মত-মতান্তর

তালেবান ইস্যু ও ভারতের রাজনীতি

ড. মাহফুজ পারভেজ

২১ আগস্ট ২০২১, শনিবার, ২:২৬ অপরাহ্ন

আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখল সারা বিশ্বেই ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে বিস্মিত করেছে অভাবণীয় দ্রুততায় ও অকল্পনীয় গতিতে তালেবানদের বিজয়ের বিষয়টি। চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তান প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি জানিয়েছে তালেবানদের প্রতি। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই তালেবান ইস্যুতে গ্রহণ করেছে 'অপেক্ষার নীতি'। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে একমাত্র ভারতই তালেবানদের প্রতি কড়া বার্তা জানিয়েছে। ভারতের সরকারের মতোই ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতারা তালেবানদের বিষয়ে সরব। বস্তুত, ভারতের চলমান রাজনীতিতে তালেবান ইস্যু অনেকটাই জায়গা দখল করেছে।

ভারতীয় মিডিয়া, তালেবানরা আফগানিস্তানের দখল নিতেই, সে দেশে হাহাকারের চিত্র তুলে ধরছে। ভারতীয় বিশ্লেষকদের ভাষায়, 'তিলে তিলে মৃত্যু হচ্ছে মানবাধিকারের।' এমনকি, 'বিপন্ন আফগান ভাই-বোনদের বিপদে পাশে থাকার' বার্তা দিয়েছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারত কূটনৈতিক শক্তিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সরব তালেবানদের বিরুদ্ধে।

ভারতের ভেতরেও রাজনৈতিক মাঠে নানাভাবে ও নানা প্রসঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে তালেবান ইস্যু। নেতারাও কথায় কথায় দিচ্ছেন তালেবানদের দৃষ্টান্ত। এমনই ঘটনা ঘটেছে মধ্যপ্রদেশে, সেখানে এক বিজেপি নেতার মন্তব্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এক সাংবাদিক মোদি শাসনে দেশে মূল্যবৃদ্ধি এবং জ্বালানির লাগামহীন দাম নিয়ে প্রশ্ন করতেই চটে গেলেন নেতা। চিৎকার করে সাংবাদিককে বলেন, 'আফগানিস্তান চলে যান, ওখানে পেট্রল সস্তা!'

সেই নেতার নাম রামরতন পায়াল, তিনি মধ্যপ্রদেশের কাটনি জেলার বিজেপি দলের সভাপতি। তাঁর দাবি, 'দেশে যখন করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে সেই সময় মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে।' প্রশ্নের জবাবে তিনি রেগে গিয়ে প্রশ্নকর্তা সাংবাদিককে বলেন, 'তালেবানের কাছে চলে যাও, পেট্রল আফগানিস্তানে ৫০ টাকা লিটারে বিক্রি হচ্ছে। এখানে কেউ এসব জিজ্ঞেস করছে না। অন্তত ভারতে আমরা সুরক্ষিত রয়েছি। ভারত ইতিমধ্যেই দু-দুটো সংক্রমণের ঢেউ দেখেছে, তৃতীয় ঢেউ আসছে।' বিজেপি নেতার এহেন মন্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়। এরপর বিজেপি নেতা সাংবাদিককে আরও বলেন, 'দেশের পরিস্থিতি বুঝুন। এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য মোদিজিকে ধন্যবাদ। আপনি একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক। আপনি আদৌ জানেন কী পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে দেশ! মোদিজি কীভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখছেন। তিনি এখনও ৮০ কোটি ভারতীয়কে বিনামূল্যে রেশন দিচ্ছেন। কেউ দেবে?' উদ্বেগের বিষয়, ওই বিজেপি নেতা বা তাঁর অনুগামীদের কেউ-ই মুখে মাস্ক পরেননি। দূরত্ব বিধিও মানেননি।

এই মন্তব্যের জেরে শাসক দলের বিরোধী শিবির ক্ষিপ্ত। তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় কটাক্ষ করে বলেছেন, 'জনপ্রতিনিধিরা এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করলে তা সত্যিই লজ্জাজনক।' একটি টুইটে তিনি লেখেন, 'আন্তর্জাতিক স্তরের এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য করার জন্য লজ্জাবোধ হয়। দেশের অগ্রগতির জন্য এসব খুবই বিপজ্জনক।'

মধ্যপ্রদেশের মতোই ঘটনা ঘটেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায়। ২০২৩ সালে সেখানকার নির্বাচনকে সামনে রেখে কলকাতা থেকে তৃণমূল নেতারা ঘন ঘন আগরতলা আসা-যাওয়া করছেন। যদিও রাজ্যের বিজেপি সরকার তৃণমূলের কার্যক্রমকে নানাভাবে আটকাতে চেষ্টা করছে, তথাপি 'খেলা হবে' স্লোগান নিয়ে ত্রিপুরায় সরব তৃণমূল। বিজেপিও ছেড়ে কথা বলছে না। হামলা, মামলা, হুমকি দিয়েই চলেছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের। এমন কি, 'আগরতলায় আসলেই তৃণমূল নেতাদের তালেবানি কায়দায় শিক্ষা দিক বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা', এমন প্ররোচনামূলক মন্তব্য করে বিতর্কেও জড়িয়েছেন ত্রিপুরায় বিজেপি বিধায়ক। বিস্ফোরক মন্তব্যকারী সেই বিধায়কের নাম অরুণ ভৌমিক। মোদী মন্ত্রিসভার সাম্প্রতিক রদবদলে ত্রিপুরা থেকে মন্ত্রী হয়েছেন প্রতিমা ভৌমিক। তাঁর সংবর্ধনা মঞ্চে এমন আগ্রাসী ও উস্কানীমূলক মন্তব্য করেন সেই বিজেপি বিধায়ক।

