই জীবন গ্রহণকারী। তার পরিবার সান্ত¡না পেতে পারে এই ভেবে যে, মুক্তাদির পবিত্র শুক্রবার এবং পবিত্র আশুরার দিনে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, যা ইসলামিক ক্যালেন্ডারে সবচেয়ে পবিত্র দিন। আক্ষরিক অর্থে কোনো কষ্ট ছাড়াই তিনি বিদায় নিয়েছেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক পুত্র, এক কন্যা, তিন নাতি-নাতনিসহ বহু নিকটাত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষী রেখে গেছেন।
চিরবিদায় বন্ধু। আমরাও শেষ বিদায়ের অপেক্ষায়। আমাদের আগে তোমার ডাক এসেছিল কিন্তু শিগগিরই তোমার সঙ্গে আমাদের দেখা হবে, যখন আল্লাহ চাইবেন।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সচিব এবং রাষ্ট্রদূত, মেজর মুক্তাদিরের কোর্সমেট]
আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বীরমুক্তিযোদ্ধা, আমার সহপাঠী মেজর (অব.) মুক্তাদির আলীর আকস্মিক মৃত্যুর (২০-০৮-২১) খবরে আমাদের অবস্থাও তাই হয়েছিল।
আমার বড় মেয়ে, তার স্বামী এবং তাদের সাড়ে ৭ বছরের ছেলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিন সপ্তাহের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বাধ্য হয়। মেয়ে একই বিল্ডিংয়ে আমাদের একতলা ওপরে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতি শুক্রবার ওরা আমাদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে আসছে। কিন্তু কোয়ারেন্টিনের সময় তাদের সামনাসামনি দেখতে পাইনি। শুধু হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে কথা বলতে পেরেছি।
তাই তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় পর তাদের সঙ্গে দেখা হওয়াটা ছিল আনন্দ উৎসবের মতো। দুপুরের খাবার খেয়ে নাতির সঙ্গে খেলা করছি তখন আমার আরেক কোর্সমেট মেজর জেনারেল (অব.) জীবন কানাই দাসের ফোন আসে। আমি স্বভাবসুলভ হালকা ভঙ্গিতে ফোনটা ধরি কিন্তু জীবন কথা বলতে পারছিল না। তার কণ্ঠ আটকে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে তিনি জানান যে, মুক্তাদিরের বড় ধরনের মস্তিষ্কে স্ট্রোক হয়েছে এবং তাকে দ্রুত ঢাকা সিএমএইচের জরুরি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি সতর্ক করেন যে, তার ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আমার মাথায় বাজ পড়লো। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। তাৎক্ষণিক ধাক্কা সামলে আমি সিএমএইচে ছুটে গেলাম। সিএমএইচ আমার বাড়ি থেকে কয়েক মিনিটের পথ। জরুরি কক্ষে মুক্তাদিরের স্ত্রী রানাকে দেখতে পেলাম। তিনি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছেন এবং তার বোন ও নিকটাত্মীয়রা হাসপাতালে জড়ো হয়ে তাকে সান্ত¡না দিচ্ছেন। আমার সহপাঠী, মেজর (অব.) আরেফিন, ব্রিগেডিয়ার (অব.) আকবর ইউসুফ এবং মেজর (অব.) সালাম আমার আগেই সিএমএইচে পৌঁছে ছিলেন। আমি তৎক্ষণাৎ জরুরি কক্ষের ভেতর সরাসরি মুক্তাদিরের বিছানার দিকে চলে গেলাম। কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন কিন্তু সবই বৃথা গেল।
কয়েক মিনিট পর রানাকে ডাক্তাররা মর্মান্তিক খবরটি জানান। দীর্ঘ ৪৫ বছরের প্রিয় স্বামীর মৃত্যুর খবরে বিধ্বস্ত রানা এবং সেখানে উপস্থিত অন্যদের শোক ও আর্তনাদের বর্ণনা দেয়ার মতো অবস্থা নেই।
বীরমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে পরিপূর্ণ সামরিক মর্যাদায় বনানী সেনা কবরস্থানে দাফন করা হয়। অন্তিম যাত্রায় তার সহপাঠী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পরিবারের সদস্য এবং শুভাকাক্সক্ষীরাসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির বিপুলসংখ্যক শোকাহত মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
সিলেটের বিয়ানীবাজারে জন্মগ্রহণকারী মুক্তাদির নিজ গ্রামের বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। এইচএসসি ভালো ফল করে তিনি ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (এখনকার বুয়েট)তে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে তার ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই মাসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ক্লাস স্থগিত করা হয়েছিল।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ব্যাপকভাবে ভোট দেয়। আওয়ামী লীগ ছিল নতুন সরকার গঠনের একমাত্র দাবিদার। যাই হোক, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার মনে অন্য পরিকল্পনা ছিল এবং তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা করতে থাকে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানি শাসকরা দেশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে শুরু করে। নতুন সরকার গঠনের বৈধ অধিকার হারিয়ে এবং জাতির দিগন্তে কালো মেঘের আসন্ন হুমকি অনুভব করে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ জাতির কাছে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য লড়াই করতে স্পষ্ট আহ্বান জানান।
