মত-মতান্তর

আফগানিস্তান: চীন কীভাবে লাভবান

আমীর খসরু

২১ আগস্ট ২০২১, শনিবার, ৯:৪১ অপরাহ্ন

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া শুধু মধ্য এশিয়ার অঞ্চলেই নয়, এই অঞ্চল ছাপিয়ে এর প্রভাব পড়ছে অনেক দূরে। আর এই প্রতিক্রিয়া হবে সুদূরপ্রসারী। যে মধ্য এশিয়া অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিস্তর অর্থ ও নানা উদ্যোগ নিয়েছিল- তা শুধু ভেস্তেই যায়নি বরং সবচেয়ে বড় লাভবান দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাশত্রু হিসেবে বিবেচিত চীন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু এমনটা যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই মনে করে। কিন্তু চীন এখন ক্রমশ আফগানিস্তানে প্রভাব বাড়াচ্ছে এবং এই প্রভাব ভবিষ্যতে আরও বাড়বে এমনটাই বিশ্লেষকরা বলছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আফগান প্রশ্নে আসলে চীনকে প্রতিহত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এ বছরে মধ্য জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান ও আফগানিস্তানকে নিয়ে কোয়াড বা রাষ্ট্র চতুষ্টয় গঠন করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতেও রক্ষা হয়নি। চীন ও পাকিস্তান আফগানিস্তান প্রশ্নে  এখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। উজবেকিস্তানের অবস্থাও আগের অবস্থানে নেই।

অনেকেরই মনে প্রশ্ন রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এমন প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে যে, চীন আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালাবে। কিন্তু এটা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বেইজিং তাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের কূটনীতির পথ বেছে নিয়েছে। আফগান তালেবানরা যুক্তরাষ্ট্রের কাবুল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে থেকেই চীনের সঙ্গে যোগাযোগ ও সংযোগে সমর্থ হয়। আফগান তালেবানদের প্রভাবশালী ব্যক্তি মোল্লা  আব্দুল গণি বারাদার গত ২৮শে জুলাই চীনের তিয়ানজিংয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে দ্বীপক্ষীয় বৈঠক করেন বলে ওই সময় চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তালেবানদের একটি প্রতিনিধি দলও চীন সফর করেছিল। এছাড়া চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আফগান ত্যাগের আগে থেকেই তালেবান বেইজিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। চীন সব সময় তালেবানদের কাছ থেকে চেয়েছে যে, আফগানিস্তানে যেন শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। বহির্দেশীয় কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে যেন তারা কোনো মদত বা সহযোগিতা না দেয়। আব্দুল গণি বারাদার জাতিসংঘ ঘোষিত জঙ্গিগোষ্ঠী ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টসহ কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক না থাকা এবং সহযোগিতা না করায় সম্মত হয়েছেন। চীনের উইঘুরদের কোনো ধরনের সহযোগিতা দেবে না বলে তালেবানরা আগে থেকেই চীনকে আশ্বস্ত করেছে।

চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র গত ১৯শে আগস্ট বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আগের তালেবানদের তুলনায় বর্তমান তালেবান অনেক বেশি সংযত, প্রশান্ত, যুক্তিপূর্ণ ও বিবেচক। মুখপাত্র জানান, চীন আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে এবং তাদের বলেছে যে, তালেবানরা যাতে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখে। এদিকে, চীন গত ১৫ই আগস্ট ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা যুদ্ধ পরবর্তী আফগান পুনর্গঠন কাজে অংশগ্রহণে রাজি আছে। তবে পুনর্গঠন কাজের ধরন সম্পর্কে চীন বিস্তারিত কিছু জানায়নি। তালেবানদের মুখপাত্র সোহাইল শাহীন ১৯শে আগস্ট সংবাদ মাধ্যমকে একই ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, আফগানিস্তানে শান্তি আনতে চীন গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছে; একি সঙ্গে দেশ পুনর্গঠন ও উন্নয়নে চীন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।

চীন ও পাকিস্তান এবারে খুব সহজেই চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যেতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভের ক্ষেত্রে হবে বড় অগ্রগতি।

চীন আগে থেকেই আফগানিস্তানে নানা প্রকল্পে বিনিয়োগ ও কাজ করে যাচ্ছিল। গত মে মাসে চীনের পক্ষ থেকে আফগান জ্বালানি খাতে ৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র আফগান সরকারি বাহিনী গঠন বাবদেই ৮৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। আর আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে সরাসরি আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবেই ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এছাড়া নানা খাতে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যয় করতে হবে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ যোশেফ স্টিগলিজের মতে, মাত্র ৪ বছর সময়ের  ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে তাৎক্ষণিক ব্যয় করতে হয়েছে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। তাহলে সহজেই হিসাব করা যায় যে, ২০ বছরের বেশি সময়ে কষ্টকর আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে কত ট্রিলিয়ন ব্যয় করতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।

ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানে বিনিয়োগের ব্যয় করেছে কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন ডলার। এসব বিনিয়োগের কোনোটাই ভারত আর ফেরত পাবে না বলে মনে হয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নও  আফগানিস্তানের উন্নয়ন বাবদ খরচ করেছে ৪ বিলিয়ন ইউরো। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিলিয়ন ডলার অর্থ বিনিয়োগ করেছে। অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বহুদেশ বিনিয়োগ করেছে ওই দেশটিতে। কিন্তু দেশ দখলের শাস্তিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বিশ্বাসী অংশীদাররা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খোয়াতে বসেছে আফগানিস্তানে। তবে বিপরীত চিত্র হচ্ছে- এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় লাভবান চীন এবং এর পরে রাশিয়া। ইরানও লাভবান হতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়েছে ইরানের সরকার।

একটি কথা বলতেই হবে- বিনা পরিশ্রমে আফগানিস্তানকে উপহার হিসেবে পেয়েছে চীন। একটি গুলিও তাদের খরচ করতে হয়নি, দেশও সরাসরি দখল করতে হয়নি।

শুধু বিনিয়োগই নয় ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও চীন লাভবান হয়েছে এবং আরো হবে। কূটনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার যে নীতি বেইজিং গ্রহণ করেছে তাতে ভবিষ্যতে আফগানিস্তানসহ পুরো মধ্য এশিয়ার উপর প্রভাব তাদের বহুলাংশে বেড়ে যাবে। শুধু মধ্য এশিয়াই নয় ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও এই অঞ্চলে তাদের মুরুব্বিপনার নীতির প্রতিও এটি একটি বড় আঘাত।  মৃতপ্রায় দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা সার্কের উপরও এর প্রভাব পড়বে। প্রভাব পড়বে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক পুনঃবিন্যাসে। চীন এখন আফগানিস্তানে ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। চীন এখন বিভিন্ন দেশকে তালেবানদের আফগান সরকারকে সমর্থন দেয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এ কারণে আফগানিস্তানে অন্তবর্তীকালীন সরকারই গঠিত হবে বলে মনে হয়। তবে আফগানিস্তানে চীনের প্রভাব অটুট থাকবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এটাই হচ্ছে চীনের আরেক দফা সাফল্য এবং মার্কিনিদের ভয়াবহ পরাজয়।

(আমীর খসরু: সিনিয়র সাংবাদিক এবং প্রধান নির্বাহী, স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওয়ান্যাল অ্যাফেয়ার্স, ঢাকা)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status