অরুণ ভৌমিকের এহেন বক্তব্য ত্রিপুরার ক্রম-উত্তপ্ত রাজনীতিকে আরো গরম করেছে। অরুণ ভৌমিক বলেন, ‘বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মদতে তৃণমূল নেতারা ত্রিপুরার বিপ্লব দেব সরকারের ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন। বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের কাছে আমার আবেদন ওদের উপর তালেবানি কায়দায় হামলা হোক। ওরা বিমানবন্দরে নামলেই ওদের উপর তালেবানি কায়দায় হামলা হোক। প্রতি রক্তবিন্দু দিয়ে আমরা ত্রিপুরায় সরকার রক্ষা করব।‘

দক্ষিণ এশিয়ার পশ্চিম প্রান্তের আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখলে ভারত বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখলেও এবং কড়া প্রতিক্রিয়া জানালেও ভারতেরই নানা প্রান্তে তালেবানদের অনুসরণে আহ্বান সবাইকে বিব্রত করেছে। বিশেষত ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখে তালেবানদের কাছে চলে যাওয়ার এবং তাদের কৌশল গ্রহণ করার জন্য দলীয় কর্মীদের প্রতি আর্জি জানানোয় বিস্মিত হয়েছেন বিশ্লেষকগণ। তাদের ভাষায়, 'মৌলবাদ আসলেই গণতান্ত্রিক ও উদারপন্থী রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য বিরাট বিপদের কারণ। আর সেটা মুসলিম বা হিন্দু কট্টরপন্থী হোক কিংবা আফগানিস্তান বা ভারতে হোক, বিপদের মাত্রা ও গভীরতা একই।' ফলে বিজেপি বিধায়কদের তালেবান বিষয়ক মন্তব্যে উত্তেজনা বেড়েছে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে।

এদিকে, ২০২৩ সালের ভোটকে সামনে রেখে এখন থেকেই ত্রিপুরায় সংগঠন বিস্তারে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস। তারা ভারতের কেন্দ্র ও প্রতিটি রাজ্য থেকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অবসানের ডাক দিয়েছেন। একগুঁয়েমি সরিয়ে রেখে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে সকলকে এক হয়ে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। শুক্রবার (২০ আগস্ট) কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর ডাকে ১৯টি বিরোধী দলের প্রধানদের বৈঠক হয়। সেখানেই বক্তব্য রাখেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী জোট নিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন তিনি। জানান, 'ইগো ও ব্যক্তিগত স্বার্থকে দূরে সরিয়ে রেখে সকলকে জোটবদ্ধ হয়ে বিজেপির গেরুয়া শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হবে।' তাঁর বার্তা, 'কংগ্রেসের সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ নেই তাঁদেরও বিরোধী জোটে শামিল করতে হবে। আমন্ত্রন জানাতে হবে।'

বৈঠকে পরিকল্পিতভাবে বিরোধী জোট পোক্ত করার ডাক দিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে কার্যত সেই পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবের মুখ দেখবে তার পথ বাতলেছেন। যা জাতীয়স্তরে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-বিরোধী রাজনীতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় হলো, ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য ভারতের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী পদ্ম শিবিরকে উৎখাতে মোদি বিরোধী জোট গঠন প্রয়োজন বলে মানছেন সকল বিরোধী দলই। কিন্তু জোটে কংগ্রেসের অবস্থান একাধিক বিজেপি বিরোধী দলের কাছেই সংশয়ের। আবার বিরোধী জোট দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল কংগ্রেসকে ছাড়া কার্যত অসম্ভব।

এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেছেন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ এবং বিজেপি বিরোধী অন্যতম মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী জোট পোক্ত করতে নিজেই সমঝেতামূলক বার্তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। মোদি সরকারকে ফেলতে কংগ্রেসের সঙ্গেই বিরোধী জোটে যে অন্যান্য বিজেপি বিরোধী দলও সমান গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। এদিকে, নানা জনমত জরিপেও মোদির জনপ্রিয়তা হ্রাসের পাশাপাশি মমতার প্রতি মানুষের সমর্থনের হার বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিরোধীরা বিভিন্ন সভা, সমাবেশ ও বৈঠকে কৃষক আন্দোলনের প্রসঙ্গ, মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও একনায়কতন্ত্রের অভিযোগ, নাগরিকদের প্রতি বঞ্চনা, পেগাসাস ইস্যু, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গ তুলে সোচ্চার হওয়ার জবাবে বিজেপির পক্ষ থেকে তালেবান ইস্যু ঘরোয়া রাজনীতিতে নিয়ে আসার বিষয়টিও সবার নজর কেড়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status