অনেক সহকর্মীর মতো, তরুণ মুক্তাদিরের বিবেকও জাগ্রত হয় এবং তিনি জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করতে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কাল রাত্রে বঙ্গবন্ধুকে
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। বাঙালি জাতির ওপর তারা গণহত্যা শুরু করে যা ৯ মাস ধরে চলতে থাকে। মুক্তাদির এর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের মে মাসের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতে পাড়ি জমান। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং মৌলিক অস্ত্র পরিচালনার কিছু প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পেয়ে তিনি মেজর সি আর দত্তের নেতৃত্বে চার নম্বর সেক্টরের অধীনে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন, যদিও তার বেল্টের উল্লেখযোগ্য অনেকেই পালিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তিনি ভারতের জলপাইগুড়ির পর্বতশৃঙ্গ মূর্তিতে একটি অস্থায়ী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে ‘সেকেন্ড বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স’ এর প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হন। প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো ভারতীয় সেনা অফিসার, জেসিও এবং এনসিও দ্বারা পরিচালিত হতো।
প্রশিক্ষণ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। যাই হোক, ক্যাডেটরা বাংলাদেশে ফেরার আগ পর্যন্ত (ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) প্রশিক্ষণ অব্যাহত ছিল। দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পদাতিক ইউনিটে তিন মাসের সংযুক্তির পর, ক্যাডেটদের আরও তিন মাসের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকা সেনানিবাসে আনা হয়। এরপর ১৯৭২ সালের ৫ই আগস্ট তাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রদান করা হয়। প্রত্যাশিতভাবেই মুক্তাদির শীর্ষ ১০ ক্যাডেটদের মধ্যে ছিলেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন তরুণ ও উদীয়মান কর্মকর্তা হিসেবে মুক্তাদিরের ক্যারিয়ার আশাব্যঞ্জক ছিল। তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে মেজর পদে উন্নীত হন। ১৯৮১ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকা-ের পর, মুক্তাদির সেনাবাহিনীর পরিবেশকে প্রতিকূল, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুকূল বলে মনে করেননি। তিনি তার প্রিয় সংগঠন থেকে তাড়াতাড়ি অবসর গ্রহণ করেন। এটা উল্লেখ্য যে, তার ভায়রা (স্ত্রীর বড় বোনের স্বামী) ব্রিগেডিয়ার মহসিন উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রমকে (বীরমুক্তিযোদ্ধা) প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যার অভিযোগে ১৯৮১ সালে ফাঁসি দেয়া হয়। মুক্তাদির এই অন্যায়কে নৈতিকভাবে মানতে পারেননি এবং ১৯৮২ সালের শুরুতে সেনাবাহিনী ছাড়েন।
কোনো চাকরি ছাড়াই কয়েক মাস কাটানোর পর ১৯৮২ সালে তিনি তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি উপরে ওঠেন, তিতাস গ্যাসের এমডি হন, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান (জাতীয় গ্যাস কোম্পানি) এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ২০১২ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একটি বেসরকারি এনার্জি কোম্পানির ‘সিনিয়র এডভাইজার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এ সময়কালে মুক্তাদির জ্বালানি খাতে বিদেশে বেশ কয়েকটি উচ্চতর প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন, বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি বিদেশি সরকার এবং বেসরকারি প্রতিপক্ষের সঙ্গে জ্বালানি খাত সম্পর্কিত আলোচনায় উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদলের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাকে দেশের অন্যতম প্রধান জ্বালানি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি জ্বালানি বিষয়ক বিভিন্ন নিবন্ধ রচনা করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অফিসার ট্রেনিংয়ের দুটি কোর্স ছিল- ১ম ওয়ার কোর্স এবং ২য় ওয়ার কোর্স, যেখানে সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৮১ সালের মর্মান্তিক ঘটনায় প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর, এই দুটি কোর্সের প্রচুর কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়, অন্যদের অনেকেই স্বেচ্ছায় অবসর নেন। কিছুদিন পর তারা বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সেস ফাউন্ডেশন (BWCF) নামে একটি সামাজিক সংগঠন গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফাউন্ডেশনের গোড়া থেকেই মুক্তাদির স্বেচ্ছায় এর ফ্রন্টলাইন অফিসারদের একজনই ছিলেন না, তিনি ছিলেন BWCF- এর অপরিহার্য প্রাণভোমরা।
আমাদের বন্ধু লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুদাসসির তাকে ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’ বলে ডাকতেন। প্রকৃতপক্ষে মুক্তাদিরের কারণেই ফাউন্ডেশনটি এখনো জীবিত রয়েছে। এখন, তার মৃত্যুতে আমি বিডব্লিউসিএফের ভাগ্য নিয়ে শঙ্কিত। ফাউন্ডেশনে তিনি কেবল প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকাই রাখতেন না বরং এর সদস্যদের সুখ-দুঃখে, প্রয়োজনে কাছে থাকতেন। তিনি বিশেষ করে সংবেদনশীল এবং মৃত সদস্যদের পরিবারের কল্যাণের চেষ্টা করতেন। তিনি ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিনে এবং বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তহবিল সংগ্রহ এবং অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখতেন। ব্যক্তিগত জীবনে, মুক্তাদির একজন ভালো মানুষের সমস্ত সেরা গুণাবলী অর্জন করেছিলেন। তিনি খুব ধার্মিক ছিলেন এবং পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত না করে কখনো ঘর থেকে বের হননি। তিনি সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি সদয়, সহায়ক এবং ভালো আচরণ করতেন। এভাবে তিনি সবার কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। করোনা সংক্রমণের ঝুঁঁকি থাকা সত্ত্বেও তার জানাজায় বিশাল জনতার উপস্থিতি সেটাই প্রমাণ করে।
মহামারি আমাদের স্বাভাবিক জীবন আকস্মিক থমকে দিলে, বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে মুক্তাদির সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফাউন্ডেশনের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানিয়ে জুমে বেশ কয়েকটি সভার আয়োজন করেন। এটি মিনি স্ক্রিনে একে অপরের মুখ দেখার এবং চলমান ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মতবিনিময় করার একটি সুযোগ প্রদান করে। এ ধরনের সর্বশেষ জুম মিটিংটি হয়েছিল ৫ই আগস্ট ২০২১ সালে, আমাদের ৪৯তম কমিশন দিবসে। সকল অংশগ্রহণকারী আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, তিনি যেন ৫০তম বার্ষিকীটি শারীরিক উপস্থিতিতে দুর্দান্তভাবে পালন করার সুযোগ দেন। মুক্তাদিরকে এখন থেকে তার জন্য প্রস্তুতি শুরু করতে বলা হয়। কিন্তু হায়, তা আর হলো না। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে, যখন বিরতিহীন লকডাউন থেকে কিছুটা অবকাশ ছিল, তখন মুক্তাদির পরামর্শ দেন যে, আমাদের কোর্সমেটদের কয়েকজন কক্সবাজারে একটি ছুটির দিন কাটাবো। প্রত্যেকেই উৎসাহের সঙ্গে প্রস্তাবে সায় দিলো এবং আমরা গেলাম। বিমানের টিকিট থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং পর্যন্ত, স্থানীয় পরিবহন থেকে শুরু করে খাবারের মেনু এবং টেকনাফ ভ্রমণ ইত্যাদি সবই বিনাবাক্য ব্যয়ে মুক্তাদির নিজ উদ্যোগে করেন। চমৎকার এক পুনর্মিলনী ছিল যেখানে আমাদের স্ত্রীরাও ছিলেন।
মুক্তাদির এবং আমি প্রায়ই মুঠোফোনে কথা বলতাম। মাত্র কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল যে, একমাত্র আল্লাহই জানেন আমাদের আবার কবে দেখা হবে বা এই জীবনে আমাদের আর দেখা হবে কিনা। আমি কি জানতাম যে, এত অল্প সময়েই এমন নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঘটে যাবে! আমি তাকে বললাম, আমি আমার স্ত্রীকে আমার মৃত্যুর পর দু-তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে খবরটা জানাতে বলেছি, তিনি তাদেরই একজন। তিনি আমাকে জানান যে, তিনিও তার স্ত্রীকে বলেছিলেন এমন কিছু ঘটলে অবিলম্বে আমাকে জানাতে। সুতরাং, আমার মৃত্যুর পর মুক্তাদির তার দোয়া থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেন। দুঃখজনকভাবে আমাকেই তার শেষ বিদায় জানাতে হলো।
আমরা আল্লাহকে প্রশ্ন করতে পারি না তিনি কেন করেন বা তিনি কি করেন। তিনিই জীবনদাতা এবং তিনিই জীবন গ্রহণকারী। তার পরিবার সান্ত¡না পেতে পারে এই ভেবে যে, মুক্তাদির পবিত্র শুক্রবার এবং পবিত্র আশুরার দিনে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, যা ইসলামিক ক্যালেন্ডারে সবচেয়ে পবিত্র দিন। আক্ষরিক অর্থে কোনো কষ্ট ছাড়াই তিনি বিদায় নিয়েছেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক পুত্র, এক কন্যা, তিন নাতি-নাতনিসহ বহু নিকটাত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষী রেখে গেছেন।
চিরবিদায় বন্ধু। আমরাও শেষ বিদায়ের অপেক্ষায়। আমাদের আগে তোমার ডাক এসেছিল কিন্তু শিগগিরই তোমার সঙ্গে আমাদের দেখা হবে, যখন আল্লাহ চাইবেন।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সচিব এবং রাষ্ট্রদূত, মেজর মুক্তাদিরের কোর্সমেট]